১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে এক অভিবাসী পরিবারে কমলা হ্যারিসের জন্ম।
তার মা শ্যামলা গোপালানের জন্ম ভারতের তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে। ১৯৫৮ সালে ১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে যান পড়াশোনা করতে। তিনি ২০০৯ সালে মারা যান।
কমলার বাবা ডোনাল্ড হ্যারিসের জন্ম উত্তর আমেরিকার ক্যারিবিয়ান দ্বীপ অঞ্চলের জ্যামাইকায়। তিনি বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তিনি বর্তমানে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত।
[পড়ার জন্য যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করুন]
কমলা ও তার বোন মায়া যখন অনেক ছোট ছিলেন তখনই তাদের বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়। সেসময় কমলার সম্ভবত ৭ বছর আর তার বোনের ৫ বছর বয়স ছিল। এরপর তারা তার মায়ের কাছেই বড় হন। কমলা ও তার বোন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে বড় হয়েছেন। তার মা কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার চাকরি এবং ইহুদি জেনারেল হাসপাতালে ক্যান্সার গবেষক হিসেবে কাজ পাওয়ার পর কমলা ও তার বোন মন্ট্রিলের মিডল স্কুল এবং হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন।
১৯৮২ সালে কমলা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যেটি ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে তিনি আলফা কাপ্পা আলফা তথা দেশের প্রাচীনতম কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে যোগ দেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম গ্রাজুয়েট যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
কলেজের পরে হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে আসেন এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি হেস্টিংসর আইন স্কুলে যোগ দেন। যেটি এখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর আইন স্কুল। সেখান থেকে কমলা হ্যারিস ১৯৮৯ সালে আইনে স্নাতক হন।
ছাত্রাবস্থা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত সম্পর্কের মতো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কমলা সোচ্চার হতে থাকেন। কমলা অল্প বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি দুর্বল মানুষদের অধিকার আদায়ে লড়াই করার ক্যারিয়ার গড়বেন, যখন তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে জানায় যে, সে বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সেই সিদ্ধান্ত থেকেই কমলা একজন শিশু যৌন নির্যাতন বিশেষজ্ঞ প্রসিকিউটর হয়েছিলেন। জেলা অ্যাটর্নি হিসাবে তিনি গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং বন্দুক সহিংসতার মতো বিষয় নিয়েও কাজ করেন।
অপরাধীরা যেন আবার অপরাধ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি উদ্ভাবনী কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন এবং অনেক অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সর্বোচ্চ সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ডেরও বিরোধী।
কমলা হ্যারিস ২০১৪ সালে বিয়ে করেন। তার স্বামী ডাগ এমহফও একজন আইনজীবী। তার সঙ্গে কমলার একটি ব্লাইন্ড ডেটে আলাপ হয়েছিল। কমলার নিজের গর্ভজাত কোনও সন্তান নেই। তার স্বামীর আগের স্ত্রীর দুই সন্তান আছে।
আইনে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৯০ সালে কমলা হ্যারিস আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর জেলা অ্যাটর্নি নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি প্রায় তিন দশক প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করেন। এসময় তিনি ওকল্যান্ডের আলামেডা কাউন্টির ডেপুটি জেলা অ্যাটর্নি হিসাবেও কাজ করেন।
২০১১ সালে কমলা ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন রাজ্যের প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশিয়ান আমেরিকান অ্যাটর্নি জেনারেল। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে কমলা আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে শীর্ষ আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে কাজ করার সময়ই জো বাইডেনের বড় ছেলে বিউয়ের সঙ্গে কমলার পরিচয় হয় ও বন্ধুত্ব। বিউও একজন আইনজীবি এবং ডেলাওয়ারের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন।
কর্মজীবন শুরু করার কয়েকবছর পর ১৯৯৪ সালে কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার রাজ্য আইনসভার স্পিকার উইলি ব্রাউনের সঙ্গে ডেটিং শুরু করেন। উইলি ব্রাউন ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার রাজনীতির একটি পাওয়ার হাউস, যিনি হ্যারিসের চেয়ে বয়সে ৩০ বছরের বড় ছিলেন। ব্রাউন তাকে ক্যালিফোর্নিয়ার বেকারত্ব বীমা আপিল বোর্ড এবং মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্স কমিশনে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
১৯৯৫ সালে ব্রাউন সান ফ্রান্সিসকোর মেয়র নির্বাচিত হন। সেবছরের ডিসেম্বরেই কমলা তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
সান ফ্রান্সিসকো জেলা অ্যাটর্নির অফিসে নিয়োগ পাওয়ার পর কমলা হ্যারিস শহরের কিশোর পতিতাবৃত্তি বন্ধে অভিযান চালান। এই সময়ে তিনি সান ফ্রান্সিসকোর অভিজাতদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
২০০৪ সালে বারাক ওবামার সঙ্গেও কমলার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সেসময় বারাক ওবামা সিনেটর পদে নির্বাচন করেছিলেন। ২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে কমলা হ্যারিস তাকে সমর্থন করেন। ২০১৩ সালে বারাক ওবামা তাকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি আগ্রহ দেখাননি।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে তার বড় একটি কৃতিত্ব ছিল ওপেন জাস্টিস তৈরি করা, যা ফৌজদারি বিচারের ডেটা জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করার জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ডাটাবেজটি পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় মৃত্যু এবং আহতদের সংখ্যার তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
ডেমোক্রেটিক পার্টি এবার প্রথমে জো বাইডেনকেই ফের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু গত ২৭ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম প্রেসিডেন্ট বিতর্কে ধরাশায়ী হওয়ার জেরে এবং বার্ধ্যকের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না থাকায় বাইডেন সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
এ ছাড়া জরিপে দেখা যায়, ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের সমর্থনও অনেক কমে গিয়েছিল। গত ২ জুলাই প্রকাশিত সিএনএন-এর একটি জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোটার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পক্ষে ছিলেন। আর ট্রাম্পের পক্ষে মত দেন ৪৯% ভোটার। ওই জরিপেই জানা যায়, যদি কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে ৪৫% তাকে ভোট দেবেন, আর ট্রাম্পকে ভোট দেবেন ৪৭% ভোটার। এরপর আরও কয়েকটি জরিপেও বাইডেনের প্রতি ভোটারদের সমর্থন ট্রাম্পের চেয়ে কম দেখা যায়।
অবশেষে গত ২২ জুলাই বাইডেন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন এবং কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেন। কমলা হ্যারিস প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের সমর্থন দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। এমনকি কমলা জরিপে ট্রাম্পকেও কিছুটা ছাড়িয়ে যান এবং আভাস মিলছে যে, এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত তিনটি জরিপে— এনবিসি নিউজ, এবিসি নিউজ/ইপসোস এবং সিবিএস নিউজ/ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, কমলা হ্যারিস গড়ে ট্রাম্পের চেয়ে ১.৪ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। তবে এই ফলাফল এক মাস আগের জরিপের ফলাফল থেকে প্রায় অর্ধেক কম। গত মাসের জরিপগুলোতে কমলা হ্যারিস গড়ে ২.২ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। তার মানে শেষদিকে এসে কমলার সমর্থন কিছুটা কমেছে।
শৈশবে ট্রাম্প বেশ দুষ্টু ছিলেন। যে কারণে শৃঙ্খলা শেখাতে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তাকে সামরিক একাডেমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক মিলিটারি একাডেমি থেকে হাইস্কুল শেষ করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই বছরের জন্য ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তারপর তিনি পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজাত হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলে স্থানান্তরিত হন, যেখান থেকে তিনি ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বড় ভাই ফ্রেড ট্রাম্প জুনিয়র পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাবার সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে পরে মাদকাসক্তির কারণে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয় মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। এজন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প পরবর্তী জীবনে মদ ও ধূমপান করেননি।
ট্রাম্প বলেন, বাবার কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি তার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছিলেন। নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার বাবার আবাসন প্রকল্পগুলোর বিস্তৃত পোর্টফোলিও পরিচালনা করতে সাহায্য করতেন ট্রাম্প। ১৯৭১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাবার হাত থেকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন এবং নতুন নাম রাখেন ট্রাম্প অর্গানাইজেশন। তার বাবা ১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমার বাবাই ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা।”
তিনটি বিয়ে সহ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনও তার পেশাগত জীবনের মতোই গণআলোচনার বিষয় হয়ে উঠে। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভানা জেলনিকোভা, যিনি একজন চেক ক্রীড়াবিদ, মডেল ও ব্যবসায়ী। তাদের তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা এবং এরিক।
ইভানা জেলনিকোভার সঙ্গে ট্রাম্প ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সংসার করেন। ট্রাম্পের যৌন অবিশ্বস্ততার গুজবের মধ্যেই তাদের সম্পর্কটি শেষ হয়েছিল। বিচ্ছেদের সময় আদালতে তাদের আইনি লড়াই নিয়মিত ‘গসিপ কলামে’ স্থান পেয়েছে।
১৯৯৩ সালে ট্রাম্প অভিনেত্রী মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন, যার সঙ্গে তার একটি কন্যা হয়েছিল— টিফানি ট্রাম্প। এই বিয়েটিও ১৯৯৯ সালে বিচ্ছেদে শেষ হয়েছিল। ২০০৫ সালে ট্রাম্প স্লোভেনিয়ান মডেল মেলানিয়া নাউসকে বিয়ে করেন, যিনি তার বর্তমান স্ত্রী। তার সঙ্গে ট্রাম্পের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে— ব্যারন ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। একাধিকবার যৌন নির্যাতন ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। চলতি বছরের শুরুর দিকে আদালত রায় দেয় যে, তার বিরুদ্ধে লেখিকা ই জিন ক্যারলের তোলা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই লেখিকার মানহানি করেছেন। মামলায় তাকে মোট ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ট্রাম্প এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
২০০৬ সালে পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গোপন রাখতে ট্রাম্প তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দেন। ওই খরচের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতির অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় ৩৪টি গুরুতর অপরাধে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট যাকে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হল।
বিবিসির প্রতিবেদন মতে, ১৯৮০ সালে এক সাক্ষাতকারে ৩৪ বছর বয়সী ট্রাম্প রাজনীতিকে ‘মিন লাইফ’ (খুবই নিচুস্তরের জীবন) হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিরা’ রাজনীতির পরিবর্তে ব্যবসার জগতকে বেছে নেন।
তবে তার সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে ৮০-র দশকের শেষেদিকে। ১৯৮৭ সালে তিনি রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন। ট্রাম্প তিনটি প্রধান সংবাদপত্রে পূর্ণ-পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে পররাষ্ট্র নীতি এবং ফেডারেল বাজেট ঘাটতি দূর করার বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করেন। কথিত আছে, ট্রাম্প প্রথমে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালে ট্রাম্প রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের রানিংমেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার জন্য তাকে বিবেচনা করতে রিপাবলিকান দলের পরামর্শক লি অ্যাটওয়াটারের মাধ্যমে প্রস্তাব দেন। বুশ তার অনুরোধটিকে ‘অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য’ বলে মনে করেন।
নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের মতোই ট্রাম্প একটানা বেশিদিন কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে স্থির থাকতে পারেননি। অন্তত পাঁচবার তিনি রাজনৈতিক দল বদল করে অবশেষে রিপাবলিকান পার্টি থেকেই প্রেসিডেন্ট হন।
ট্রাম্প ১৯৯৯ সালে রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগ করে রিফর্ম পার্টিতে যোগ দেন এবং দলটি থেকেই ২০০০ সালে প্রথবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীতার কথা ভাবেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ২০০১ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ৮ বছর থাকার পর ২০০৯ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে ফিরে যান। কিন্তু ২০১১ সালে ট্রাম্প আবারও রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগ করেন। এবার তিনি যোগ দেন ইনডিপেনডেন্ট পার্টিতে।
২০১২ সালে ট্রাম্প আবারও রিপাবলিকান পার্টিতে ফিরে আসেন এবং আবারও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার কথা ভাবেন, কিন্তু কারো সমর্থন না পাওয়ায় আর প্রতিযোগিতা করেননি। সেসময় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ‘বার্থরিজম’-এর সবচেয়ে সোচ্চার প্রবক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘বার্থরিজম’ তত্ত্ব খাড়া করে ‘বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কি না’ এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালের জুনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ঘোষণা দেন। ‘আমেরিকান ড্রিম’ মরে গেছে বলে ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনিই ‘আমেরিকান ড্রিমকে আরও বৃহত্তর এবং ভালোভাবে’ ফিরিয়ে আনবেন। ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’-কে তার প্রচারাভিযানের স্লোগান বানিয়ে ট্রাম্প সহজেই রিপাবলিকানদের মনোনয়নও বাগিয়ে নেন।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ঘণ্টা থেকেই তার কার্যকালে বারেবারে নাটকীয়তা দেখা গিয়েছে। ট্রাম্প প্রায়ই বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা টুইটারে দিতেন। ভিন দেশের নেতৃত্বের সঙ্গেও প্রকাশ্যে তাকে বচসা করতে দেখা গেছে।
ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে ভুয়া আখ্যায়িত করে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিসহ অন্তত ১০০টি জলবায়ু ও বাণিজ্য চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের জন্য সামরিক তহবিলের অর্থ ব্যবহার করেন।
ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন এবং প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বাণিজ্য চুক্তি এবং ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তিনবার দেখা করলেও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে ট্রাম্প ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদে ফেলেছিলেন। বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেক সুপারিশ উপেক্ষা বা বিরোধিতা করেছিলেন। অপ্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচার করে ভুল তথ্য ছড়িয়েছিলেন। টিকা না নেওয়ায় অবশেষে তিনি নিজেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্প তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যাকে অভিশংসিত হতে হয়েছে এবং একমাত্র প্রেসিডেন্ট যাকে দুবার অভিশংসিত হতে হয়েছে। ২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক কোনও বিষয়’ খুঁজে বের করার জন্য ইউক্রেন সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন। এজন্য ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি পরিষদে তাকে অভিশংসিত করা হলেও রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন সেনেটে তিনি খালাস পেয়ে যান।
এসব কারণে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ডেমোক্রেট প্রার্থী জো-বাইডেনের কাছে হেরে যান। কিন্তু ট্রাম্প তার এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ক্রমাগত ভোট চুরি এবং নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করে ৬০টিরও বেশি মামলা করেন, যদিও আদালত সেসব খারিজ করে দেয়।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং তাদের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে জড়ো হয়ে প্রতিবাদের আহ্বান জানান। সেদিন কংগ্রেসের বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণা করার কথা ছিল।
ট্রাম্পের সমর্থকদের সেই সমাবেশ দাঙ্গার রূপ নেয় এবং তারা পার্লামেন্ট ভবনে হামলা করে নজিরবিহীন সহিংসাত চালায়। এই ঘটনায় ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হতে হয়। তবে এবারও তাকে বেকসুর খালাস করে সেনেট। এই ঘটনায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এখনও দুটো ফৌজদারি মামলা চলছে।
প্রতি চার বছর পরপর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। এর মধ্যে রয়েছে ককাস ও প্রাইমারি, কনভেনশন, সাধারণ নির্বাচন, ইলেক্টোরাল কলেজ এবং আরও অনেক কিছু। তবে প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া একটি সাধারণ চক্র অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়। এই চক্র শুরু হয় নির্বাচনী বছরের আগের বছরের মার্চে, আর শেষ হয় পরের বছরের জানুয়ারিতে (মোট ২২ মাস সময়কাল)।
চার বছর পর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের প্রথম মঙ্গলবার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। সে হিসেবে আগামি ৫ নভেম্বর হবে এবারের প্রেসিডন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন হয় তা জেনে নেওয়া যাক।
[পড়ার জন্য যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করুন]
নির্বাচনের আগের বছরের বসন্তকাল (২০ মার্চ থেকে ২০ জুন) : এই সময়ে আগ্রহী প্রার্থীদের ফেডারেল (জাতীয়) নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধনের কোনোও সময়সীমা না থাকলেও কিছু শর্ত রয়েছে।
নিবন্ধনের পর আগ্রহী প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের কাছে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের জন্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা ঘোষণা করেন।
নির্বাচনী বছরের আগের বছরের গ্রীষ্ম (জুন-আগস্ট) থেকে নির্বাচনী বছরের বসন্তকাল (মার্চ-জুন) : এই ১২ মাসের মধ্যে দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাইমারি ও ককাস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে প্রাইমারি ও ককাস নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সভা ও বিতর্ক হয়। এরপর ভোটগ্রহণ হয়।
নির্বাচনী বছরের জানুয়ারি থেকে জুন : প্রাইমারি ও ককাসের ১২ মাসের প্রথম ছয় মাস শুধু আলোচনা সভা ও বিতর্ক। দ্বিতীয় ছয় মাসে আলোচনা-বিতর্কের পাশাপাশি ভোটগ্রহণও হয়।
দলের সাধারণ সদস্যরা ভোট দিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সেই প্রতিনিধিদের ভোটে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচিত হন।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিক : প্রাইমারি ও ককাসে নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধিরা দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করার পর তার মনোনয়ন চুড়ান্ত করার জন্য দলের জাতীয় কনভেনশন বা সম্মেলন হয়।
জাতীয় সম্মেলনের ঠিক আগে বা সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বা রানিং মেটের নাম ঘোষণা করেন।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর : এই সময়ে বিভিন্ন দল থেকে (সাধারণত প্রধান দুই দলের) চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থীরা প্রেসিডেন্ট বিতর্কে অংশ নেন।
অবশ্য জুনে প্রার্থী বাছাই হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক হতে পরে। এবার যেমন জুনের শেষদিকে প্রথম প্রেসিডেন্ট বিতর্ক হয়।
নভেম্বরের প্রথম দিক : নির্বাচনী বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের প্রথম মঙ্গলবার ‘নির্বাচন দিবস’। এদিন মার্কিন জনগণ ভোট দেন। একে বলা হয় পপুলার ভোট।
ভোটাররা প্রেসিডেন্ট ও ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যদের বা ইলেক্টরদের নির্বাচনের জন্য ভোট দেন।
নির্বাচন দিবসে ওয়াশিংটন ডিসি ও ৫০টি অঙ্গরাজ্যের জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটে ৫৩৮ জন ইলেক্টর বা নির্বাচককে নির্বাচন করেন।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি : ডিসেম্বরের ২য় বুধবারের পর প্রথম সোমবারে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টররা নিজ নিজ রাজ্যের রাজধানীতে মিলিত হয়ে আলাদা আলাদা ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইলেক্টোরাল কলেজ এবং তাদের ভোটকে বলা হয় ইলেক্টোরাল ভোট।
ইলেক্টর বা নির্বাচকরা ইলেক্টোরাল কলেজে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের জন্য তাদের ভোট দেন। অনেক সময় এই পর্যায়ে এসেও কে প্রেসিডেন্ট হবেন তা নির্ধারিত হয়।
পরের বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে : পার্লামেন্ট (কংগ্রেস) ইলেক্টোরাল ভোট গণনা করে।
২০ জানুয়ারি : নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ও শপথগ্রহণ এবং অভিষেক দিবস।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের অবশ্যই মৌলিক কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। দেশটির সংবিধান বলে যে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে অবশ্যই:
যে কেউ এই তিনটি শর্ত পূরণ করেই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করতে পারেন।
কিছু কিছু রাজ্যে শুধু প্রাইমারি অথবা ককাস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আর কিছু রাজ্যে দুটোই হয়।
প্রাইমারি নির্বাচন পরিচালনা করে রাজ্য ও স্থানীয় সরকার। আর রাজনৈতিক দলগুলো আয়োজন করে ককাস নির্বাচন। এই দুই নির্বাচনে নির্বাচিত তৃণমূলের দলীয় প্রতিনিধিরাই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করেন। যে প্রার্থীকে দলের বেশিরভাগ প্রতিনিধি ভোট দেন তিনিই দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন পান।
প্রাইমারিতে সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলোতে দিনব্যাপী গোপন ব্যালটে তৃণমূল থেকে দলীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচিত ওই প্রতিনিধিরা জাতীয় সম্মেলনে যান। রাজ্যের সর্বনিম্ন প্রশাসিনক ইউনিট থেকে এসব প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।
ককাস হল তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিটি এলাকায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধিত ভোটার ও কর্মীদের সম্মেলন, যা পূর্বনির্ধারিত দিন ও ক্ষণে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রথমে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। এরপর প্রতিটি এলাকা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য মৌখিক বা হাত তোলার মাধ্যমে ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়।
ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গরাজ্য এবং রাজনৈতিক দলের নিয়মের উপর নির্ভর করে প্রাইমারি ও ককাসের ভোটগ্রহণ হয়। প্রাইমারি ও ককাসের নির্বাচনে অনেক সময় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধিত সমর্থকরা ছাড়া অন্য দলের এবং সাধারণ ভোটাররাও অংশগ্রহণ করতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যগুলোর নিজেদের নিয়ম অনুযায়ী ভোটগ্রহণ হয়। কোথাও কোথাও ‘উম্মুক্ত’ ভোটগ্রহণ হয়। এক্ষেত্রে ভোটারকে কোনো দলের হয়ে নিবন্ধিত হতে হয় না।
কোথাও কোথাও হয় ‘আবদ্ধ’ ভোট। এক্ষেত্রে ভোটারকে কোনো না কোনো দলের হয়ে নিবন্ধিত হতে হয়।
কোথাও কোথাও আবার দুভাবেই ভোটগ্রহণ হয়।
এ বছর প্রাইমারি ও ককাসে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার ৭০০ জন, যার মধ্যে ৪ হাজার ৫৬৭ জন (৯৮.৯%) কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল ২ হাজার ৪২৯ জন, যার মধ্যে ২ হাজার ২৬৮ জন (৭৬.৪%) ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দেন।
প্রেসিডন্ট প্রার্থী হতে একজন প্রার্থীকে সাধারণত রাজ্যগুলির প্রাইমারি ও ককাসের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিংহভাগের সমর্থন পেতে হয়।
কোনো প্রার্থী প্রাইমারি ও ককাসে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পেলে জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধিরা প্রার্থী নির্বাচন করেন।
জাতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধি থাকেন দুইরকম। একদল প্রাইমারি বা ককাসের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে সমর্থন দেন। আরেকদল তাদের পছন্দমাফিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন।
রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে তাদের দলের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদেরকেই ‘ইলেক্টর’ হিসাবে মনোনয়ন দেয়। এই মনোনীত ইলেক্টরগণ বিজয়ী হলে নিজ নিজ প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকেই ভোট দেবেন বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকেন। প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই হলো ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটারদের একমাত্র কাজ। মোট ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮।
একেক অঙ্গরাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা একেক রকম। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদের সদস সংখ্যা ও সিনেটরের সংখ্যা মিলে যত হয় সেটাই ঐ অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া রজ্যে ২ জন সিনেটর আছেন এবং ৫২টা ডিস্ট্রিক্টের জন্য ৫২ জন প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য আছেন। তার মানে ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ২+৫২= ৫৪টি।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ২ জন করে সিনেটর থাকলে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মোট সিনেটরের সংখ্যা হয় ১০০ জন। ৫০টি অঙ্গরাজ্যে মোট কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট্রের সংখ্যা ৪৩৫টি এবং প্রতিটিতে একজন করে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য রয়েছেন। তার মানে মোট প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য সংখ্যা ৪৩৫। এখন ১০০+৪৩৫= ৫৩৫ হয়। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ৩ জন ইলেক্টর নির্বাচিত হন। তাদের সহ সর্বমোট ৫৩৫+৩= ৫৩৮ ভোট।
এবার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইলেক্টর নির্বাচিত হবেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে— ৫৪ জন। এর পরের অবস্থানে আছে টেক্সাস— ৪০ জন। ফ্লোরিডা থেকে ৩০ জন, নিউইয়র্ক থেকে ২৮ জন, পেনসিলভানিয়া ও ইলিনয় থেকে ১৯ জন, ওহিও থেকে ১৭ এবং মিশিগান থেকে ১৫ জন করে ইলেক্টর নির্বাচিত হবেন। ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য থেকে ১২ জন এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ৩ জন। এভাবে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন সংখ্যায় এবং কোনও কোনও রাজ্যে সর্বনিম্ন ৩টি পর্যন্ত ইলেক্টারাল ভোট আছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীর অর্ধেকেরও বেশি— কমপক্ষে ২৭০ জন ইলেক্টরের ভোট প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বা আইনসভাকে বলে কংগ্রেস। এটি দুই কক্ষবিশিষ্ট— নিম্নকক্ষকে বলে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ, আর উচ্চকক্ষকে বলে সেনেট।
প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন দুই বছরের জন্য। অন্যদিকে সেনেট সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছর এবং তারা তিন ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ, সেনেটরদের নির্বাচন হয় তিন ভাগে— প্রতি দুবছর পরপর সেনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনে ভোট হয়।
এবছর প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের সবগুলোতেই নির্বাচন হচ্ছে, আর সেনেট নির্বাচন হচ্ছে ৩৩টি আসনে।
বিশ্বের অনেক দেশের নির্বাচনেই দেখা যায় যিনি জাতীয়ভাবে মোট ভোটের হিসাবে বেশি ভোট পান তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবসময় তা নাও হতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা একই সঙ্গে অঙ্গরাজ্য-ভিত্তিক লড়াইয়েও ভোট দেন। এজন্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের জয়-পরাজয়ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ধারক ভূমিকা রাখে।
তাত্ত্বিকভাবে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও সাধারণত মূল নির্বাচন তথা পপুলার ভোটেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পাঁচবার এবং গত ২৪ বছরে দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাতীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাওয়া প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হিলারি ক্লিনটন— যিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনে জাতীয়ভাবে ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেলেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।
