Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকি বলে আমরা শেকড়মুখী না

মেরিনা তাবাসসুম

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নিজের স্থাপত্য ভাষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম। এরপর সহ-স্থপতি হিসেবে স্বাধীনতা স্তম্ভের নকশা করেছেন। জলবায়ু ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে তিনি সমকালীন স্থাপত্যর্চচায় ছাপ রাখছেন স্বকীয়তার সঙ্গে। ২০০৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস। ২০১৬ সালে বায়তুর রউফ জামে মসজিদের জন্য পেয়েছেন ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’। এ বছর ‘টাইম’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত ২০২৪ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন। স্থাপত্য-নগরের নানা বিষয় নিয়ে মেরিনা তাবাসসুম’র সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকি বলে আমরা শেকড়মুখী না

মেরিনা তাবাসসুম

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নিজের স্থাপত্য ভাষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম। এরপর সহ-স্থপতি হিসেবে স্বাধীনতা স্তম্ভের নকশা করেছেন। জলবায়ু ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে তিনি সমকালীন স্থাপত্যর্চচায় ছাপ রাখছেন স্বকীয়তার সঙ্গে। ২০০৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস। ২০১৬ সালে বায়তুর রউফ জামে মসজিদের জন্য পেয়েছেন ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’। এ বছর ‘টাইম’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত ২০২৪ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন। স্থাপত্য-নগরের নানা বিষয় নিয়ে মেরিনা তাবাসসুম’র সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাগাজিন ‘টাইম’ প্রতি বছরের মতো বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের এই তালিকায় উদ্ভাবক বিভাগে আপনি একজন। সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। আপনি নিজেকে বা আপনার কাজকে কতটা প্রভাবশালী বলে মনে করেন? 

মেরিনা তাবাসসুম: প্রভাবশালী কিনা— এটা ঠিক আমি জানি না। এটা ‘টাইম’র দেওয়া একটি অভিধা। আমি নিজেকে সেটা মনে করি না। এর মানেই বা কি তাও জানি না। তবে প্রভাবের (Influence) কথা যদি বলেন— একটা পুরষ্কার বা স্বীকৃতি পাওয়ার পর কিছু প্রভাব নিশ্চয়ই থাকে। সেক্ষেত্রে এটা তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে বলে আমি মনে করি। সেই দিক থেকে হয়ত এক ধরনের প্রভাব রাখা যায়। প্রভাবশালী তো আরও একটু বড় বিষয়। তাই আমার নিজেকে কোনওভাবেই সেরকম মনে হয় না।

সকাল সন্ধ্যা: এ ক্ষেত্রে আপনার নকশা করা স্থাপত্যের এক ধরনের ভূমিকা আছে নিশ্চয়ই…

মেরিনা তাবাসসুম: কিছুটা তো প্রভাব থাকেই। যখন থেকে কাজ করছি তখন থেকে কিছু বিষয় নিয়ে আমি সবসময় কথা বলি। এসব বিষয়ে নিয়ে কাজও করি। এর মধ্যে আছে স্থানীয় উপকরণ নিয়ে কাজ করা। কম খরচে একটি নকশা কীভাবে করা যায়— সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। তারপর জলবায়ু নিয়ে চিন্তা। এটা আমি আজ থেকে করি না।

আমার কাজের প্রথম থেকেই এটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ছিল। এখন যেটা নতুন করে যুক্ত হয়েছে সেটা হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা বাস্তুচ্যূত মানুষদের নিয়ে কাজ করা। এই ধরনের কাজগুলোর তো একটি প্রভাব থাকেই। আমি নিজে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেই হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপরও একটা প্রভাব আসে। আমার কাছে মনে হয়— তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী, তরুণ পেশাজীবীদের ওপর প্রভাবটা অনেক জরুরি। শেষ পর্যন্ত তারাই তো ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাদের ওপর যদি প্রভাবটা আসে তাহলে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা এখন অনেক বেশি ভূমি নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। এর একটা মূল কারণই হলো আমাদের পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকাটা। পশ্চিম থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া। অথচ আমার দেশ কী, আমার জলবায়ু কী? এটা থেকে আমার জিনিসগুলো না বিকশিত করি, তাহলে সংস্কৃতি বলেন আর যেটাই বলেন না কেন— কোনওকিছুই শেকড়মুখী হবে না।

সকাল সন্ধ্যা: আপনার সম্পর্কে ‘টাইম’ লিখেছে স্থপতি হিসেবে পেশাগত ক্ষেত্রে আপনি কাজ করছেন ‘পরার্থপরতা’র নীতি নিয়ে। সাময়িকীটি আরও বলেছে, স্থানীয় সংস্কৃতি ছাড়াও মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে আপনি কাজ করেন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও আপনার নকশায় প্রাধান্য পায়। আপনার কাছে জানতে চাই, স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়টি কীভাবে আপনি বিবেচনায় নেন?  

