কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) বা সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আর নেই।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ২৫ দিন ধরে তীব্র শাসকষ্টের সঙ্গে লড়াইয়ের পর বৃহস্পতিবার বিকালে প্রবীণ এই কমিউনিস্ট নেতার মৃত্যু হয়েছে।
সীতারাম ইয়েচুরি দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে (এআইআইএমএস/এইমস) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
সিপিআইএম নেতা সীতারাম গত ১৯ আগস্ট এইমসের (আইআইএমএস) জরুরি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তরিত করা হয়।
তিনি নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণে ভুগছিলেন। তবে চিকিৎসকরা তার অসুস্থতার সঠিক প্রকৃতি প্রকাশ করেননি।
আগস্টে তার চোখের ছানি অপারেশন হয়েছিল। সেই কারণে তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণের পর কলকাতায় যেতে পারেননি। এরপরই ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।
গত ৮ অগস্ট দিল্লিতে ইয়েচুরির চোখে ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ওই দিনই প্রয়াত হন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
এইমস জানিয়েছে, ইয়েচুরির পরিবার তার মরদেহ শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে এইমস, নয়াদিল্লিকে দান করে দিয়েছে।
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে ভারতের বাম আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্য়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাম নেতা কর্মীরা শোক প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মতের রাজনীতিবিদরাও তার প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছেন।
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা।
ভারতের প্রধান বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, “সীতারাম ইয়েচুরি জি একজন বন্ধু ছিলেন। আমাদের দেশের গভীর উপলব্ধি সহ তিনি ছিলেন ‘ভারত ধারণা’র একজন রক্ষক।
“আমরা যে দীর্ঘ আলোচনা করতাম তা আমি মিস করব। শোকের এই মুহূর্তে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং অনুগামীদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা।”
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রী,বিজেপি নেতা নীতিন গড়কড়ি বলেছেন, “ইয়েচুরির জনজীবনে অবদান সর্বদা স্মরণ করা হবে। এই কঠিন সময়ে তার পরিবার এবং প্রিয়জনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা। ওম শান্তি।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, “প্রবীণ সিপিএম নেতা, সীতারাম ইয়েচুরিজির মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। সংসদে আমাদের বহু বছর ধরে কাজ করার সম্পর্ক ছিল। তার পরিবার, সহকর্মী এবং ভক্তদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “শ্রী সীতারাম ইয়েচুরি মারা গেছেন জেনে দুঃখিত। আমি তার মৃত্যু জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি বড় ক্ষতি হবে। আমি তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের প্রতি আমার সমবেদনা প্রকাশ করছি।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়ও সীতারাম ইয়েচুরির প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
কাশ্মীরের পিডিপি প্রধান মেহেবুবা মুফতিও শোক প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তার পরিবার ও প্রিয়জনকে জানাই সমবেদনা। খবরটা অত্যন্ত কষ্টের।
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, “সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র নেতা সীতারাম ইয়েচুরি জির মৃত্যু ভারতীয় রাজনীতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি।”
দলটি বলেছে, “ভগবান যেন তার পদ্ম পায়ে তার বিদেহী আত্মাকে স্থান দেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এই শোক সহ্য করার শক্তি দেন।”
সীতারাম তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সিপিএমের নীতি-নির্ধারণী ফোরাম পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। বাংলার বাম নেতৃত্বের সঙ্গেই তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। বার বার তিনি ছুটে আসতেন বাংলায়। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার সদস্যও ছিলেন।
১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট ইয়েচুরির জন্ম মাদ্রাজে (চেন্নাই)। পৈতৃক বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দরাবাদে। স্কুলশিক্ষা প্রথমে সেখানেই। ১৯৬৯ সালে দিল্লির প্রেসিডেন্ট এস্টেট স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই সিবিএসই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।
এরপর অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি নেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে। তার পর স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ)। জেএনইউয়েই ইয়েচুরির বাম ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভাপতিও ছিলেন তিনি। সেখানে পড়াকালীনই সিপিএমের সদস্যপদ নেন তিনি এবং সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ইয়েচুরি তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ১৯৭৪ সালে স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (এসএফআই) সঙ্গে এবং ১৯৭৫ সালে সিপিআইএম-এ যোগ দেন।
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার জরুরি অবস্থা জারি করার সময় তিনি জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলেন ইয়েচুরি। তখন আরও অনেক নেতার সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন, যারা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে তার পিএইচডি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
১৯৭৮ সালে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এসএফআই)-এর সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৮৪ সালে এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সভাপতি। সিপিএমের অন্ধ্রপ্রদেশ (তখন অবিভক্ত) রাজ্য কমিটিতে ছিলেন।
১৯৮৫ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সাল থেকে পলিটব্যুরোর সদস্য। ২০১৫ সালে কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে তিনি সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।
২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হয়ে রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন ইয়েচুরি। বাংলা ভাষাতেও সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন ইয়েচুরি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পর ইয়েচুরির মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হল বলে মনে করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : এনডিটিভি, আনন্দবাজার