তার মানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে হলে একজন প্রার্থীকে আসলে একইসঙ্গে পপুলার ও ইলেক্টারাল দুধরণের ভোটেই জিততে হয়।
কোনও রাজ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পান, তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোটও পেয়ে যান। ৪৮টি রাজ্যেই এই নিয়ম। তবে দুটি রাজ্যের ক্ষেত্রে শুধু এর ব্যতিক্রম আছে।
উদাহরণত, ২০২০ সালের নির্বাচনে ক্যালিফোর্নিয়ায় জো বাইডেন পেয়েছেন ১ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ৬৩৯টি পপুলার ভোট। ট্রাম্প পেয়েছেন ৬০ লাখ ৬ হাজার ৫১৮ ভোট। তার মানে জো বাইডেন বিজয়ী হন। সেসময় এই রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা ছিল ৫৫টি। পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ায় বাইডেন এই ৫৫টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই পেয়ে যান। আর ট্রাম্প পান ০ ইলেক্টোরাল ভোট।
অন্যদিকে, টেক্সাসে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৪৭ পপুলার ভোট। আর জো বাইডেন পেয়েছেন ৫২ লাখ ৫৯ হাজার ১২৬ ভোট। তার মানে ট্রাম্প বিজয়ী হন। সেসময় এই রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩৮টি। পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ায় ট্রাম্প এই ৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই পেয়ে যান। আর বাইডেন পান ০ ইলেক্টারাল ভোট।
এভাবে একেকটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট যোগ হতে হতে যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে যান— তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হিসাবে ঘোষিত হন।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়ে ইলেক্টরদের নির্বাচন করেন, কিন্তু ব্যালটের মধ্যে সচরাচর ইলেক্টরদের নাম থাকে না, তার বদলে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম থাকে। তাদেরকে ভোট দিলেই তাদের মনোনীত ইলেক্টররাও নির্বাচিত বলে গণ্য হন। তবে, কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিও ব্যবহার করা হয়, যেমন, ৮টি অঙ্গরাজ্যের ব্যালটে ইলেক্টরদের নাম থাকে।
২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল তা হলো— তিনি নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো ডেমোক্র্যাটিক অধ্যুষিত এবং জনবহুল অঙ্গরাজ্যগুলোতে অনেক বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজ্যগুলোতে স্বল্পভোটের ব্যবধানে জয়ী হন, যার ফলে তিনি মোট ৩০৪টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যান। আর হিলারি ক্লিনটন পেয়েছিলেন মাত্র ২২৭টি ইলেকটোরাল ভোট।
যুক্তরাষ্ট্রে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে ব্যাপক সম্মানের চোখে দেখা হয়, কারণ এর সঙ্গে দেশটির রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই হয় ‘রিপাবলিকান’ আর নয়তো ‘ডেমোক্র্যাট’দের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তাই প্রার্থীরা প্রচারণার সময় এমন ১০-১২টি রাজ্যের দিকে বেশি মনোযোগ দেন, যেগুলো ঠিক নির্দিষ্ট কোনও দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নয় এবং যে কোনও দলের প্রার্থীই সেগুলোতে জিতে যেতে পারেন।
এগুলোকে বলা হয় সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্য। এদেরকে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ বা ‘যুদ্ধক্ষেত্র রাজ্য’ও বলা হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আসল লড়াই হয় এ রাজ্যগুলোতেই। এবার এমন রাজ্যের সংখ্যা ৭টি— অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থক্যারোলাইনা, পেনসিলভ্যানিয়া, উইসকনসিন। এই রাজ্যগুলোতে ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ৯৩টি।
স্মরণকালের মধ্যে এবারই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর মধ্যে এত আগ্রহ, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, গত দেড়শ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বজুড়ে অনেক কিছুই ওলটপালট করে দিতে পারে।
সিবিএস নিউজের এক জরিপে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ইস্যু অর্থনৈতিক সংকট। প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৮ জনই সিবিএস নিউজকে বলেছে, এবারের নির্বাচনে তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় অর্থনীতি।
বিবিসির এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নতুন প্রজন্মের (জেন জি) ভোটাররাও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
[পড়ার জন্য যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করুন]
কমলা হ্যারিস বলেছেন, তিনি ‘সুযোগের অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চান, যেখানে মধ্যবিত্তের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি কমানো, আবাসন উন্নয়নকে উৎসাহিত করা, প্রথমবারের মতো বাড়ির ক্রেতাদের অর্থ সহায়তা এবং নতুন বাবা-মার জন্য ট্যাক্স ক্রেডিট প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
হ্যারিস লাখ লাখ মধ্য ও নিম্ন-আয়ের পরিবারের জন্য কর কমানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি উদ্যোক্তা এবং ছোট ব্যবসার মালিকদের জন্য ট্যাক্স বিরতি সমর্থন করেন। তিনি টিপস তথা বখশিস থেকে আয়ের উপর ট্যাক্স বাতিল করার জন্য ট্রাম্পের একটি প্রস্তাবকেও সমর্থন করেন।
বাণিজ্যে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শক্তি বাড়ানোর জন্য কমলা হ্যারিসও বাইডেনের মতোই শুল্ক এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করবেন। অবকাঠামো এবং পুনর্নবায়নণযোগ্য জ্বালানি শক্তিতে বাইডেন প্রশাসনের উচ্চাভিলাষী বিনিয়োগের কথাও তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য তেল ও গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়ে জ্বালানি খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, শুল্ক বৃদ্ধি এবং গণ নির্বাসনের জন্য তার পরিকল্পনা আসলে খরচ বাড়াতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান হাতিয়ার উচ্চ সুদের হারের বিরুদ্ধেও ট্রাম্প সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টেরও একটি বক্তব্য থাকা উচিত, যা ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতি থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য তৈরি করে এমন কোম্পানিগুলোর জন্য কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ২১% থেকে কমিয়ে ১৫% করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাকেও তিনি কর ছাড় দেবেন।
ট্রাম্প নিজেকে ‘শুল্ক ব্যক্তি’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। তিনি একটি ক্ষয়িষ্ণু অটো শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা থেকে শুরু করে শিশুদের লালন-পালনের উচ্চ ব্যয় কমানো পর্যন্ত, শুল্ককে দেশের অগণিত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হিসাবে দেখেন।
তিনি কার্যত সমস্ত আমদানিতে ১০-২০% শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। সেইসঙ্গে চীন থেকে আনা পণ্যের উপর ৬০ শতাংশের বেশি শুল্ক চাপানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপ করে এমন যেকোনো দেশের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপের জন্য তিনি কংগ্রেসের কাছে কর্তৃত্ব চাইবেন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হওয়ার আগে থেকেই কমলা হ্যারিস নারীর প্রজননগত স্বাধীনতার অধিকারের একজন সোচ্চার প্রবক্তা ছিলেন। কমলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হতে পারলে তিনি গর্ভপাতের অধিকারের ওপর থেকে জাতীয়ভাবে সকল বিধি-নিষেধ তুলে দেবেন।
এ ছাড়া গর্ভনিরোধক ও ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) চিকিৎসা সুবিধা এবং যেসব রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ সেসব রাজ্যের নারীদের অন্য রাজ্যে গিয়ে গর্ভপাতের সুযোগ রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, গর্ভপাতের বিষয়টি অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। তবে তিনি জাতীয়ভাবে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করবেন না এবং আইভিএফ নারীদের জন্য ফ্রি করে দেবেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা অতীতে আইভিএফ সংক্রান্ত আইন বারবার আটকে দিয়েছে।
এ ছাড়া ট্রাম্প সমর্থক রক্ষণশীল থিংক ট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রকল্প-২০২৫ নামে ডানপন্থী শাসন মডেলের যে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছে তাতে মেইলে অর্ডারের মাধ্যমে গর্ভপাতের বড়ি কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়। এ জন্য ১৯ শতকের একটি আইন পুনরুজ্জীবিত করার কথাও বলা হয়েছে।
কমলা হ্যারিসও বাইডেনের মতোই ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের জন্য সরাসরি হুমকি হিসাবে দেখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এক পর্নস্টারকে ঘুষ দেওয়া লুকাতে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতি, ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি এবং পার্লামেন্ট ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার মতো বিষয়গুলো বারবার উল্লেখ করেন।
কমলা হ্যারিস আরও বলেছেন, গর্ভপাতের অধিকার বাস্তবায়নে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নে সকল জটিলতা তিনি দূর করবেন। এ ছাড়া কমলা হ্যারিস নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সকল ধরনের বাধা-বিপত্তি দূর করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প বারবারই ফের প্রেসিডেন্ট হতে পারলে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিবেন কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলেও ট্রাম্প কোনও উত্তর দেননি, যেনবা কারচুপি ছাড়া কেউ তাকে হারাতে পারবে না। পার্লামেন্ট ভবনে হামলকারীদেরও ক্ষমা করে দেবেন বলে জানান ট্রাম্প।
ট্রাম্প তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া, ডেমোক্রেট আইনজীবী, নির্বাচনী কর্মকর্তা, দাতা এবং এমনকি ভোটারদের বিরুদ্ধেও বিচার বিভাগ ব্যবহার করার হুমকি দিয়েছেন। এসব যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির একেবারেই বিপরীত। দেশটির ফেডারেল আইন প্রয়োগকারীকে অরাজনৈতিক বলে মনে করা হয়।
কমলা হ্যারিস সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং অবৈধ অভিবাসন বন্ধে কঠোর আইন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কমলা হ্যারিসকে অভিবাসনের মূল কারণ খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা তাকে সীমান্তের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে এবং বাইডেনের অভিবাসন নীতিকে অত্যধিক নমনীয় বলে অভিহিত করে। তবে কমলা এর দায় রিপাবলিকানদের দিকে ঠেলে দেন। কয়েকমাস আগে অবৈধ অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানে একটি কঠোর দ্বিদলীয় অভিবাসন বিল এনেছিল বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু রিপাবলিকানরা বিলটি আটকে দেয়।
কমলা হ্যারিস ব্যাপক অভিবাসন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বাস করা মানুষদের, বিশেষ করে যাদের শিশু অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়েছে তাদের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীন অবৈধ অভিবাসী নির্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। এ ছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করবেন।
ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের সকল আইনী সুরক্ষা প্রত্যাহার সহ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিল করার কথাও বলেন। অভিবাসীদের ওপর ‘মতাদর্শগত’ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াও আরোপ করবেন।
ট্রাম্প হাইতিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অসহায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি বর্ণবাদী ঘৃণাও ছড়ান। অ্যাডলফ হিটলারের প্রতিধ্বনি করে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীরা ‘আমাদের দেশের রক্ত বিষাক্ত’ করে তুলছে।
কমলা হ্যারিস বাইডেনের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মিত্রদের সঙ্গে এবং বিশেষ করে ন্যাটো জোটের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত করেছেন এবং দেশটির জন্য অদম্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কমলা বারবার পুতিনের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে, ট্রাম্প ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বাধ্য করবেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিও বাইডেন প্রশাসনের মতোই সমর্থন দিয়েছেন কমলা। যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও হ্যারিস বলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধেও নিন্দা জানান, যদিও এর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা এড়িয়ে যান। তিনি ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধান সমর্থন করেন, যেখানে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও থাকবে।
চীনের প্রতি বাইডেনের কঠোর নীতি অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত দিয়ে কমলা বলেছেন, তিনিও তাইওয়ানকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদী। তিনি বারবার বলেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন বিশ্ব আরও শান্তিপূর্ণ জায়গা ছিল, যুদ্ধ কম ছিল। তিনি দীর্ঘকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক জোট নিয়ে সংশয়বাদী। ন্যাটো তার অবজ্ঞার শীর্ষ টার্গেট হতে চলেছে।
তিনি একবার বলেছিলেন, ন্যাটো সদস্যরা জোটের ব্যয়ভার বহনে যথেষ্ট অর্থ না দিলে রাশিয়াকে তাদের দেশে আক্রমণ করতে ‘উৎসাহিত’ করবেন। ট্রাম্প ন্যাটো জোট থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সম্ভাবনা অস্বীকার করেননি, এমনকি ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি অন্যান্য জোট থেকেও সরে যেতে পারেন।
তার অনেক সমর্থক ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের বিরোধিতা করে। ট্রাম্পও বিষয়টির ‘মৌলিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি প্রথম দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। তবে তা কীভাবে সম্ভব হবে সে সম্পর্কে কোনও বিশদ বিবরণ দেননি।
কিন্তু ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভকারীদের প্রতিও ট্রাম্প আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি বলেন, বিদেশী ছাত্ররা যদি ইহুদি-বিরোধী বা আমেরিকা-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে তবে তিনি তাদের ভিসা বাতিল করবেন।