মেরিনা তাবাসসুম: আসলে সংস্কৃতি কীভাবে তৈরি হয় সেটা একটি ব্যাপার। যে কোনও স্থানেই, আপনি যদি তার ভৌগোলিক অবস্থানকে ধরেন— কীভাবে তার ভূমির রূপান্তর হলো— আর সেই এলাকার জলবায়ু। এই দুটো কিন্তু একদম ‘স্থায়ী’ একটা জিনিস। পৃথিবীর যে কোনও জায়গাতেই হোক না কেন— তার ভুগোল ও জলবায়ু— এই দুইটি কিন্তু আপাত অর্থে একদম ‘স্থির’ একটি বিষয়। এটাই কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের অনন্যতা— সেটা তৈরি হয় আমার জলবায়ু আর ভৌগোলিক অবস্থান দিয়ে।

এরপর যেটি আসে— এটা থেকেই সংস্কৃতি তৈরি হয়। সংস্কৃতি তো একটি বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। এর মধ্যে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও যেসব চিন্তাভাবনাগুলো আসে—

অর্থনীতি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই তো একটা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তৈরি হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাই— এটাই তো সংস্কৃতি।

এই জন্য আমি সবসময় যেটা পছন্দ করি এবং মনে করি যে, আমাদের যে কোনও কিছুর শেকড়ে যেতে হবে। আপনি যদি শেকড়ে যান— তাহলে সংস্কৃতির যেখান থেকে সূত্রপাত সেই জায়গায়টা যেতে পারবেন।

সেই কারণে আমার দেশের ভূগোলটা কী— নদীমাতৃক দেশ— নদীই আসল। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা নদী ভুলে গিয়েছি। আমরা এখন অনেক বেশি ভূমি নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। এর একটা মূল কারণই হলো আমাদের পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকাটা। পশ্চিম থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া। অথচ আমার দেশ কী, আমার জলবায়ু কী? এটা থেকে আমার জিনিসগুলো না বিকশিত করি, তাহলে সংস্কৃতি বলেন আর যেটাই বলেন না কেন— কোনওকিছুই শেকড়মুখী হবে না।

এই কারণে এখান থেকেই আমার সূত্রপাত হয়। সেই হিসেবে আমার উপকরণ ব্যবহার বলেন— দেশীয় উপকরণ নিয়ে আমি কাজ করতে পছন্দ করি— সেটা মাটি হোক, ইট হোক, বাঁশ হোক— সেটা যেটাই হোক না কেন। সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা যায়, এটা আমার একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার বলতে পারেন— যেটা আমার মাটির সঙ্গে সংযুক্ত। আর দরজা-জানালা খুলতে হবে আমার— এটা খুলতেই হবে— এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

জানালা না খুললে আমাদের যে ধরনের গরম আর আর্দ্রতা— এই দুটিকে যদি মোকাবেলা করতে হয়— আমি যদি কাচ দিয়ে বন্ধ করে দেই, তাহলে এটা আর আমার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা থাকে না। সেখানে আমার জানালা খোলা— খোলা বারান্দা— লম্বা প্রশস্ত বারান্দা— এক সময় ছিল আমাদের বাড়িগুলোতে বা উঠান— এগুলো হলো আমার সংস্কৃতির অংশ।

এগুলো কিন্তু একদিনে হয়নি। এটা কিন্তু মূলত আমাদের জলবায়ুর প্রতিক্রিয়া থেকেই হয়েছে। এটাকে আমরা বাদ দিয়ে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে তাদের বাড়ি-ঘরের নকশাকে আমরা আমাদের এখানে ইনকরপোরেট করছি। এর মধ্য দিয়ে ভাবছি যে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে আমরা কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি না— আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।

