চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের অভিযোগ তুলে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, অন্যথায় স্বেচ্ছায় কারাবরণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এসময় চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে সোমবার সন্ধ্যায় শহবাগে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সনাতনীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দেশীয় অস্ত্র ও লোহার রড দিয়ে হামলার অভিযোগ জানিয়ে তার প্রতিবাদ জানানো হয়।
গতকাল সোমবার বিকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চট্টগ্রামে সনাতন জাগরণ মঞ্চ ব্যানারে সমাবেশের দিন জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে গত অক্টোবরে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
রাতেই চিন্ময়কে সড়কপথে চট্টগ্রামে নেয় পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে চিন্ময়কে চট্টগ্রামের ষষ্ঠ মহানগর হাকিম কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক তার জামিন নাকচ করে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার ও তাকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণ। বেলা গড়াতেই গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয় এক আইনজীবীর রক্তাক্ত লাশ।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি হিন্দু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুমন কুমার রায়।
তিনিবলেন, “চিন্ময় কৃষ্ণের মামলায় আগামীকাল (বুধবার) ফৌজদারি আপিল শুনানি আছে। অবিলম্বে চিন্ময় প্রভুকে মুক্তি না দিলে আমরা স্বেচ্ছায় কারাবরণ কর্মসূচি ঘোষণা করব। এখন বাংলার ঘরে ঘরে চিন্ময় প্রভুর জন্ম হয়েছে। একজন চিন্ময়কে গ্রেপ্তারে এই আন্দোলন থামানো যাবে না।”
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের এই প্রতিনিধি এ সময় আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেই দায় কখনও চাপানো হয়েছে জামায়াত-শিবিরের ওপর, কখনও চাপানো হয়েছে বিএনপির ওপর। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের দায় স্বীকার করেনি। তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ধারা এখনও চলছে।
তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। কিন্তু আবারও সংখ্যালঘুদের বলি দেওয়া শুরু। সনতনী সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে ফুটবলের মতো খেলা হচ্ছে। দেশে কোনও কিছু হলেই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হয়। সেটা অস্বীকার করার কালচারও বদলেনি।”
সংবাদ সম্মেরনে চট্টগ্রামের আদালতে সংঘর্ষে এক আইনজীবী নিহত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হিন্দু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি সুমন বলেন, “চট্টগ্রামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করছে একটি গোষ্ঠী। সারা দেশেই এমন চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রামে টিয়ার গ্যাস মেরে ও লাঠিপেটা করে সনাতনী মানুষজনকে আহত করা হয়েছে। আমারা এর তীব্র নিন্দা জানাই। এসময় হামলাকারীরা হিন্দু মনে করে আইনজীবীর ওপরও হামলা চালায়, কিন্তু পরে দেখা গেছে তিনি মুসলিম।”
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের সদস্য প্রসেনজিৎ হালদার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। সেই সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
উক্ত গ্রেপ্তারের খবর শোনা মাত্রই বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের সমর্থকরা ঢাকার মিন্টু রোডস্থ ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত হন এবং কার্যালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছে গ্রেপ্তারের তথ্য জানতে চান। কিন্তু কর্মকর্তাদের কেউ এ সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে দিতে পারেননি।
লিখিত বক্তব্যে প্রসেনজিৎ হালদার আরও বলেন, এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের সমর্থকরা সন্ধ্যা ৭টায় শাহবাগ মোড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করেন। বিক্ষোভ সমাবেশটি শাহবাগ থানাস্থ পুলিশ প্রশাসনের অনুমতিক্রমেই আয়োজন করা হয়।
কিন্তু বিক্ষোভ সমাবেশ চলাকালে কতিপয় উগ্রবাদী ব্যক্তি দেশীয় অস্ত্র, রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভরতদের ওপর হামলা চালায়। ওই হামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রায় ৩০ জন সমর্থক আহত হন। তাদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা গুরুতর। গতকালের হামলায় ২ জন নারী সমর্থক শারীরিক নিগ্রহের শিকার হন।
প্রসেনজিৎ বলেন, “দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে উক্ত বর্বরোচিত হামলা সংগঠিত হয়। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে হামলা প্রতিরোধে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট উল্লিখিত বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা ও আহত করার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের সদস্যদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী মহাসচিব ও মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে বলেন, “৮ দফা দাবি সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের আন্দোলনকে আওয়ামী ট্যাগ দিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কারা জাতীয় পতাকা অবমাননা করেছে আমরা জানি না, সেই ঘটনায় চিন্ময় প্রভুসহ কয়েকজনকে মিথ্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে সারা বিশ্ব দেশপ্রেমিক হিসেবে জানে। তারা কখনও রাষ্ট্রদ্রোহী কোনও কাজ করতে পারে না।
অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, “এই মুহূর্তে দেশ কে চালাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সরকারের মধ্যে আরেক সরকার আছে। প্রশাসনের মধ্যে আরেকটি অদৃশ্য প্রশাসন আছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত বাবা-মার মতো। বাবা-মা যেমন তার দুর্বল সন্তানকেও সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে, তেমনি সরকারের উচিত তার সংখ্যালঘু নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু আমরা সরকারের এই ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না।”