ট্রাম্প বলেছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের প্রতি তিনি আরও কঠোর হবেন, যদিও শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেছেন এবং চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করলে তিনি সেনা পাঠাবেন কিনা তা বলেননি।
কমলা হ্যারিস দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, জলবায়ু সংকট মানুষের কার্যকলাপের কারণেই সৃষ্ট এবং মানবজাতি ও পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। তার সরকারই ২০২২ সালে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইন পাশ করেছে।
এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জলবায়ু ও সবুজ জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বড় ফেডারেল বিনিয়োগ করা হয়— দশ বছরে প্রায় ৩৬৯ বিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে। আইনটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০০৫ সালের স্তর থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে কমলা হ্যারিস প্রগতিশীল গ্রিন নিউ ডিল প্রস্তাব থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। গ্রিন নিউ ডিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি বিস্তৃত প্রস্তাবনা। এতে কঠোর পরিবেশ আইন পাস করে ফ্র্যাকিং এবং অফশোর ড্রিলিং পদ্ধতিতে তেল-গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে তেল-গ্যাস উত্তোলন করলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসও বেরোয়, যা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।
কমলা বৈদ্যুতিক যানবাহনের একজন প্রবক্তা এবং সবুজ জ্বালানিতে ট্যাক্স ক্রেডিটকে সমর্থন করেন। এছাড়া জলবায়ু সংকটের প্রভাব থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জলবায়ু ন্যায়বিচার কর্মসূচিতে উৎসাহ দেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প প্রতিষ্ঠিত জলবায়ু বিজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। জলবায়ু সংকটকে ভুয়া এবং ব্যয়বহুল প্রতারণা বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, জলবায়ুর উষ্ণায়ন চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী নয়। ট্রাম্প যতবেশি সম্ভব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের সমস্ত বিধান উল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এর বিনিময়ে তেল কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে মে মাসে এক বৈঠকে ট্রাম্প তার নির্বাচনের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার সাহাজ্য চেয়েছেন।
তার প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যে পরিষ্কার বায়ু এবং পানির সুরক্ষায় করা প্রবিধান সহ অনেক পরিবেশগত নীতি বাতিল করেছিলেন। তিনি বিশেষ করে বায়ু শক্তির বিরোধী এবং মিথ্যাভাবে দাবি করেন যে, বায়ু টারবাইন পাখিদের হত্যা করে, ক্যান্সার সৃষ্টি করে এবং ‘তিমিদের পাগল করে’।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিবিএস নিউজ
সম্প্রতি সাময়িকী ফরেন পলিসিতে ‘দ্য কমলা হ্যারিস ডকট্রিন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কমলার ভূমিকা ও সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আলোচনার ক্ষেত্রে ফরেন পলিসি যুক্তরাষ্ট্রের এক ডজনেরও বেশি বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, কংগ্রেস কর্মী, বিশেষজ্ঞ ও কমলার সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে। কমলার সঙ্গে যারা পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে কাজ করেছেন, তাদের সঙ্গেও কথা হয়।
তাদের কাছ থেকে ফরেন পলিসি কমলার পররষ্ট্রনীতি-বিশেষ করে চীন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য অঞ্চল সম্পর্কে তার ভাবনা জানতে চেয়েছে। নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
[পড়ার জন্য যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করুন]
চীন প্রশ্নে কমলার ট্র্যাক রেকর্ড বাইডেনের তুলনায় কম। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২০ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এছাড়া ২০২২ সালে ব্যাংককে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনোমিক কো-অপারেশন শীর্ষ সম্মেলনে শি-কমলার মুখোমুখি হওয়ার রেকর্ডও আছে। সেবার কমলা শিকে অভ্যর্থনাও জানিয়েছিলেন।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলার একটি বড় অভিজ্ঞতা হলো, তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র জোটকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় সফর করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তিনবার সফর করেছেন।
ফিলিপাইনে সফরের সময় তাকে থামতে হয়েছিল দেশটির পালাওয়ান দ্বীপপুঞ্জে। তখন তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সঙ্গে বৈঠক করে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিশ্রুতি অটুট’ থাকার কথা বলেন। এই অঞ্চলের বৈঠকগুলোতে তিনি বাইডেনের সুরেই কথা বলেছেন। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বরে ইউএস-অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এয়িশার নেশনসের শীর্ষ সম্মেলনে তার বক্তব্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে কমলা চীনের সামনে নিজের যে অবস্থান তুলে ধরেছিলেন, তা গত চার বছরে হোয়াইট হাউসের নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে আছে প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার নীতি।
তবে কমলার দৃষ্টিভঙ্গি একটি ক্ষেত্রে বর্তমান নীতি থেকে ভিন্ন ছিল। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন শুল্কের সমালোচনা করেন। অতীতেও তিনি নিজেকে ‘রক্ষণশীল ডেমোক্র্যাট’ নন বলে দাবি করেছিলেন।
যাই হোক, বাইডেন প্রশাসন কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বজায় রেখেছে। ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেনসহ অনেক ডেমোক্র্যাট যারা আগে শুল্কবিরোধী ছিলেন, তারাও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও মহামারীর কারণে নিজেদের অবস্থান বদলেছেন।
সেনেটর ও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা সবসময় মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ও আরও ৫৫ জন সেনেটর যৌথভাবে হংকং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র আইনটি প্রণয়ন করেন। এই আইনের মাধ্যমে হংকংয়ে বিতর্কিত প্রত্যর্পন বিলের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
পরবর্তীতে তিনি চীনের শিনজিয়ান অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একই ধরনের নিয়ম প্রয়োগের জন্য একটি আইন যৌথভাবে প্রণয়ন করেন। তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকেও শিনজিয়ানে চীন সরকারের জন্মহার সীমিত করার চেষ্টার বিবরণী প্রকাশিত হওয়ার পর আরও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তার দৃষ্টিভঙ্গি বাইডেন প্রশাসনের নীতিরই প্রতিফলন, যা চীনের মানবাধিকারের বিষয়ে কঠোর হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন নীতির ক্ষেত্রে তার অবস্থান বাইডেনের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন হবে না।
বাইডেন প্রশাসনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব অনেক। ওয়াশিংটন দেশটিকে চীনের বিরুদ্ধে প্রধান ভারসাম্য রক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মূল অংশীদার হিসেবে দেখছে। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সেসময় উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি হয়। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহায়তাকে উভয় দেশের সম্পর্কের স্তম্ভ বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত নিয়ে কমলার নীতি বাইডেনের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক কয়েক দশক ধরে নির্ভরযোগ্যভাবে দ্বিপক্ষীয় সমর্থন পেয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের আমলেও।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে ভারতের সঙ্গে কমলার মতো আর কারও ব্যক্তিগত সংযোগ নেই। তার মা শ্যামলা গোপালন ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন। হ্যারিস বারবার তার জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর মায়ের প্রভাব কতটা গভীর ছিল তা উল্লেখ করেছেন। তবে রাজনৈতিকভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে মায়ের কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।
উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ফরেন পলিসির সাউথ এশিয়া ব্রিফের লেখক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, “অবশ্যই, ভারতের সঙ্গে কমলার পূর্বপুরুষের সম্পর্ক এমন কিছু, যা তিনি ভারতের প্রতি তার নিজস্বতা প্রকাশে ব্যবহার করতে পারেন। তবে ভারতের নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তার ও বাইডেনের মধ্যে সত্যিই কোনও ফারাক থাকবে না।”
অতীতে ভারতের প্রতি বাইডেনের তুলনায় হ্যারিসের অবস্থান ছিল কঠোর। বিশেষ করে কাশ্মীর প্রসঙ্গে মোদী সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সেনেটর থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ওয়াশিংটনে একাধিক বৈঠকের সময় তিনি আরও সূক্ষ্মভাবে এর সমালোচনা করেছিলেন।
তবে তিনি প্রেসিডেন্ট হলে এই সমালোচনা কিছুটা নমনীয় হতে পারে। কুগেলম্যানের মতে, “আমি মনে করি না তিনি মানবাধিকার বিষয়ে বাইডেনের চেয়ে কঠোর হবেন। অথবা অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থকে গুরুত্ব দেবেন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে অতিরিক্ত কঠোর অবস্থান নেবেন না।”
হ্যারিসের বয়স এবং তার তরুণ অনলাইন-ভিত্তিক সমর্থকদের কারণে তিনি অস্বস্তিকর আলোচনায় অংশ নিতে আরও ইচ্ছুক হতে পারেন। হাডসন ইনস্টিটিউটের ইন্ডিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক অপর্ণা পান্ডে বলেন, “তিনিও ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিবিদের পরবর্তী প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রজন্ম থেকে নন। তরুণ আমেরিকানরা, যারা দলের ভবিষ্যত ভিত্তির একটি বড় অংশ গঠন করে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বিশ্বব্যাপী অন্যায়ের বিষয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। হ্যারিসের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের বামপন্থী অংশ, অর্থাৎ প্রগতিশীল দলের অন্তর্ভুক্ত। তাই তার কাছে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
বিস্তৃত অঞ্চলের প্রশ্নে কমলা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একাধিকবার সফর করেছেন। তিনি বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অন্যতম মুখ। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় এটি তাকে কতটা প্রভাবিত করবে তা স্পষ্ট নয়। বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি ছিল আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। এই প্রত্যাহারের ফলে দেশটিতে তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসে।
ট্রাম্প তার প্রথম বিতর্কের সময় বাইডেনের সমালোচনা করতে ওই ঘটনাটিকে ব্যবহার করেছিলেন। কমলার বিপক্ষেও তিনি একই কাজ করতে পারেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা লিসা কুর্টিস বলেন, “আফগানিস্তান ইস্যুতে কমলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা রিপাবলিকানদের জন্য কঠিন হবে। এটা পরিস্কার যে, আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ছিল বাইডেনের নিজের সিদ্ধান্ত।”
কমলা প্রেসিডেন্ট হলে আফগানিস্তান তার জন্য পররাষ্ট্রনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে।
এবিষয়ে কুর্টিস বলেন, “একজন নারী হিসেবে, আমরা আশা করতে পারি কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে আফগান নারীদের সমর্থনে আরও বেশি মনোযোগ দেবেন। আমি মনে করি, আফগানিস্তানে নারীদের সঙ্গে যা ঘটছে তা উপেক্ষা করা তার পক্ষে কঠিন হবে। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ যেটি নারী ও মেয়েদের শিক্ষার অধিকার অস্বীকার করে।”
কমলা সেনেটে বা ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কখনোই বাণিজ্য বিষয়ে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন না। তবে সেনেটের হিসেবে ও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি শ্রমিক ও পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে সচেতন বাণিজ্যের পক্ষে ছিলেন। এটি আজকের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নীতির সঙ্গে মানানসই। এখানেই ট্রাম্প ও তার সঙ্গী ওহাইওর সেনেটর জে ডি ভান্সের অবস্থানের সঙ্গে কমলার পার্থক্য।
কমলা হ্যারিস সবসময় ট্রাম্পের শুল্কনীতির সমালোচনা করেছেন। তিনি সেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা ও ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত কর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই শুল্কের কারণে বাণিজ্য সহযোগিদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং দেশে আরও বেশি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়।
কিন্তু সেই সময় বাইডেনও প্রায় একই মত পোষণ করেছিলেন এবং পরে ট্রাম্পের অনেক শুল্ক বজায় রাখেন। এমনকি তিনি নিজেও কিছু নতুন শুল্ক আরোপ করেন। যদিও সেগুলো ছিল নির্দিষ্ট খাতকে সুরক্ষা দিতে। সম্ভবত রক্ষনশীলতার প্রবণতা উভয় দলের মধ্যে এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে, আমদানি শুল্কের মতো আত্মবিধ্বংসী নীতিগুলো থেকেও কোনো প্রার্থী সহজে মুক্ত হতে পারছেন না।
বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে কমলার অবস্থান কিছুটা জটিল। তিনি জানিয়েছেন, তিনি নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের (নাফটা) বিরোধীতা করতেন। এটি ছিল রেগান-বুশ যুগের এক রিপাবলিকান পরিকল্পনা, যা এখন রিপাবলিকানদের জন্যই ভীতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমলা ট্রাম্পের সংস্কার করা নাফটা চুক্তিরও বিরোধীতা করেছিলেন।
তার মতে, কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে এই চুক্তিটি শ্রম ও পরিবেশগত সুরক্ষা দিতে পারেনি। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাক্ষরিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) বিরুদ্ধেও একই আপত্তি তুলেছিলেন। পরবর্তীতে এই চুক্তিটি উভয় দলের জন্য অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং ট্রাম্প ক্ষমতায় বসে প্রথম সপ্তাহেই সেটি বাতিল করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ রাজনীতিকের মতোই কমলাও চীনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি ও বাণিজ্যে প্রতারণার অভিযোগ তোলেন। তবে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের মতো তিনিও এবিষয়ে জোর দিয়েছেন যে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যা – যেমন উত্তর কোরিয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা সমাধানে বেইজিংয়ের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।