শহরকে এমনভাবে নকশা করতে হবে যেখানে আমার গাড়ির প্রয়োজন হবে না। একটি শহরে আমার যে প্রয়োজনীয় জিনিস আছে— সেটা আমার স্কুল হোক, কলেজ হোক, হাসপাতাল হোক— এই পুরো জিনিসটা হাঁটার দূরত্বে ১৫ মিনিটের মধ্যে যেন পাওয়া যায়। হাঁটার যোগ্যতাই এখন একটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পশ্চিমে এখন এটি নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা হচ্ছে।

সকাল সন্ধ্যা: জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি বিশ্বে এখন নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আপনিও বললেন যে, আপনার কাজেও এই বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে চিন্তা করছেন। এছাড়াও প্রকৃতিকে রক্ষা করা কিংবা নষ্ট করা প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনার কাজটি বিভিন্নভাবে আলোচিত হচ্ছে। স্থাপত্য নকশা ও ব্যবহারের বিষয়ে এখন সেভাবে চিন্তাও হচ্ছে। তাহলে আমাদের আধুনিক বা সমকালীন নগর ও স্থাপত্য ধারণা এই বিষয়টি কি না ভেবেই অগ্রসর হয়েছে?

মেরিনা তাবাসসুম: ঢাকার প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে দেখব, এটা নকশা করার আগেই এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল শহরের তালিকায় চলে গিয়েছে। এমনকি জনঘনত্বের দিক থেকেও এই শহর অনেক এগিয়ে। আর এখনকার শহরের চিন্তাভাবনা হলো— ‘হাঁটার যোগ্য শহর’।

শহরকে এমনভাবে নকশা করতে হবে যেখানে আমার গাড়ির প্রয়োজন হবে না। একটি শহরে আমার যে প্রয়োজনীয় জিনিস আছে— সেটা আমার স্কুল হোক, কলেজ হোক, হাসপাতাল হোক— এই পুরো জিনিসটা হাঁটার দূরত্বে ১৫ মিনিটের মধ্যে যেন পাওয়া যায়। হাঁটার যোগ্যতাই এখন একটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পশ্চিমে এখন এটি নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা হচ্ছে।

আমাদের ঢাকা শহরের কথা যদি বলি— এগুলো তো এক একটা ব্লকের মতো। ধানমণ্ডি যেমন একটা ব্লক, গুলশান এলাকা একটা ব্লক— সুপার ব্লকের মতো। আমি যদি ধানমণ্ডির বাচ্চাগুলোকে ধানমণ্ডির স্কুলে পড়াতে পারতাম— তাহলে হেঁটেই স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেত। কিংবা হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।

একটি পুরো এলাকার যদি স্বয়ংসর্ম্পূণতা থাকে— গুণগতমান নিশ্চিত করা যায় তাহলে ধানমণ্ডির বাচ্চাকে পড়াতে উত্তরা নিয়ে যেতে হয় না। এমন অবস্থার কারণে আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সময়-অর্থ-পরিবেশ— সবকিছুরই ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। সুতরাং শহরে এক একটা ব্লক এবং সেটার মধ্যে হাঁটার যোগ্যতা— এটাকে এখন গুরুত্ব দেওয়া হয়।

সেই হিসেবে আমরা যদি ঢাকার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি চিন্তা করি— এটাকে চাইলে গোছানো যায়। এখনও সেই সময় আছে— সুযোগও আছে। জনঘনত্বকে নিয়ন্ত্রণ করেই হোক— সেবাগুলো যথাযথভাবে নিশ্চিত করে হোক— এভাবে আমরা কাজটি করতে পারি।

সকাল সন্ধ্যা: নগর নকশা কেমন হওয়া দরকার এই সময়ে সেটি নিয়ে বললেন। এই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাটি স্থাপত্য নকশায় কতটা ভাবা হচ্ছে? আপনি বললেন যে, আপনার নকশা ভাবনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাটি নানাভাবে বিবেচনা করে প্রয়োগ করছেন…

মেরিনা তাবাসসুম: জলবায়ু পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অবকাঠামো ও নির্মাণখাত দখল করে আছে। ভবন ও নির্মাণখাতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন তৈরি হয়। এর কিছু কারণও আছে। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ নির্মাণ কাজ হয়েছে বিশেষ করে গত ২০-৩০ বছরে— বন-জঙ্গল কেটে শহরের জন্য জায়গা করা। কিংবা ফসলি জমি নষ্ট করে সেখানে আমরা নির্মাণ কাজ করছি।

