গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের সাংবিধানিক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা একে একে পদত্যাগ করছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। ৬ আগস্ট দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে নতুন এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।
এরপর থেকে পদত্যাগের মিছিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারও যোগ দেন। শুক্রবার (৯ আগস্ট) তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
শনিবার পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তবে এদিন তিনি আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতিকে নিয়ে ফুল কোর্ট সভা ডেকেও স্থগিত করতে বাধ্য হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মুখে।
পদত্যাগের এই মিছিলে যোগ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও (ভিসি)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির পদত্যাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামাল শনিবার পদত্যাগ করেছেন। বঙ্গভবনে সংযুক্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার একজন সাংবাদিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শনিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে মাকসুদ কামাল পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ পরিচালক মাহমুদ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি তো শুনতেছি। আমি আসলে কীভাবে বলব? অফিস তো বন্ধ। একুরেট খবর আমিও জানি না। এটা তো চ্যান্সেলরের কাছে পাঠাইছে। রাষ্ট্রপতি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।”
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উনি পদত্যাগ করেছেন এটা কনফার্ম।” বঙ্গভবন থেকে কিছু বলেছে কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বঙ্গভবন থেকে এসব কিছু বলবে না। শুধু চিঠি পাঠিয়ে দিলেই হয়।”
তবে একটি গণমাধ্যমকে মাকসুদ কামাল বলেন, “বিষয়টি নিয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। স্বাভাবিক সৌজন্যতার জায়গা থেকেই আমি এই আলোচনা করেছি। আমার পদত্যাগপত্র আগেই তৈরি ছিল। আমার মনে হয়েছে শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই আমার পদত্যাগ করা দরকার।”
২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ৪ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন মাকসুদ কামাল। তিনি ২০০০ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তিনি ভূমিকম্প ও সুনামি এবং নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।
শাবিপ্রবি ভিসির পদত্যাগ
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণার পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শনিবার পদত্যাগ করেছেন। এ বিষয়টি তিনি নিজেই এদিন বিকালে নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, “আমি ব্যাক্তিগত কারণে আমার পদ থেকে পদত্যাগ করছি। আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।
“এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলের প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। বাকি যারা আছে সকলে পদত্যাগ করবেন।”
এর আগে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্য, হলের প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট সবাই রেজিস্ট্রার বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন দীর্ঘায়িত হলে শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান। সে সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে এসেছেন, ভিসি তিন মাসের মধ্যে পদত্যাগ করবেন।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাবিপ্রবির সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা এই ভিসিকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছিলাম। ভিসি শিক্ষার্থীদের অনেক রক্ত ঝরিয়েছেন, তার কারণে অনেক শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এই ক্যাম্পাসের আমাদের এক ভাই নিহত হয়েছে। তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রক্টর, তিন প্রভোস্ট পদত্যাগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্যরা এবং তিনটি আবাসিক হলের হল প্রভোস্ট। শনিবার তারা পদত্যাগ করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবি জানিয়ে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর শনিবার তারা পদত্যাগ করলেন। কিন্তু চবি উপাচার্য এখনও পদত্যাগ করেননি। এজন্য শুক্রবার তার বাসভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
প্রক্টর ও হল প্রভোস্টদের পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে চবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলমের নেতৃত্বে ১০ জন সহকারী প্রক্টর এবং আলাওল হলের প্রভোস্ট সৃজিত কুমার দত্ত, এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট আলী আরশাদ ও সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট শেখ সাদি পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে চবি প্রক্টর অহিদুল আলম বলেন, “চলামান পরিবেশ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আমরা সবাই পদত্যাগ করেছি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে ১৮ আগস্ট। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আবাসিক হল খুলে দেওয়া হবে। আর ১৯ আগস্ট থেকে শুরু হবে ক্লাস। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৬ আগস্ট থেকে শুরু হবে শাটল ট্রেন চলাচল।
সিন্ডিকেটের ৮ আগস্টের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে উঠতে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন ১০ থেকে ১৪ আগস্ট। ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের স্থায়ী ঠিকানার দূরত্ব ও পরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে ১৭ আগস্ট থেকে হল বরাদ্দ দেওয়া হবে। ১৮ আগস্ট থেকে সেই হলের কক্ষে উঠতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তার প্রায় একমাস পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে যাচ্ছে।
নোবিপ্রবিতে প্রক্টর-প্রভোস্টসহ ৯ জনের পদত্যাগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলটিমেটামের নির্ধারিত ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্ট বোর্ডের একটি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে রবিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া, সোমবার থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু এবং ২৫ আগস্ট থেকে সশরীর ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, পাঁচটি আবাসিক হলের প্রভোস্টসহ নয় জন। শুক্রবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বরাবর তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন।
পদত্যাগ করা কর্মকর্তারা হলেন- প্রক্টর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক বিপ্লব মল্লিক, ভাষাশহীদ আবদুস সালাম হলের প্রভোস্ট কাউসার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উকিল হলের প্রভোস্ট রুহুল আমিন, হজরত বিবি খাদিজা হলের প্রভোস্ট মো. রফিকুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অবন্তী বড়ুয়া, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট মুহাম্মদ মহিনুজ্জামান, আইকিউএসির পরিচালক অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও অতিরিক্ত পরিচালক মোহাইমেনুল ইসলাম।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. জসীম উদ্দিন জানান, পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বিষয়টি উপাচার্যকে অবহিত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্ট বোর্ডের একজন সদস্য জানান, রিজেন্ট বোর্ডের এক জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত বুধবার উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রক্টরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তা ও প্রভোস্টদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ দাবি করে বিবৃতি দেন আন্দোলনকারীরা।
নোবিপ্রবি প্রশাসনের পদত্যাগসহ ৪ দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও নির্ধারিত সময়ে পদত্যাগ করেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় উপাচার্যের কক্ষের সামনে নামফলক সরিয়ে নেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
শনিবার রাত ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল হয়।
এর আগে গত ৮ আগস্ট উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পদত্যাগ চেয়ে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রক্টর ও আবাসিক হলের প্রভোস্টসহ ৯ জন পদত্যাগ করলেও পদত্যাগ করেননি প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা ৪ শিক্ষক।
শনিবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেন এবং বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এছাড়া প্রতিবাদ স্বরূপ তারা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারের কক্ষের প্রধান গেটের তালা দেন এবং উপাচার্যের নামফলক থেকে নাম সরিয়ে ফেলেন।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বনি ইয়ামিন বলেন, “রবিবার বিকাল ৪টার মধ্যে ভিসি ও অন্যরা যদি পদত্যাগ না করে তাহলে আমরা তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করব।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোবিপ্রবির আরেক সমন্বয়ক মেহেদী হাসান মাহদী বলেন, “ভিসি ও অন্যরা যারা এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য অনলাইন ক্লাসের মতো হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই আমরা এই হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করছি।”