বাইডেন তার প্রতিনিধি হিসেবে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ও ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কমলাকে পাঠিয়েছিলেন।
কমলার ট্রান্স-আটলান্টিক রেকর্ড বাইডেনের মতো নয়। তবে তিনি ৩ বছর ধরে মিউনিখে নিজেদের সব প্রত্যাশিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান আস্থাভাজন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখে এক ভাষণে বলেছিলেন, “ন্যাটোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ‘অটল’ ও ‘অখণ্ডনীয়’।” বক্তব্যটি ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার অভিযানের ৫ দিন আগে দেওয়া হয়। ভাষণে কমলা আরও বলেন, “ট্রাম্পের অস্বীকার করা ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ এর আত্মরক্ষার প্রতিশ্রুতি আসলে ‘পবিত্র’।”
২০২৩ সালে তিনি মিউনিখে গিয়ে ন্যাটোর বিষয়গুলো নিয়ে একই ধরনের আলোচনা করেন। সেখানে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলেন, “বাইডেন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যুদ্ধে রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।”
বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারাভিযান শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে কমলা সুইজারল্যান্ডে ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনে বাইডেনের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন। সেখানে তিনি একটি “ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির” আহ্বান জানান।
ক্রেমলিন এখনও কমলার প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিয়ে নীরব রয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, “ভাইস প্রেসিডেন্টের ভাষা ‘অবন্ধুত্বপূর্ণ’।” তবে রাশিয়া এখনও তার প্রার্থিতার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম অবশ্য কমলাকে আক্রমণ শুরু করেছে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির বৈশ্বিক রাজনীতি বিভাগের ডিন আন্দ্রে সিদরভ রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সাপ্তাহিক টক শোতে বলেন, “কমলার হাতে পারমাণবিক বোতাম একটি গ্রেনেডের সঙ্গে বানরের চেয়ে আরও বিপজ্জনক।”
নভেম্বরের নির্বাচনে জিতলে কমলা উত্তরাধিকারসূত্রে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে হামাস-ইসরায়েল সংকট নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন।
পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের মতোই, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে হ্যারিসের অভিজ্ঞতা বাইডেনের তুলনায় কম। বাইডেন যখন ওভাল অফিসে প্রবেশ করেন, তখন পররাষ্ট্রনীতিতে তার অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন মধ্যস্থতার সাবেক উপদেষ্টা ডেভিন মাকোভস্কির মতে, হ্যারিসের ভোটের রেকর্ড ও তার বক্তৃতা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি গাজা যুদ্ধ বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনবেন না। ধারাবাহিকতাই বজায় থাকবে।
২০২৩ সালের জুনে কমলা ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তিনি সেখানে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘অটল’ প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা সহায়তায় সমর্থন দেওয়ার জন্য সেনেটে তার ভোটের রেকর্ড তুলে ধরেন। একই সঙ্গে, তিনি ইহুদি বিদ্বেষের কারণে ইসরায়েলকে আলাদা করে টার্গেট করার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন।
গত বছর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর থেকে কমলা মূলত বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে সমর্থন করছেন। এই নীতি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে কথা বলে। তবে এই নীতিতে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কঠোরতার সমালোচনা ধীরে ধীরে বেড়েছে। একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে কথার দিক থেকে অন্তত কিছু ভিন্নতা দেখা গেছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো ও এফপি কলামিস্ট স্টিভেন কুক বলেন, “কখনো কখনো তিনি (কমলা) প্রেসিডেন্টের চেয়ে ইসরায়েলের প্রতি বেশি সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েছেন।”
কমলা তার প্রকাশ্য বিবৃতিতে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। গত বছরের শেষের দিকে শুরু হওয়া মিডিয়া রিপোর্টগুলোতে বলা হয়েছে, তিনি হোয়াইট হাউসকে মানবিক সংকট নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশে চাপ দিয়েছেন। তবে বাইডেন প্রশাসন এই প্রতিবেদনগুলো অস্বীকার করেছে।
গেল ডিসেম্বরে দুবাইয়ে এক বক্তৃতায় কমলা ইসরায়েলে হামাসের আক্রমনের নিন্দা জানান। তবে একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে গাজার বেসামরিকদের সুরক্ষায় আরও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। আর মার্চে আলাবামার সেলমাতে দেওয়া বক্তৃতায়, তিনি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান যাতে জিম্মিদের মুক্তি ও গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়। তার বক্তব্য বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তবে তার আবেগপূর্ণ উপস্থাপনা শ্রোতাদের বিপুল করতালি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনার সাবেক বিশেষ দূত ফ্র্যাংক লোয়েনস্টাইন বলেন, “হ্যারিসের নীতি মূলত বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতা হতে পারে, তবে তার বক্তব্যের সুর বাইডেনের চেয়ে ভিন্ন। যারা তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন, তারাও এ ধারণা সমর্থন করেন।”
হোয়াইট হাউসে গত ২ এপ্রিল মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে গাজার নীতি বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিরিয়-আমেরিকান চিকিৎসক জাহের সাহলুল জানান, কমলা হ্যারিস তাদের উপস্থাপনা দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি গাজায় যুদ্ধের মানুষের উপর প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। বৈঠকের পর কমলা তার কাছে গিয়ে মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে আরও প্রতিবেদন চান।
সাহলুল বলেন, “আমি মনে করেছিলাম যে তিনি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে গাজায় বেসামরিক মানুষের কষ্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। যদিও তিনি বাইডেনের নীতির থেকে ভিন্ন ছিলেন না, তবে গাজা সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি তার বর্ণনায় পরিষ্কার ও বিস্তারিত ছিল।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকের পর কমলা হ্যারিস বেশ দৃঢ় কণ্ঠেই কথা বলেন। তিনি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে গাজা সম্পর্কে বলেন, “আমরা নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি অনুভূতিহীন হতে পারি না। আমি নীরব থাকব না।”
নির্বাচনে কমলা জিতলে জানুয়ারিতে তিনি দায়িত্ব নেবেন। তখন পর্যন্ত গাজা যুদ্ধের পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হতে পারে। সেখানকার পরিস্থিতি এখনও হতাশাজনক হলেও, যুদ্ধের প্রকৃতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। মাকোভস্কি মনে করেন, কমলা বাইডেনের মতোই গাজা পরিস্থিতি সামলান কিনা তাই দেখার বিষয়।
২০২২ সালে ওয়াশিংটনে ইউএস-আফ্রিকা নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি পরবর্তী বছরে আফ্রিকা সফর করবেন। তবে তিনি সেই সফর করেননি। গত মে মাসে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর রাষ্ট্রীয় সফরের সময় বাইডেন বলেছিলেন, তিনি পুনরায় নির্বাচিত হলে ফেব্রুয়ারিতে আফ্রিকা সফর করবেন। মজার বিষয় হলো, এখন তিনি নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
আফ্রিকান নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অন্যান্য ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তুলনায় গৌণ হয়ে পড়েছে। বাইডেনের প্রত্যাশিত সফর বাতিলের ধাক্কা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় সাব-সাহারান আফ্রিকায় কখনও না যাওয়ার কারণে আরও তীব্র হয়েছে। ট্রাম্প একবার আফ্রিকার কিছু দেশকে ‘শিটহোল কান্ট্রিস’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বাইডেন টিম ট্রাম্পের থেকে নিজেদের আলাদা করতে ইউএস-আফ্রিকা নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে এবং নিয়মিতভাবে আফ্রিকায় বাইডেনের মন্ত্রিসভার সদস্যদের পাঠায়। কমলা ছিলেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, যিনি গত বছর ঘানা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়া সফর করেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, কমলার নেতৃত্বাধীন হোয়াইট হাউস বাইডেনের আফ্রিকা নীতির মতো একই কৌশল নিতে পারে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা আফ্রিকায় গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বৃদ্ধি নিয়ে আগের মতোই কথা বলতে পারেন। অথচ মহাদেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ব্যাপক পতন হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে রাশিয়া ও চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাবও বাড়ছে।
তবে, হ্যারিস প্রশাসনকে আফ্রিকান নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে এই বিষয়ে নিশ্চিত করতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকার সঙ্গে সহযোগিতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা শুধুমাত্র কথায় বলা নয়, বাস্তবেও প্রতিফলিত হবে।
কিছু সমালোচক বাইডেন প্রশাসনের আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রচারের কথাকে ফাঁকা বুলি হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, এই প্রশাসন একটি দীর্ঘ ও কম গর্বের পররাষ্ট্র নীতির ঐতিহ্য অনুসরণ করছে। এতে অস্থির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন না দিয়ে স্বৈরশাসনের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকায় একের পর এক অভ্যুত্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের অকার্যকর সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাগুলি সাহেল অঞ্চলকে আরও স্বৈরশাসক, সন্ত্রাসের প্রতি সংবেদনশীল ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সহযোগিতার পথ বেশি উন্মুক্ত করেছে।
এসব সমস্যার মধ্যেও কমলা হ্যারিসের সময় ইউএস-আফ্রিকা সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক দিক থাকতে পারে। বাইডেন প্রশাসনের ব্যবসা ও অবকাঠামো সম্পর্ক সম্প্রসারণের উপর জোর দেওয়ার ফলে প্রায় ১৪.২ বিলিয়ন ডলারের নতুন দ্বিমুখী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় বড় পতনের পর আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিনিয়োগ আবার বাড়ছে।
বাইডেন টিম শেষ পর্যায়ে সুদানের যুদ্ধে শান্তি আলোচনা শুরুর একটি শেষ চেষ্টা করছে। দেশটিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থ চেষ্টার পরেই সেখানে যুদ্ধ লাগে। তবে এই আলোচনা কেমন হবে তা স্পষ্ট নয়। আর এক্ষেত্রে কমলার প্রশাসনকে আফ্রিকায় রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
অভিবাসন হলো পররাষ্ট্রনীতির এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে কমলার সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে সবচেয়ে সহজে অনুমান করা যায়। কারণ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
রিপাবলিকানরা কমলাকে বাইডেন প্রশাসনের ‘সীমান্ত জার’ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাকে তার ব্যর্থতার জন্য আক্রমণ করেছেন। যেমন দক্ষিণ ক্যারোলাইনার সাবেক গভর্নর নিকি হ্যালি কমলাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সীমান্ত ঠিক কর”।
অবশ্য অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, কমলার দায়িত্বের পরিসর অনেক সীমিত ছিল। তাকে কখনও বাইডেন প্রশাসনের ‘সীমান্ত জার’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়নি।
বাস্তবে কমলাকে মধ্য আমেরিকার দেশ-হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা ও এল সালভাদরে বাইডেন প্রশাসনের উদ্যোগগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং অভিবাসনের ‘মূল কারণ’ যেমন অর্থনৈতিক কষ্ট, সহিংসতা ও রাজনৈতিক দমনপীড়ন মোকাবেলা করতে বলা হয়েছিল।
ইউএস ইমিগ্রেশন এবং ন্যাচারালাইজেশন সার্ভিসের প্রাক্তন কমিশনার এবং বর্তমানে মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ডোরিস মেইসনার বলেন, “হ্যারিসকে মূলত ওই দেশগুলোর বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে একটি উদ্যোগ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে মূল কারণগুলো কমানো যায়।”
এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কমলা তিনটি দেশে ৫.২ বিলিয়নেরও বেশি বেসরকারি খাতের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। হোয়াইট হাউজের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিশ্রুতিগুলি ৫০টিরও বেশি কোম্পানি ও সংস্থা থেকে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে মেটা, এল সালভাদরের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ব্যাংকো কাস্কাটলান ও টার্গেট।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২১ সালে কমলা প্রথমবারের মতো গুয়াতেমালায় যান। সেখানে তিনি সম্ভাব্য অভিবাসীদের জন্য একটি কঠোর সতর্কতা দেন।
তিনি বলেন, “আমি এই অঞ্চলের মানুষদের স্পষ্ট করতে চাই যারা যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে বিপজ্জনক যাত্রা করতে চাইছেন: আসবেন না, আসবেন না।” তখন এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছিল কিছু প্রগতিশীল ও অভিবাসী সমর্থক গোষ্ঠী।
বাইডেন প্রশাসন দক্ষিণ সীমান্তে যে সমন্বিত পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তা কমলার সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়। অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা জুন মাসে তিন বছরের নিম্ন মাত্রায় নেমে এসেছে। এর কারণ বাইডেন একটি বিতর্কিত নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত সংখ্যক অভিবাসী সীমান্ত অতিক্রম করার সময় আশ্রয় চাওয়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এভোকেসি গ্রুপগুলো নির্বাহী আদেশটির সমালোচনা করেছে। এসিএলইউ বলেছে, “এটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেওয়া সবচেয়ে সীমাবদ্ধ সীমান্ত নীতি। এটি ২০১৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার প্রতিধ্বনি।”
মেইসনারের মতে, “বাইডেন প্রশাসন কার্যকর আইন প্রয়োগের নীতি স্থাপন করতে খুব কঠোর চেষ্টা করেছে। তবে তারা মনে করে, আমরা একটি অভিবাসনকারী দেশ। তারা এমন নীতিগুলি তৈরি করতে চায় যা অভিবাসন অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু সেই ভারসাম্যটি এখনও স্পষ্ট নয়।”
তথ্যসূত্র : ফরেন পলিসি।
এতো সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক ভোটার কেন এখনো দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেন?