একটা শহরে যতটা ভবন প্রয়োজন তার থেকে অনেক বেশি ভবন নির্মাণ হয়েছে। যাদের জন্য বাসস্থান দরকার তাদের জন্য তৈরি না করে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য একের পর এক ভবন তৈরি হচ্ছে। একজন স্থপতি হিসেবে আমি মনে করি, শহরের প্রেক্ষাপটে আমাদের দরকার সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন— যেটা এখনও হয়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন তো আসলে একটা ঘটনা না— এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনুমান করা যায় না এমন বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনও হচ্ছে। আমাদের যারা কৃষিকাজ করেন, এর সঙ্গে জলবায়ুর ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। এটা যখন ঠিক থাকছে না তখন তার ফসলে সমস্যা থাকছে। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে— তারা শহরে আসছে কাজের খোঁজে। এ অবস্থায় না তাদের কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে, না তাদের বাসস্থান দেওয়া যাচ্ছে।

এটা কিন্তু সম্পূর্ণ একটা চক্রের মতো। ফলে সেখানে স্থাপত্যের একটি বিষয় চলে আসে। তার সেই বাসস্থান কি ঢাকায় হবে নাকি ঢাকার বাইরে হবে? তার কর্মসংস্থানকে কীভাবে আরও বহুমুখী করা যায় সেসব ভাবতে হবে। একজন স্থপতি শুধু ঘর বানায় তা না, এর সঙ্গে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি।

একজন স্থপতির সেই ক্ষমতা রয়েছে যে পরিবর্তনের জন্য সে একজন প্রতিনিধি হতে পারে। এর সঙ্গে আর যারা যুক্ত আছেন, তাদেরকে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। এই মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা একটা ফাউন্ডেশন করেছি। আমরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে এই কাজটি করার চেষ্টা করছি।

খালা-খালুর জন্য মেরিনা তাবাসসুমের নকশা করা বাড়ি ‘এনইকে ১০’। আলোকচিত্র সৌজন্য: মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস।
যশোরে পানিগ্রাম ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’তে মাটির বাড়ি। আলোকচিত্র সৌজন্য: মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস।

সকাল সন্ধ্যা: গত শতকের নব্বইয়ের দশকের দিকে খালা-খালুর বাড়ির নকশা আপনাকে স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলল। এরপর নানা ধরনের নকশায় আপনি যুক্ত হয়েছেন। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি আপনার আগ্রহ সেই সময় থেকে এখন কতটা প্রসারিত হয়েছে?

মেরিনা তাবাসসুম: আমার খালা-খালুর বাড়ির নকশা আমার কর্মজীবনের প্রথমদিকের কাজ। ওই সময় আমার কাজের কোনও পোর্টফোলিও ছিল না। সেই সময় তারা আমাকে কাজটি করতে দিয়েছিলেন। সেখানেও মূলত বাতাসের প্রবাহ, স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার আর ভবন নকশাটি আরও সমকালীন চিন্তাভাবনার সঙ্গে করা।

সেখান থেকে আমার এখন পর্যন্ত খুব পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। এই যাত্রার সঙ্গে আরও নতুন নতুন বিষয় যুক্তই হয়েছে। এরপর যখন পানিগ্রাম রিসোর্ট করতে গিয়ে সেখানে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কাজ করা— মাটির বাড়ি নিয়ে কাজ করা— এমন আরেকটি বিষয় যুক্ত হলো। মাটি নিয়ে কাজ করার সুযোগ হলো। নানাভাবে মাটি নিয়ে কাজ করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কম হয়।

বাঁশ নিয়েও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের শরণার্থী শিবিরেও কাজ করেছি এই বাঁশ দিয়ে। চরাঞ্চলে আমরা যে ঘরগুলো করেছি সেগুলোতে বাঁশের ব্যবহার হয়েছে। স্থানীয় উপকরণ ও প্রাকৃতিক উপকরণ নিয়ে যতটা প্রচার করা যায় সেটা চেষ্টা করছি।

খালার বাসা থেকে শুরু করে এখনো চরে যে বাড়ি বানাই সেটার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে উপকরণের ব্যবহার— এটা একটা পরিবর্তন বলা যায়। আগে বিষয়টি স্থির ছিল— আর এখন অনেক বেশি ভ্রাম্যমাণ।

