ঢাকার বাড্ডার সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চলছিল অনুমোদন ছাড়া, যা এই সময়ে আলোচিত। তা নিয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে বের হলো, গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালও এই মুহূর্তে চলছে লাইসেন্স ছাড়া।
ইউনাইটেড হাসপাতাল রাজধানীর নামি চিকিৎসালয় হিসাবে পরিচিত। হাসপাতাল হিসাবে কাজ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। গুলশান ইউনাইটেডের সেই লাইসেন্সের মেয়াদ ফুরিয়েছে গত বছরের জুন মাসে, যে সংক্রান্ত নথিপত্র সকাল সন্ধ্যা দেখতে পেয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঠিক এই মুহূর্তে ইউনাইটেড হাসপাতাল মেয়াদোত্তীর্ণ।”
কেন? তার উত্তরে তিনি বলেন, “ওদের ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ না। ওরা রিনিউয়ের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু সেটাও অসম্পূর্ণ। হালনাগাদ হয়নি সবকিছু।”
অনুমোদন ছাড়াই কাজ চালানো নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ‘অতি শিগগিরই’ চিঠি দেবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। আবার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ চালাতে নিতে হয় ট্রেড লাইসেন্স, যা দেয় এলাকাভিত্তিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের অনুমোদন নেওয়া বা নবায়নের আবেদনে আবার ট্রেড লাইসেন্স জমা দিতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, “দেশে তো আরও এমন বড় হাসপাতাল রয়েছে, তারা অন্তত আর যাই করুক, লিগ্যাল ইস্যুগুলোতে খুবই সিনসিয়ার। কিন্তু ইউনাইটেড হাসপাতাল এদিকে ভ্রূক্ষেপই করে না।”
সকাল সন্ধ্যা বিষয়টি নিয়ে বুধবার ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, তাদের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে।
তাহলে লাইসেন্স নবায়ন হয়নি কেন- প্রশ্নে তিনি এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে অপরাগতা জানান। আরিফুল বলেন, “সব কাগজপত্র নিয়ে তাহলে আমরা সামনাসামনি বসে কথা বলতে পারি।”
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা ইউনাইটেড হাসপাতালে বিশেষায়িত অনেক ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। গুলশানে ৪ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০টি।
ইউনাইটেড হাসপাতাল ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার সার্ভিসেসের অধীনে চার প্রতিষ্ঠানের একটি। বাকিগুলো হলো- জামালপুরের এম এ রশীদ হাসপাতাল, ঢাকার ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের মেডিক্স এবং বাড্ডার সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গিয়ে সাড়ে ৫ বছরের শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনাটি আলোচনায় এলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এটি বন্ধ করে দেয়। কেননা হাসপাতালটির লাইসেন্স ছিল না।
গত ১০ জানুয়ারি এক আদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিদর্শনের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাইসেন্স দেখাতে পারেনি। অথচ তারা চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিল। এটি সরকারের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। এমনকি নিবন্ধন বা লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানটি কখনও আবেদনই করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওরা তো আবেদনই করেনি। আর আবেদন না হলে আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি না, খোঁজ নিতে পারি না।”
হাসপাতালটির জন্য ‘ভুল’ নামে নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নাম ছিল আবেদনপত্রে। হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ যাই হবে, নিয়ম অনুযায়ী সেটা তো এই নামে হবে। কিন্তু তা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”
ইউনাইটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেডিক্সও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইলেন্সধারী হাসপাতালের তালিকায় নেই।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল হক এর আগে সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, মেডিক্সে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস দেওয়া হয়। অনেকটা হাসপাতালের বহির্বিভাগের মতো।
তিনি আরও বলেছিলেন, ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে রয়েছে তাদের। এম এ রশীদ হাসপাতাল ও গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল নিজ নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত। বাকি দুটির জন্য ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার সার্ভিসের নামে নিবন্ধনের আবেদন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিজ নাম অনুযায়ী তার নিবন্ধন হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মেডিক্সের নামের তালিকায় ক্যাটাগরিতে লেখা রয়েছে ক্লিনিক। অর্থ্যাৎ এই প্রতিষ্ঠানের নামের লাইসেন্স পেতে হবে এর নিজ নামে। কিন্তু এর লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের নামে; যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সের ব্যত্যয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওরা তোয়াক্কাই করে না। আমরা নিজেরা ফোনে অনুরোধ করে বলেছি, প্রতিষ্ঠানের নাম অনুযায়ী লাইসেন্স হতে হবে। পাওয়ার দেখানোর জায়গা পেয়েছে তারা এখানে।
“ইউনাইটেডের কেউ যদি বলে মেডিক্স হাসপাতালের বহির্বিভাগের মতো, তাহলে তিনি সেটা মিথ্যা বলেছেন; একদম ভুল তথ্য দিয়েছেন তিনি। কারণ এখানে ডায়ালাইসিস হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। আমি নিজে সেখানে পরীক্ষা করিয়েছি। ওদের লাইসেন্স নেয়াই তো ক্লিনিক ক্যাটাগারিতে।”
অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান মেডিক্স নিয়ে বলেন, “প্রতিষ্ঠান এবং লাইসেন্স দুই নামে হতে পারে না, প্রতিষ্ঠান এবং লাইসেন্স এক নামে হতে হবে। কেবল তাই নয়, প্রতিষ্ঠান-ভ্যাট-টিন সব এক নামে হতে হবে।
“মেডিক্সের বিষয়টি আমরা জানতাম না, এখন জানলাম এবং অবশ্যই আমরা এটা দেখবো। আর ওদের যদি প্রতিষ্ঠানের নাম এবং লাইসেন্সের নাম ভিন্ন হয়, তাহলে তারা মেডিক্স চালাতে পারবে না।”
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বলেন, তিনি অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল বন্ধ করতে চান। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা সব ধরনের অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ অবৈধ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
দেশে কতগুলো অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, সেই তালিকাও চেয়েছেন নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “সংখ্যায় যতগুলোই থাকুক, এসব অবৈধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে আমাদের অভিযান শিগগিরই শুরু করা হবে। এর মধ্যে যদি অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকরা নিজেরাই বন্ধ করে দেয় ভালো, না হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”