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফথ অ্যাভিনিউতে চাইলে যে কাউকে গুলি করতে পারেন এবং এর জন্য তাকে একটি ভোটও হারাতে হবে না। তারপর থেকে ভোটারদের একটি বিশাল অংশের উপর তিনি যে অটুট সমর্থন বজায় রেখেছেন তা দেখে অগণিত পর্যবেক্ষক হতবিহ্বল হয়ে গেছেন।
ট্রাম্পের সমালোচকরা তার অযোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে যেসব বিষয় সামনে আনেন তার মধ্যে রয়েছে— প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে দুবার অভিশংসন প্রস্তাব, রাজ্য ও ফেডারেল স্তরে একাধিক অপরাধমূলক অভিযোগ এবং ফৌজদারি অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া। বিরোধীরা ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি মনে করেন। এছাড়া ট্রাম্প নারীবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, সিরিয়াল মিথ্যাবাদী এবং ধর্ষক তকমাও পেয়েছেন।
বিভিন্ন সময় জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ঝোঁক আছে এমন স্বাধীন ভোটাররা বলেছেন, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে ট্রাম্প আইন ভঙ্গ এবং অগণতান্ত্রিক আরচণ করেছেন। অথচ অর্ধেকেরও কম রিপাবলিকান ভোটার মনে করেন, এটা করে ট্রাম্প ভুল বা অপরাধ করেছেন। বিপরীতে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রিপাবলিকানের মতে, ট্রাম্প ভুল করেননি এবং তিনি ভুল করতেও পারেন না। এমনকি ট্রাম্প নিজেও নিজেকে সেভাবেই দেখেন। ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, তিনি খারাপ নন বরং ভালোর শক্তি।
[পড়ার জন্য যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করুন]
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স ইউনিভার্সিটি-নেওয়ার্ক এর নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ জেনোসাইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর ডিরেক্টর আলেকজান্ডার হিন্টন গভীর অনুসন্ধান চালান। তিনি রাটগার্স-নেওয়ার্ক সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব পলিটিকস অ্যান্ড রেস ইন আমেরিকারও গবেষক।
শান্তি ও সংঘাত বিষয়ক এই নৃবিজ্ঞানী ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের চিন্তার জগতকে নাম দিয়েছেন ট্রাম্পিভার্স বা ট্রাম্পবিশ্ব। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে যখন ট্রাম্প একটি সোনালি এস্কেলেটর থেকে নেমে তার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতা ঘোষণা করেছিলেন, তখন থেকেই তিনি ট্রাম্পবিশ্বের ওপর নজর রাখা শুরু করেন। পরে ২০২১ সালে এ সম্পর্কিত একটি বই লেখেন, যার নাম ‘ইট ক্যান হ্যাপেন হিয়ার’।
হিন্টন ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের বিভিন্ন সভা-সামবেশ ও বৈঠকে অংশ নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ট্রাম্পের গোঁড়া সমর্থক থেকে শুরু করে মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের সঙ্গেও কথা বলেন।
হিন্টন বলেন, শুধু জাতিবিদ্বেষী বা বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গরাই ট্রাম্পের ভোটার নন, ডেমোক্রেটরা যেমনটা অভিযোগ করেন। তবে এটা সত্য যে, ট্রাম্পের বেশিরভাগ ভোটারই বয়স্ক, শ্বেতাঙ্গ, গ্রামীণ, ধর্মীয় এবং স্বল্প শিক্ষিত। কিন্তু এদের বাইরেও ট্রাম্পের অনেক ভোটার আছেন, যারা নির্বাচনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেন।
এদের অনেকের কাছেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার জন্য চিন্তাশীল কারণ রয়েছে, যদিও তাদের যুক্তিগুলো প্রায়ই জনতুষ্টিবাদী ও বিভাজনকারী এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়েও দেখানো হয়। হিন্টন ট্রাম্প সমর্থকদের যুক্তির পাঁচটি ধরন চিহ্নিত করেছেন:
১. গণমাধ্যমের তথ্য বিকৃতি ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
ট্রাম্পের অনেক সমর্থকের মতে, বামপন্থী ঝোঁক থাকা গণমাধ্যম ট্রাম্পের প্রতিটি শব্দের শবব্যবচ্ছেদ করে এবং বিকৃতও করে। এর মধ্যদিয়ে তারা ট্রাম্পের প্রতি আবেগপ্রবণ এবং অযৌক্তিক অপছন্দ তৈরি করে।
কট্টর ট্রাম্প সমর্থকরা, সিএনএন এর মতো গণমাধ্যমগুলোকে ‘ভুয়া খবর’ প্রচারকারী এবং জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করার জন্য ফেডারেল সরকারের একটি বৃহত্তর গভীর রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের অংশ হিসাবে দেখেন। এই ষড়যন্ত্রে শুধু বামপন্থী, সরকারী আমলা এবং ছদ্মবেশি রিপাবলিকানরাই নয় বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যক্তিরাও জড়িত। তারা মনে করেন, ট্রাম্পকে ষড়যন্ত্র করে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হয়।
২. টেবিলে রুটি, ব্যাংকে টাকা
“আপনি কি চার বছর আগের চেয়ে ভালো আছেন?” ট্রাম্পের অনেক ভোটারের কাছে রোনাল্ড রিগানের এই বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট— ‘না’। তারা ট্রাম্পের সময় কর কমানো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্টক মার্কেটের রমরমা অবস্থাকে সঠিকভাবে মনে রেখেছেন।
এটা সত্য যে জো বাইডেনের সময় সামগ্রিক কর্মসংস্থান সংখ্যা এবং গড় বেতন বেড়েছে। কিন্তু ব্যাপক মূল্যস্ফীতি তার সেই সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। বাইডেনের সময় মূল্যস্ফীতি প্রায় ২০ শতাংশে উঠেছিল। যদিও মূল্যস্ফীতির হার সম্প্রতি কমেছে, কিন্তু এখনোও জিনিসপত্রের দাম বেশি। ভোটাররা প্রতিদিন মুদি দোকানে গেলেই তাদের ট্রাম্পের কথা মনে পড়ে।
জরিপগুলোতেও দেখা গেছে, ভোটাররা মনে করেন, কমলা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্প অর্থনীতি বেশি ভালোভাবে চালাতে পারবেন।
৩. সীমান্ত আগ্রাসন
মুল্যস্ফীতির মতো বাইডেনের আমলে অবৈধ অভিবাসনও বেড়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসন মেক্সিকো সীমান্তে আশ্রয়ের জন্য আবেদন কঠিন করলে, গত জুনে অবৈধ অভিবাসন অনেক কমে আসে।
তথাপি রিপাবলিকানরা মনে করে, নিজেদের ভোট বাড়ানোর জন্যই ডেমোক্রেটরা অভিবাসন নীতি সহজ করে দেশে অশ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা বাড়ায়। এ ছাড়া তাদের আশঙ্কা, অভিবাসীরা তাদের জীবন-জীবিকায়ও ভাগ বসাবে।
ট্রাম্প তাদের এই আতঙ্ককে পুঁজি করার জন্য সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ এবং ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
৪. ট্রাম্প আমলের ভালো রেকর্ড
শুধুমাত্র অর্থনীতি ও অভিবাসন নয়, আরও অনেক কিছুতেই ট্রাম্পের সময় পরিস্থিতি ভালো ছিল। ট্রাম্পের সময় কোনও নতুন যুদ্ধ হয়নি। বিপরীতে, বাইডেন-কমলা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের সঙ্গে জড়িত।
ট্রাম্প সমর্থকদের ধারণা, এসব যুদ্ধের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কর থেকেই আসে। যদিও অন্যান্য দেশও ইউক্রেনকে অর্থ দিচ্ছে এবং ইসরায়েল আসলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনছে।
ট্রাম্প সমর্থকরা আরও মনে করেন যে, চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং হুমকি মোকাবেলার জন্য তিনিই বেশি উপযুক্ত।
৫. বামপন্থী সর্বনাশ থেকে রক্ষাকর্তা
ডেমোক্রেটরা গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে শালীনতা ধ্বংসের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও ট্রাম্পের ভোটাররা তাকে ত্রাণকর্তা হিসাবেই দেখেন। তারা মনে করেন ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিপ্লবী বামপন্থীদের খপ্পর থেকে রক্ষা করবেন।
তাদের কাছে ‘মেইক অ্যামেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ কেবল একটি স্লোগান নয় বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রকে কমিউনিস্টদের হাত থেকে বাঁচানোর একটি আন্দোলন, ট্রাম্প না থাকলে যা ব্যর্থ হবে।
যুক্তরাজ্যের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রয়্যাল সোসাইটি অফ এডিনবার্গ ও ব্রিটিশ একাডেমির একজন ফেলো স্টিফেন রেইশার একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
তার মতে, সর্বজনীন নেতা বলে কিছু নেই। নেতারা সবসময় একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে— কোনও রাজনৈতিক দল, ধর্ম বা সামাজিক আন্দোলনের। গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা তাদের নেতাকে নিঃশর্তভাবেই ভালবাসে, যা বাইরের লোকদের কাছে অনেক সময় উদ্ভট এবং ব্যাখ্যাতীত বলে মনে হয়। এমনকি তাদের ভক্ত অনুসারীদেরকে কোনো না কোনোভাবে প্রতারিত বা নির্বোধ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে এমন সবচেয়ে বড় রহস্যটি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে বিরাজ করছে। তিনি এমন একজন মিথ্যাবাদী এবং সিরিয়াল ব্যাভিচারী যাকে রক্ষণশীল ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরাও সমর্থন করে; এমন একজন অপরাধী যাকে ‘আইন-শৃঙ্খলা’ রক্ষাকারীরা সমর্থন করেন; এমন একজন লম্পট পুরুষ যিনি অনুমতি ছাড়া নারীদের গায়ে হাত দিয়ে গর্ব করেন এবং শ্বেতাঙ্গ নারী ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হন; এমন একজন বিলিয়নেয়ার যিনি তার নিউ ইয়র্কের আকাশচুম্বী ভবনের সোনালি লিফটে পোজ দিতে পছন্দ করেন, আবার শ্রমিক শ্রেণীর ত্রাণকর্তা হিসেবেও পোজ দেন। একই সঙ্গে এতো বৈপরীত্য কীভাবে ধারণ সম্ভব?