ওটাকে ছোট ঘর দেখে আমরা ‘খুদি বাড়ি’ বলি। এই বাড়ি আমরা বিভিন্ন চর ও বিভিন্ন জায়াগায় বানিয়েছি। জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জে আমরা এই বাড়ি বানিয়েছি যেখানে মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেঘনার বিভিন্ন চরেও বানানো হয়েছে এই বাড়ি। এই বাড়ির সুবিধা হলো— এটা এক জায়গা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করা যায়। এই বাড়িতে দুইটি তলা আছে। ফলে বন্যা হলে ওপরের তলায় আশ্রয় নেওয়া যায়। তাহলে অন্তত এই বাড়ি থেকে মানুষদের চলে যেতে হবে না।

সকাল সন্ধ্যা: সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশি টাকায় ৫০,০০০ হাজার টাকাখরচ করে বানভাসী মানুষদের জন্য যে ভ্রাম্যমাণ বাড়ির নকশা করেছেন সেটিও তো এই অভিজ্ঞতারই অংশ…

মেরিনা তাবাসসুম: ওটাকে ছোট ঘর দেখে আমরা ‘খুদি বাড়ি’ বলি। এই বাড়ি আমরা বিভিন্ন চর ও বিভিন্ন জায়াগায় বানিয়েছি। জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জে আমরা এই বাড়ি বানিয়েছি যেখানে মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেঘনার বিভিন্ন চরেও বানানো হয়েছে এই বাড়ি। এই বাড়ির সুবিধা হলো— এটা এক জায়গা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করা যায়। এই বাড়িতে দুইটি তলা আছে। ফলে বন্যা হলে ওপরের তলায় আশ্রয় নেওয়া যায়। তাহলে অন্তত এই বাড়ি থেকে মানুষদের চলে যেতে হবে না।

চরাঞ্চলে করা ‘খুদি বাড়ি’। বানভাসী মানুষদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ এই বাড়ির নকশা করা হয়েছে। আলোকচিত্র: সিটি সিনট্যাক্স। সৌজন্য: মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস।

সকাল সন্ধ্যা: এর সূত্র ধরে জানতে চাই, বায়তুর রউফ জামে মসজিদ প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন, এ অঞ্চলের সুলতানি আমলের মসজিদের ঐতিহ্য আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এছাড়া এই মসজিদ নকশা করতে গিয়ে আর কোন বিষয় ও বিদ্যা আপনি গুরুত্ব দিয়েছেন?

মেরিনা তাবাসসুম: এই মসজিদটি নকশা করতে গিয়ে অনেক বিষয়কে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রথমেই যে প্রশ্নটা ছিল, যেটা আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম ও গবেষণা করলাম, আসলে মসজিদের উৎপত্তি কোথা থেকে? আমাদের নবীজী প্রথম যে মসজিদটি তৈরি করেছিলেন সেটা কী ছিল— কী কারণে মনে হলো এমন একটি স্থান তৈরি করা প্রয়োজন। এখান থেকেই মূলত শুরু।

সে কারণে আপনি দেখবেন, আমার নকশা করা এই মসজিদে কোনও গম্বুজ বা মিনার রাখিনি। তাছাড়া আমার বাজেটও কম ছিল। তার থেকেও বড় বিষয় হলো, এ রকম একটা শহুরে পরিস্থিতিতে যেখানে মসজিদটি বানানো হয়েছে, সেটা খুবই জনঘনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানে ভবনের উচ্চতা মিনারের উচ্চতা থেকে উপরে উঠে যাবে— সেখানে আসলে একটি মিনার বানিয়ে পয়সা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

আর নবীজীর মসজিদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে একসঙ্গে আনা— একত্রিত করা। ইসলামের যে মূল্যবোধগুলো আছে সেগুলো নিয়ে কথা বলা। শুধু যে এটা নামাজের জায়গা ছিল তা নয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের সম্প্রদায়ের সামাজিক অনুষ্ঠান হতো। এছাড়া প্রশাসনিক, বিচারিক ও কূটনৈতিক কাজও নবীজী মসজিদে বসে করেছেন। এইভাবে চিন্তা করলে একটি মসজিদকে শুধু নামাজের জন্য ব্যবহার হবে তা নয়— এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও অনেক কিছুই এই স্থানে করা যায়।

এই কারণে আমারও একটা উদ্দেশ্য ছিল, মসজিদের নকশাটা যেন এমনভাবে হয় যে এটা অন্যভাবে ব্যবহার করলেও— আমি যদি ছোট্ট একটি স্কুল পরিচালনা করতে চাই বা একটা কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চাই সেটাও যেন সম্ভব হয়। আর পরিস্থিতিটা এমন যে, যেখানে বাড়িঘর হয়ে গিয়েছে— একটা মানুষের যাওয়ার বা বসার কোনও ব্যবস্থা নেই, সেখানে যেন স্থানটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এরকম চিন্তা থেকে এই মসজিদটি করা হয়েছে।

