একজন চাষি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টার মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর।
রবিবার দুপুরে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্লেইনস শহরে নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন জানিয়ে তার ছেলে জন উইলিয়াম কার্টার বলেন, “বাবা কেবল আমার নায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সবার নায়ক যারা শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখেন।”
গত ১ অক্টোবর শততম জন্মদিন উদযাপন করেন কার্টার। এটাই ছিল আমেরিকান কোনও প্রেসিডেন্টের একশ বছর বয়সের মাইলফলক স্পর্শ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ জীবন পাওয়া এই প্রেসিডেন্ট ১৯৭৭-১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট। এরপর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে রোনাল্ড রেগানের কাছে হেরে রাজনীতি থেকে অবসরে যান তিনি।
ত্বকের ক্যান্সারসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন কার্টার। গত বছর নিজ বাড়িতেই এজন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।
একসময় ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতি করা কার্টারের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি ছিলেন নীতিবান, বিশ্বাসে অটল ও নম্র স্বভাবের মানুষ।
আরেক ডেমোক্রেট যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পূর্বসূরি কার্টার সম্পর্কে বলেছেন, মানুষের সেবা করার জন্যই বেঁচে ছিলেন তিনি।
শোক জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি বলেছেন, আমেরিকানদের কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে গেছেন কার্টার।
জিমি কার্টারের মৃত্যুতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও শোক জানিয়েছেন।
২০০১ সালে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন জিমি কার্টার। তখন তিনি সংসদ বর্জন ও হরতাল না করতে দুই প্রধান দলের প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্টের নিজ প্রতিষ্ঠান দ্য কার্টার সেন্টার জানিয়েছে, আটলান্টা ও ওয়াশিংটন ডিসিতে কার্টারের মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানে তার মৃত্যুতে শোক জানাবে সর্বস্তরের মানুষ। এরপর জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজ শহরে তাকে সমাহিত করা হবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিখ্যাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনসহ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন কার্টার। তবে তার কৃতিত্বগুলো নিয়ে খুব একটা কথা হয় না।
কার্টার ১৯৮০ সালে আলাস্কা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ল্যান্ডস কনজারভেশন অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। এই আইন ১০০ মিলিয়ন একরের বেশি এলাকা সুরক্ষিত করে, যার মধ্যে রয়েছে জমি, জাতীয় উদ্যান, আশ্রয় শিবির, স্মৃতিসৌধ, অরণ্য ও অনেক সংরক্ষিত এলাকা। এই আইনকে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ আইনগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এখন।
তবে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় দেশটির দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জিম্মি সংকট, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও তেল নিষেধাজ্ঞা হোয়াইট হাউসে কার্টারের ক্যারিয়ারে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। ফলে তিনি দ্বিতীয়বার জিততে পারেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের যে চারজন প্রেসিডেন্ট শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তাদের একজন কার্টার। ১৯২৪ সালে ছোট্ট কৃষিপ্রধান শহর প্লেইনসে জন্ম হয় তার।
কার্টারের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী আর মা নার্স। তার শৈশব কেটেছে এমন এক জায়গায় যেখানে কোনও পানি বা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। তার বন্ধুরা সবাই ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী উপস্থাপক ও সঞ্চালক অপরাহ উইনফ্রেকে এক সাক্ষাৎকারে কার্টার বলেছিলেন, “যাদের সঙ্গে আমি বাদাম ক্ষেতে কাজ করতাম, মারামারি করতাম, মাছ ধরতে যেতাম, শিকার করতে যেতাম, তারা সবাই ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান।”
কার্টার তার প্রেসিডেন্ট-পরবর্তী জীবন অন্য প্রেসিডেন্টদের মতো কর্পোরেট বোর্ডের সদস্য হয়ে বা বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য উৎসর্গ করেননি।
তিনি বরং গৃহহীনদের জন্য বাড়ি তৈরি করে হাত ময়লা করেন, কিউবা ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি মিশনে যান, জিম্মিদের মুক্তির জন্য আলোচনার মতো কাজ করেন।
অবসর জীবনে কার্টার থাকেন নিজ শহরে, যেখানে প্রতি রবিবার স্কুল ও কলেজে পড়াতেন এবং বই লিখে গ্র্যামিও জেতেন।
একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিঃসন্দেহে ইতিহাসের দীর্ঘতম, নীতিনিষ্ঠ অবসর জীবন যাপন করেছেন তিনি।
দ্য কার্টার সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, অবসরের প্রায় ৪৪ বছরে কার্টার মূলত গিনি ওয়ার্ম নির্মূল করতে সাহায্য করেছেন। এই পরজীবীটি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষকে সংক্রমিত করেছিল, ২০২৩ সালে যা মাত্র ১৪ জনে নেমে আসে।
২০০২ সালে কার্টার নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতেন, ঠিক যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কার্টার সেই বছর কিউবায় একটি যুগান্তকারী সফরও করেছিলেন।
সিএনএন এর স্টিফেন কলিনসন সেই সময়ে লিখেছিলেন, কার্টার প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেভাবে কাজ করেছিলেন একই নিষ্কলুষ সততা নিয়ে অবসরও যাপন করেন।
কার্টারও নিজের জীবন সম্পর্কে বলেন, “আমি একটি বিস্ময়কর জীবন কাটিয়েছি।”