বাইরে থেকে দেখলে বিষয়টি উদ্ভটই মনে হবে। কারণ বাইরে থেকে, তাদের সাধারণত ভিন্ন গোষ্ঠী এবং পরিচয়ের (ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণী) ভিত্তিতে দেখা হয়। তারা অনুমান করে, উদাহরণ স্বরূপ, নারীরা নারীদের স্বার্থের ভিত্তিতে নারী হিসাবেই ভোট দেন। কিন্তু ট্রাম্পের অনুসারীরা এবং ট্রাম্প নিজেই তাদের স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করে এমন দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিচয় বিবেচনায় রাখে না। অর্থাৎ, তারা কীভাবে বিশ্বকে ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ এভাবে বিভক্ত করে ভাবেন সেটা বিবেচনা করে না।
স্টিফেন রেইশার বলেন, দক্ষ নেতার শুধুমাত্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা যে গোষ্ঠীগুলোকে নেতৃত্ব দিতে চান সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেন এবং তারপরে নিজেকে ‘দলের’ সর্বোচ্চ প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরেন। অথবা ‘দ্য নিউ সাইকোলজি অফ লিডারশিপ’ বইটিতে আমি ও আমার সহ-লেখকরা যেমনটা বলেছি, কার্যকরী নেতাদের হতে হয় দক্ষ ‘আত্মপরিচয় উদ্যোক্তা’। ডোনাল্ড ট্রাম্পও এজন্যই আবারও ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে, কারণ তিনি একজন সফল ‘আত্মপরিচয় উদ্যোক্তা’।
২০১৬ সালে ট্রাম্প যে বিজ্ঞাপনটি দিয়ে তার প্রচারণা শেষ করেছিলেন, তাতে ট্রাম্পের এই বিভাজনমূলক ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল। এটি এমন যে, লোকে জানে এটি তাদের জন্য খারাপ কিন্তু তারপরও তারা এ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করতে পারে না। এ ছাড়া ধারণাটি এস্টাবলিশমেন্ট বা সমাজের প্রতিষ্ঠিত শ্রেণি এবং আমেরিকার সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরোধকে ঘিরে সংগঠিত করা হয়। যা এই দাবিতে পরিণত হয়, “আমি জনগণের জন্য এবং আন্দোলনের জন্য এটি করছি এবং আমি এই দেশটিকে আপনাদের হাতে ফিরিয়ে দেব। এরপর আমরা আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলব।”
প্রতিষ্ঠিত শ্রেণি এবং জনগণের মধ্যে এই বিরোধের ধারণা অবশ্যই একটি পুরোনো জনতুষ্টিবাদী ধারণা। তবে ট্রাম্পের সংস্করণটি তিনটি উপায়ে স্বতন্ত্র। প্রথমত, প্রতিষ্ঠিত শ্রেণির ব্যাপ্তি, যার মধ্যে বহিরাগত (চীনা, অভিবাসী, বিশ্ববাদী), প্রচলিত রাজনীতিবিদ (ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা) এবং যে কেউ তার বিরোধিতা করে (মিডিয়া, বিচারক, বিজ্ঞানী)। দ্বিতীয়ত, তার কর্তাসত্তার স্বৈরাচারী দাবী। ‘হ্যাঁ আমরা পারি’, এভাবে না বলে ট্রাম্প বলেন, ‘হ্যাঁ আমি পারি’, আর এস্টাবলিশমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাকেই তাদের ত্রাণকর্তা হিসাবে প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ‘জনগণ’কে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর পরিবর্তে জাতীয়/সাংস্কৃতিক ও বর্ণগত পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
শেষেরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প তার বিশাল সম্পদ সত্ত্বেও নিজেকে সাধারণ জনগণের সঙ্গে এক করে দেখান। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প এই দাবি করারও সুযোগ পান যে, তিনি ‘জনগণের জন্য’ কাজ করেন, অথচ তার বিরোধীদের কেনা যায় এবং তারা “সম্পূর্ণরূপে লবিস্ট, দাতাগোষ্ঠী এবং বিশেষ স্বার্থ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হন।”
২০১৫ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতা ঘোষণার সময় ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি একটি বড় ব্যাঙ্ক থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার মানে তিনি কর্পোরেট স্বার্থ থেকে স্বাধীন। তার সম্পদ নিশ্চিত করে যে, তিনি জনগণের জন্য কাজ করবেন এবং জনগণকে তাদের শত্রুদের হাত থেকেও উদ্ধার করবেন। তিনিই সেই ব্যক্তি যার জন্য তারা নিজেদের আবার মহান করার জন্য অপেক্ষা করছে। সম্প্রতি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া এবং তার প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া তার এই মেসিয়া বা ত্রাণকর্তার ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
ট্রাম্পের সাফল্য কেবল তিনি যা বলেন তার বিষয় নয়, তিনি যা করেন তারও বিষয়। এটি তার সাফল্যের একটি মূল রহস্য। তাকে নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক, তার অশোভন বক্তব্য, তার জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থিতি, তার অর্থহীন বকবক এবং তার সীমাহীন অপকর্ম তাকে কেন ধ্বংস করে না, যেভাবে অন্য প্রার্থীদের করে? উত্তর হল— আপনি যদি নিজেকে রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের বিরোধী হিসাবে তুলে ধরেন তবে রাজনীতির নিয়ম ভঙ্গ করা বরং আপনার পরিচয়কে নিশ্চিত করে। এটি দেখায় যে “আমি তাদের একজন নই বরং আমি আপনাদেরই একজন।” একটু অশোধিত, সম্ভবত কিছুটা রুক্ষ, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ জনগণেরই একজন মানুষ।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ এডুকেশন অ্যান্ড সোশ্যাল পলিসির অধ্যাপক এবং ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প: অ্যা সাইকোলজিক্যাল রেকনিং’ এর লেখক ড্যান পি. ম্যাকএডামস। তিনি বলেন, অনেক কারণই— অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক— তার সমর্থকদের সঙ্গে ট্রাম্পের স্থায়ী সম্পর্ক গঠনে ভূমিকা পালন করছে।
তবে তার পর্যবেক্ষণ হল, ট্রাম্পের স্থায়ী আবেদন তার নিজের এবং অন্যদের এই উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হয় যে, তিনি কোনও ব্যক্তি মানুষ নন, তিনি একটি চরিত্র। যেন সবসময় কোনো চরিত্রে অভিনয় করে চলেছেন। লাখো মানুষের মনে ট্রাম্প একজন ব্যক্তি মানুষের চেয়েও বেশি কিছু, যিনি ঈশ্বর এবং মানুষের মাঝামাঝি স্তরে বিরাজ করেন।
ম্যাকএডামস বলেন, “ট্রাম্প তার নিজের মনে এবং তার অনেক সমর্থকের মনে এক সোনার দেবতার মতো— একজন সুপারহিরো, যিনি এমন কাজ করতে সক্ষম যা অন্য কোনও মানুষ করতে পারে না; একজন যোদ্ধা, যিনি প্রতিটি যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রচণ্ড লড়াই করেন। টিভিতে এবং বাস্তব জীবনে তিনি যে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাই তার আসল পরিচয়।”
তার মতে, সমর্থকদের দৃষ্টিতে ট্রাম্প অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী যা ভালোর পক্ষে এবং মন্দের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এমন একজন নেতার যদি একটু ত্রুটি থাকে তাতে কী? তার যদি কিছু মানবিক গুণাবলীর অভাব থাকে বা তিনি যদি অভদ্র, স্বৈরাচারী এমনকি অপরাধীও হন তাতেই বা কী আসে যায়?
ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো ধর্ম পালন করেন না। এমনকি তিনি খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্ম সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি কার্যত কখনোই গির্জায় যাননি। তিনি তার সময় ও জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বস্তুগত সম্পদ আহরণে এবং খ্যাতি অর্জনের জন্য, যার মধ্যে কোনো দাতব্য প্রবৃত্তি বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি নেই। তার ব্যক্তিগত জীবন একাধিক বিয়ে, একের পর এক যৌন কেলেঙ্কারিতে পূর্ণ। কেউ কখনও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাধুপুরুষ বা ঈশ্বরভক্ত একজন ধার্মিক মানুষ বলে ভুলও করেনি।
তার মতো কম ধার্মিক প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিরল। তথাপি তিনি রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ সমর্থন পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। তারা ট্রাম্পর সবচেয়ে একনিষ্ঠ সমর্থক। এই ধর্ম প্রচারকদের খুশি করার জন্যই ট্রাম্প রক্ষণশীল বিচারকদের নিয়োগ করেন যারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন এবং গর্ভপাতের বিরোধিতা করেন। প্রেসিডেন্ট হিসাবেও ট্রাম্প ইভানজেলিক্যাল নেতাদের তার অফিসের টেবিলে স্বাগত জানান, তাদের সম্মান দেন এবং তাদের মতামত শোনেন।
ট্রাম্প তাদের বিশ্বদর্শনও গ্রহণ করেন। তিনি তাদের সঙ্গে সম্মত হন যে, মানুষ একটি পতিত জগতে বাস করে, একটি বিপজ্জনক এবং পাপী বিশ্বে, যা দুষ্ট লোকে ভরা। কারণ সকলেই পাপ করেছে এবং ঈশ্বরের মহিমা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ট্রাম্প ১৯৮১ সালেও পিপল ম্যাগাজিনের একটি সাক্ষাতকারে একই অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন— “মানুষ সমস্ত প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, এবং জীবন মানেই যুদ্ধ যা জয় বা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।”
২০১৯ সালে ফক্স নিউজের এক জরিপে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জন আমেরিকান জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাস করেন, “ঈশ্বর চেয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন।” এমনকি তার প্রশাসনের প্রথম মাসগুলোতে, ইভানজেলিক্যাল নেতারা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য দেখতে শুরু করেছিলেন। ২০১৭ সালে এক পাবলিক ফোরামে খ্রিস্টান টেলিভানজেলিস্ট জেমস রবিসন ট্রাম্পকে বলেছিলেন, “আপনি আসলে আমাদের প্রার্থনার ফল। আমি মনে করি আপনি ঈশ্বরের পরিকল্পিত সৃষ্টি এবং আমাদের জন্য ঈশ্বরের প্রেরিত উপহার।”
এই অনুভূতিকে পুঁজি করে ট্রাম্প সম্প্রতি ট্রুথ সোশ্যালে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন, যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ঈশ্বর ট্রাম্পকে সমস্ত মানবজাতির জন্য রাখাল’ হিসাবে তৈরি করেছেন।
অনেক ইভানজেলিক্যাল সমর্থকের দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাম্পের ঐশ্বরিক মিশন— ঈশ্বরহীন সেক্যুলারিজম বা ইহজাগতিকতার আক্রমণ থেকে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করা, এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং অনুশীলনগুলো সহ। যুক্তরাষ্ট্রকে তার (পৌরাণিক) খ্রিস্টান পরিচয়ে ফিরিয়ে নেওয়া। আধুনিকতার অভিজাত এজেন্টদের প্রতিরোধ করা— মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, ডিপ স্টেট বা গহীনের রাষ্ট্র ও লিবস বা যারা বিশ্বাসী ভালো লোকদের অপমান করে।
লোকের প্রতি ট্রাম্পের আবেদনের একটি চাবিকাঠি হল— মানুষকে রাগ, ক্ষোভ এবং অভিযোগ প্রকাশের উপায় এবং ভাষা দেওয়ার ক্ষমতা, বিশেষ করে শ্রমজীবী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে। গত বসন্তে টেক্সাসের ওয়াকোতে এক সমাবেশে ট্রাম্প তার অনুগতদের বলেছিলেন, “আমি আপনাদের যোদ্ধা। আমি আপনাদের ন্যায়বিচার। আর যাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, আমিই আপনাদের প্রতিশোধ!”