ঢাকার দক্ষিণখানের ফায়েদাবাদে বায়তুর রউফ জামে মসজিদ। ২০১৬ সালে এই মসজিদ নকশা করার জন্য মেরিনা তাবাসসুম পেয়েছেন ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’। প্রাকৃতিক আলোর বিচরণ এ স্থাপত্যকে দিয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আলোকচিত্র: স্যান্ড্রো দি কার্লো দারসা। সৌজন্য: মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্য যদি আমরা দুটি কাজ দিয়ে বুঝতে চাই, তাহলে তার একটি হলো স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের নকশা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল ভবন। অন্যটি লুই আই কানের নকশা করা জাতীয় সংসদ ভবন। এই দুই কাজে স্থান বন্টনের যে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, সেটি কতটা প্রভাব রেখেছে পরবর্তী সময়ের স্থাপত্যকর্মে?

মেরিনা তাবাসসুম: বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই দুইজনের বিরাট প্রভাব আছে। স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের নকশা করা চারুকলা অনুষদের ভবনই যদি আমরা ধরি— তার করা প্রথম কাজ— সেখানে যদি আপনি দেখেন, ভবন যেভাবে তিনি নকশা করেছেন— তার যে স্থিতিবোধ— পুরো দক্ষিণটা তিনি খুলে দিয়েছেন যেন বাতাসটা নেওয়া যেতে পারে।

একটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধুনিক ভবন কেমন হতে পারে এটার একটা প্রথম উদাহরণ হিসেবে কিন্তু আমরা এটাকে নিয়েছি। এটা কিন্তু বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রথম ভবন। একেবারেই নতুন একটা কাজ। এখন পর্যন্ত স্থাপত্যের স্কুল, শিক্ষার্থী ও স্থপতিদের কাছে এটা অনুপ্রেরণা দেওয়া একটি প্রকল্প। আমরা ক্রমাগত এর কাছে ফিরে যাই। কীভাবে বাতাসটা তিনি ভবনের ভেতরে আনছেন, সূর্যের আলো এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন যেন তাপ তৈরি না হয়। এছাড়াও ভবনে যে স্থাপত্যের ভাষা সেটা এখনও আমাদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছে— নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে।

সংসদ ভবনের ভেতরে যে স্থান বিন্যাস ও আলোর ব্যবহার— এটা থেকে তো আমি খুবই অনুপ্রাণিত। আমি তো মনে করি, এই ভবনটি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি একজন স্থপতি হিসেবে। আমি নিজেও সবসময় চেষ্টা করি কীভাবে আমার নকশা করা ভবনে স্থানের বিন্যাস ও আলোর খেলা হবে; বা আলো যে একটা আধ্যাত্মিক চরিত্র তৈরি করতে পারে একটা ভবনে— একটা নিস্তব্ধতা নিয়ে আসে, নীরবতা নিয়ে আসে— সেটা কিন্তু কানের কাছ থেকেই শেখা।

লুই আই কানের ভবনের একটা আকার আছে শহরের প্রেক্ষাপটে— দেশের প্রেক্ষাপটে। এই ভবনের একটি উপস্থিতি আছে। তারওপর এই ভবন ‘ডিগ অ্যান্ড মাউন্ড’ পদ্ধতিতে করা হয়েছে—যেটা নিয়ে কান খুব অনুপ্রাণিত ছিলেন। একটা সমতল ভূমিতে মানুষ যখন বাড়ি করে তখন প্রথমে পুকুর খনন করে। পুকুর থেকে মাটি উঠিয়ে নিয়ে উঁচু একটা স্তম্ভমূলস্থ চতুষ্কোণ পীঠিকাবিশেষ বানিয়ে ভবনটি বানায়। কানও কিন্তু কিছুটা এই পদ্ধতিতে গিয়েছেন। আসলে দেশ-সংস্কৃতির বিষয়টি দুইজন দুইভাবে উপস্থাপন করেছেন।

সংসদ ভবনের ভেতরে যে স্থান বিন্যাস ও আলোর ব্যবহার— এটা থেকে তো আমি খুবই অনুপ্রাণিত। আমি তো মনে করি, এই ভবনটি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি একজন স্থপতি হিসেবে। আমি নিজেও সবসময় চেষ্টা করি কীভাবে আমার নকশা করা ভবনে স্থানের বিন্যাস ও আলোর খেলা হবে; বা আলো যে একটা আধ্যাত্মিক চরিত্র তৈরি করতে পারে একটা ভবনে— একটা নিস্তব্ধতা নিয়ে আসে, নীরবতা নিয়ে আসে— সেটা কিন্তু কানের কাছ থেকেই শেখা।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যে মাজহারুল ইসলাম ও লুই আই কানের প্রভাব সম্পর্কে আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। এবার যদি আমাদের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যকে আরও একটু বড় পরিধিতে দেখি তাহলে দেখবে যে, বিশ শতকের আধুনিক স্থাপত্যের ধারণায় দুইটি প্রভাবশালী প্রবণতার একটি হলো জার্মানির বাউহাউজ, আরেকটি জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্থাপত্য। এই দুই প্রবণতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নিখুঁত আকার আর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নূন্যতম। বাংলাদেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধুনিক স্থাপত্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করা কাজগুলোতে এই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি আছে বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

মেরিনা তাবাসসুম: ১৯৪৭-৪৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন বিদেশি স্থপতিকে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়। কনস্ট্যানটিনস অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিসকে নিয়ে আসা হয়েছিল। রিচার্ড নওয়েট্রাও এসেছিলেন। পল রুডল্ফ, স্ট্যানলি টাইগারম্যান, লুই আই কান এসেছেন। লে করবুসিয়ার চণ্ডীগরের নকশা করেছেন। জেফ্রি বাওয়া নিজেই একটি স্কুল। ওই সময় এখানে যারা ছিলেন তারা সবাই আধুনিক স্থাপত্যের শিক্ষা নিয়েছেন। এই শিক্ষার সঙ্গে বাউহাউস নানাভাবে যুক্ত ছিল।

সকাল সন্ধ্যা: এই অবস্থার সঙ্গে আপনি আমেরিকান ড্রিমকেও কি মিলাতে পারেন…

মেরিনা তাবাসসুম: ওই সময় তো ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনেক আর্থিক সহায়তা ছিল। ফলে ওই সময় যারা এসেছেন বা এখানে যারা স্থাপত্যের শিক্ষা নিয়েছেন তারা কিন্তু সবাই এসে এখানকার জলবায়ু বুঝে কাজ করেছেন। রিচার্ড নওয়েট্রার আমেরিকায় করা ভবন আর বাংলাদেশে করা ভবনে পার্থক্য রয়েছে। তিনি কিন্তু ভেবেছেন এখানে একটি উন্মুক্ত ভবন হবে। এখানে তাপমাত্রা উঠানামা করে।

করবুসিয়ারের কাজ প্যারিসে একরকম— চণ্ডীগরে আরেকরকম। ওই সময়ে তারা যথেষ্ট সংবেদশীলভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আর স্থাপত্যে নিজ ভাষা প্রকাশের ক্ষেত্রে স্থপতির স্বাধীনতা তো থাকেই— তাদেরও ছিল।

সকাল সন্ধ্যা: আলো আপনার স্থাপত্য নকশায় গুরুত্ব পায়। লুই আই কানের জাতীয় সংসদ ভবন থেকে আপনি অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা বলেছেন। তবে আমাদের স্থানীয় স্থাপত্যেও আলো ও বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করার ঐতিহ্য রয়েছে। আপনার নকশার সঙ্গে এই ঐতিহ্য কোনভাবে যুক্ত বলে আপনি মনে করেন?

মেরিনা তাবাসসুম: আমি যখন নকশা শুরু করি সেটা প্রথম থেকেই থাকে। এটা কখনই আমার কাছ থেকে আলাদা হয় না। আমি যখন ড্রইং করা শুরু করি— চিন্তা করি— সূর্যের অবস্থান চিন্তা করি— এই প্রক্রিয়াটি আমার ভেতরেই আছে।

সকাল সন্ধ্যা: স্থাপত্যেআলো বা বাতাসের ভাষা কেমন হওয়া দরকার— সেটি নিয়ে তো আপনার ভাবনা-চিন্তা থাকেই…