এ ছাড়াও ট্রাম্প তার সমাবেশে আসা লোকদের মাঝে অদ্ভুত এক আনন্দ ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে তাদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ডেভিড ফ্রেঞ্চ বলেন, ট্রাম্পের সমাবেশে আসা মানুষরা তার হাসি-ঠাট্টা ও বোকামিসুলভ কথাবার্তায় নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন এবং অদ্ভুত এক একাত্মতার রোমাঞ্চকর অনুভূতি পান। ফরাসিদের মতো করে বললে— ট্রাম্প একজন ‘ঈশ্বরসদৃশ, পেশীবহুল সুপারহিরো’ হিসাবে কাজ করেন, যার জাদুকরী ক্ষমতা আছে ভালো মানুষকে ভালো বোধ করানোর।
নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম মাজারেলা তার ‘ব্র্যানডিশিং দ্যা নেইম; বা ট্রাম্প কেন এত আনন্দদায়ক?’ প্রবন্ধে ট্রাম্পের প্রভাব বোঝাতে ফরাসি ‘জ্যুস্যান্স (jouissance)’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শব্দটি দিয়ে এমন আনন্দ উপভোগকে বোঝায় যা প্রহসন এবং নির্লজ্জতার সীমানা অতিক্রম করে যায়, যা ‘জ্ঞাতসারে চাষ করা ক্ষোভের কাঁচা, হয়রান আনন্দ এবং যত বেশি বিদ্রূপাত্মক তত ভালো’।
কর্তৃত্ববাদী নেতারা তাদের অনুসারীদেরকে বারবার এবং জোরপূর্বক ভালো মানুষ হিসাবে এবং তাদের শত্রুদের খারাপ মানুষ ঘোষণা করে ভালো বোধ করান। কর্তৃত্ববাদীর প্রথম পদক্ষেপ— ভাল এবং খারাপের মধ্যে সম্পূর্ণ বিভাজন।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য কনভারসেশন, নিউ লাইনস ম্যাগাজিন
ভোটের আগে আগে জরিপ করে এনবিসি নিউজ বোঝার চেষ্টা করছে, জেন-জি ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তার দৌড়ে এবার এগিয়ে থাকছে কে?
সার্ভেমাঙ্কি পরিচালিত সেই জরিপ বলছে, আমেরিকার ৬০তম চতুর্বার্ষিক আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩০ বছরের কম বয়সী জেন-জিরা কমলা হ্যারিসকেই চাইছে।
মোট জেন-জি ভোটারের অর্ধেকই হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চায়। আর এক-তৃতীয়াংশ বলছে, তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পকে আবারও ফিরিয়ে আনবে।
জরিপ বিশ্লেষণের দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০ জনে একজন এবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী নয়। তবে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেয়া ৬০ শতাংশ তরুণ যে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এতে কোনো সংশয় নেই।
২০২০ সালের ভোটে এনবিসি নিউজের এক্সিট পোল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে ট্রাম্পকে হারিয়ে জিতেছিলেন বাইডেন।
এবারের ৬০ শতাংশের অংকের সঙ্গে ২০২০ সালের মিল দেখতে পাচ্ছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভোটের দৌড় থেকে সরে আসার আগের জরিপ থেকে এখনকার ফলাফল আলাদাই মনে হচ্ছে।
নতুন বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদেরও নিজের দিকে টানতে পেরেছেন হ্যারিস। এখানে হ্যারিসের দিকে ৫৪ শতাংশ আর ট্রাম্পের দিকে আছে ২৯ শতাংশ সমর্থন। অর্থ্যাৎ ট্রাম্পকে ২৫ ধাপ পেছনে ফেলে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। কলেজ ডিগ্রি নেই এবং এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়নি এমন সমর্থক সমান ভাবেই রয়েছে দুই দলে; ৪১ শতাংশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা পক্ষ থেকে সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে যে ইরান তাদের তথ্য হ্যাক করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন আমেরিকার নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে পারে।
আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল প্রভাব ফেলবে সারা বিশ্বে। ফলে অনেক দেশ একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীকে সমর্থন দিতে অথবা শুধুমাত্র আমেরিকাকে অস্থিতিশীল করতেই হস্তক্ষেপের জোর চেষ্টা চালাবে।
আমেরিকার উন্মুক্ত গণতন্ত্র এবং মিডিয়ার প্রকৃতি, সেই সাথে নতুন ধরনের প্রযুক্তি, নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার নানান উপায় বাতলে দিতে সহায়ক।
আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান বলেছিলেন, “আমাদের প্রতিপক্ষরা আমেরিকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার এবং গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের আস্থা নষ্ট করার চেষ্টা করে।”
প্রশ্ন হলো, আমেরিকার নির্বাচনে কে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করতে পারে? এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত ৩টি নাম হলো: ইরান, রাশিয়া এবং চীন। দেশগুলির হ্যাকিং প্রচেষ্টা নিয়ে জানুন যোগ (+) চিহ্নে ক্লিক করে।
মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এভ্রিল হেইন্স গত জুলার মাসে বলেছিলেন, “বৈদেশিক প্রভাব বাড়াতে ইরান দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা আমাদের অভ্যন্তরে বিরোধ সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগাতে চাইছে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার জায়গাটি নড়বড়ে করে দিতে চাইছে।”
ট্রাম্পের প্রচারণা পক্ষ বলছে হ্যাকের ঘটনায় ইরানের সংশ্লিষ্টতার কথা। যদিও নিউজ আউটলেট চুরির ঘটনার সঙ্গে এটি যুক্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, যে চুরি করা প্রচারণার নথিপত্র সংবাদমাধ্যমে প্রদানের প্রস্তাবটি নিশ্চিতভাবে এর সাথে যুক্ত ছিল।
এদিকে মাইক্রোসফট সম্প্রতি বলেছে তারা ইরানি কিছু গোষ্ঠীর “প্রভাব বিস্তারের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা প্রত্যক্ষ” করেছে। অন্যদিকে গুগল বলেছে ইরানি হ্যাকারদের চোখ বাইডেনের প্রচারণার (নির্বাচনী দৌড় থেকে বাইডেন বাদ পড়ার আগে) পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও প্রচারণার দিকে।
সার কথা হলো, ট্রাম্পের হোয়াট হাউসে ফিরে আসার বিরোধিতা করার সম্ভাবনাই ইরানের দিক থেকে বেশি।
কারণ ট্রাম্প এবং তার উপদেষ্টাদের ইরান প্রশ্নে বিভিন্ন সময় আক্রমণাত্বক বক্তব্য এবং অবস্থান নিতে দেখা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি প্রত্যাহার এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির পেছনে ইরানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন বলছে, “মার্কিন নির্বাচনের জন্য রাশিয়া প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তবে তারা মনে করে এই হুমকি ইরানের তুলনায় কম দৃশ্যমান।
স্নায়ুযুদ্ধের মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করতে রাশিয়ার আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আর প্রভাবিত করার এই কৌশলকে বলা হচ্ছে “সক্রিয় ব্যবস্থা”।
২০১৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে রাশিয়ার তৎপরতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলনা। যার ফলে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের নির্বাচনী তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। তার নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ইমেইল হ্যাক করে এই ঘটনাটি ঘটানো হয়।
রাশিয়ান হ্যাকাররা খুব সম্ভবত তাদের গোয়েন্দা সংস্থা এসভিআর (স্লাজভা ভ্লেনশকি রাজভেদিকি) এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ (গ্লাভনয় রাজভিদিভাতেলনয় আপরাভলিনিয়া) উভয়ের থেকেই দক্ষ এবং তারা আবারও অ্যাকান্ট হ্যাক করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাশিয়ার প্রচারণা শুরু সেই ২০১৬ সালে থেকে। যখন ফেইক প্রোফাইল ব্যবহার করে হিলারি ক্লিনটন বিরোধী জমায়েতের ডাক দেওয়া হতো। ধারণা করা হচ্ছে, মস্কো এইসমস্ত তৎপরতার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা না দেখাতে কিছু সংস্থাকে নিয়োগ দিচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে পৌছাতে তারা আরও কার্যকরী কিছু ভাবছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি মস্কো সম্পৃক্ত হয় তবে তা ট্রাম্পকেই সুবিধা এনে দেবে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প মস্কোর প্রতি বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং ছিলেন ন্যাটোর সমালোচক। সম্প্রতী ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের প্রতি তার সহায়তার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও এটিকে মনোযোগ অনত্র্য সরিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বৈদেশিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে চীনকে বলা হয় “ওয়াইল্ডকার্ড”।
২০০৮ সালে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা মার্কিন প্রচার কার্যক্রমগুলো হ্যাক করে। তবে প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে বাকি দুটি রাষ্ট্রের চেয়ে তাদের কম সক্রীয় মনে হচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে তারা সম্ভবত নির্বাচনের “ফলাফলকে প্রভাবিত করার পরিকল্পনা করবে না।”
চীন যদি কোন সিদ্ধান্ত নেয়, তবে কার প্রতি তাদের সমর্থন থাকতে পারে তা নিয়েও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বেইজিং এর প্রতি অপ্রত্যাশিত এবং সংঘাতমূলক হতে পারেন। তবে তার বাইডেন প্রশাসনের মতো মিত্রজোট গড়ে তোলার নীতি অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা কম, যা কিনা বেইজিংকে উদ্বিগ্ন করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে বেইজিং সতর্ক। ফলে এমন কোন তৎপরতায় তারা হয়তো জড়াবেনা যা দেখে হস্তক্ষেপ মনে হতে পারে। কিন্তু ইরান অথবা রাশিয়ার এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই।
তবে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা স্থানীয় বা কংগ্রেস পর্যায়ের প্রার্থীদের লক্ষ্য করে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ চীন সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অতীত অবস্থান।
যদিও এই তিনটি দেশই নির্বাচনে হস্তক্ষেপমূলক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করেছে।
২০১৬ সালে রাশিয়ার হ্যাক করা তথ্যসমূহ গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চুরি করা তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে।
প্রভাব তৎপরতাকে রুখে দিতে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উন্নত করা হয়েছে। তারপরও, চ্যালেঞ্জ বেড়েই চলেছে।
বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে অভ্যন্তরীন বাকস্বাধীনতা থেকে রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। কোন কোন দেশ তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে আমেরিকানদের করতে পারে ব্যবহার। কখনও কখনও, জেনে অথবা না জেনে, এই আমেরিকানরাই হতে পারে তাদের সহযোগী। কখনও তারা অজান্তে জড়িয়ে যাবে। এমনকি এমন ওয়েবসাইটের জন্য লেখালেখি করতে সম্মত হবে যেগুলো মস্কো বা অন্য কারও স্বার্থের জন্য কাজ করছে।
নতুন উদ্বেগের কারণও আছে। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিপফেইকের কল্যাণে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। ফলে যারা হস্তক্ষেপ করতে চায় তাদের জন্য এসব পোয়াবারো।
এই প্রযুক্তিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের ওপর আরও কার্যকরী প্রভাব ফেলতে পারে। তৈরি করতে পারে আরও অধিক বিশ্বাসযোগ্য ভুয়া কন্টেন্ট। যেগুলো মানুষকে কোনটি সত্যি আর কোনটি সত্যি নয় তা নিয়ে ধন্দে ফেলে দিতে পারে।
কিন্তু আমেরিকার নির্বাচনের গুরুত্ব যেহেতু বিশ্বব্যাপী, সেহেতু প্রথমবারের মতো নতুন কোন প্রযুক্তি এবার ব্যবহৃত হতে পারে। তাছাড়া বৈশ্বিক রাজনীতিতেও অতীতের তুলনায় অনেক বেশি মেরুকরণ ঘটে গেছে।
ঝুঁকি আরও আছে। এমনকি বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে। যা কিনা নির্বাচনের ফলাফলে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে।
মূল: বিবিসিতে প্রকাশিত গর্ডন কেউরেরার প্রতিবেদন “হোয়াট টু নৌ অ্যাবাউট ইউএস ইলেকশন হ্যাকিং, ইরান অ্যান্ড আদার কান্ট্রিস”
লেখা : মাহবুবুল আলম তারেক, কল্লোল কর্মকার, সৈয়দ ফরহাদ, আইরিন সুলতানা