মেরিনা তাবাসসুম: অবশ্যই। ভবনটা আমি যখন নকশা করি— সেকশনটা চিন্তা করি— কোনদিকে আলো ভবনে ডুকবে এবং সেটার সেকশনটা কীভাবে তৈরি হবে— সেটার ছায়া কীভাবে তৈরি হবে— এটার সঙ্গে কী ধরনের তল হবে— কী ধরনের তল আমি চাই। এই কাজটি যখন আমি করছি, তখন আমি চিন্তা করি— এই কাজটি আমি কোন জায়গার জন্য করছি। ওই জায়গাতে কী ধরনের পরিবেশ প্রয়োজন— এটার আবহটা কেমন হবে। তাহলে এই আলোটা কোথা থেকে আসবে— উপর থেকে আসবে না অন্যসূত্র থেকে আসবে।

সকাল সন্ধ্যা: সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেছেন, আপনি স্থানীয় উপকরণকে প্রাধান্য দেন। এখন আপনি স্থানীয় প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে স্থাপত্য নকশার বিষয়ে আরও মনোযোগী। এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই।

মেরিনা তাবাসসুম: গত ১০ বছর ধরে যখন কাজ করছি, কিংবা যখন থেকে কাজ শুরু করেছি— তখন থেকেই দেখছি চারদিকে কাচের ভবন উঠছে। আর এটাও আমি জানি যে, এটা কাজ করে না আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। আমাদের জলবায়ুর সঙ্গেও এটা যায় না। যে মুহূর্তে একটি তল গ্লাস দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়— সেটা খোলার কোনও উপায় থাকে না। যে তাপপ্রবাহ ভবনে ঢুকছে সেটিও বের করা যায় না— বন্দি হয়ে থাকে। ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই তাপমাত্রা কমানোর একমাত্র উপায় হলো এয়ারকন্ডিশনিং করা। ফলে একটি ভবন পুরোপুরিভাবে কৃত্রিম ও যন্ত্রনির্ভর হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে যেখানে সবাই সমানভাবে বিদ্যুৎ সুবিধা পায় না সেখানে একটা ভবনকে ঠাণ্ডা করার জন্য এত বিদ্যুতের ব্যবহার আমি মনে করি অন্যায়। কারণ এমন ভবনে কাচ ব্যবহারের প্রয়োজনই ছিল না। এটাকে যদি এক ধরনের প্রতীকী অগ্রসর হওয়া বোঝায়— তাহলে প্রশ্ন করা দরকার এই অগ্রসর হওয়াটা আমার প্রয়োজন আছে কিনা। তাই আমার সবসময় মনে হয়েছে, এমন কিছু করা উচিত না যেটা আমি সবসময় পশ্চিমে দেখছি।

এই কারণে স্থানীয় উপকরণ, স্থানীয় প্রযুক্তি, স্থানীয় জলবায়ু— এটাকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি সেই ভাবনাটা আমার থাকে। সাধারণ উপকরণকে কীভাবে আমি সমকালীন চেহারা দিতে পারি সেটা নিয়েও আমার চিন্তাভাবনা কাজ করে।

আমাদের দেশে যেখানে সবাই সমানভাবে বিদ্যুৎ সুবিধা পায় না সেখানে একটা ভবনকে ঠাণ্ডা করার জন্য এত বিদ্যুতের ব্যবহার আমি মনে করি অন্যায়। কারণ এমন ভবনে কাচ ব্যবহারের প্রয়োজনই ছিল না। এটাকে যদি এক ধরনের প্রতীকী অগ্রসর হওয়া বোঝায়— তাহলে প্রশ্ন করা দরকার এই অগ্রসর হওয়াটা আমার প্রয়োজন আছে কিনা। তাই আমার সবসময় মনে হয়েছে, এমন কিছু করা উচিত না যেটা আমি সবসময় পশ্চিমে দেখছি।

সকাল সন্ধ্যা: প্রকৃতি রক্ষায় এখন নানাভাবে গ্রিন বিল্ডিংকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন স্বীকৃতি পাওয়ার আয়োজন রয়েছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতি রক্ষার অঙ্গীকার কতটা সম্পৃক্ত?

মেরিনা তাবাসসুম: এগুলো তো সবই ইন্ডাস্ট্রির তৈরি করা। এগুলো কীভাবে তৈরি হয়, কারা তৈরি করে সে বিষয়ে আমার ভালো ধারণা নেই। হ্যাঁ, আমরা সবাই চাই একটা গ্রিন প্রযুক্তির দিকে যেতে।

যাদের এই ধরনের ভবন আছে তারা সবাই জানে যে, আমরা এমন স্বীকৃতি পেলে ধরে নিই যে, আমার ভবনটা ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে। কিন্তু এটা আমি ঠিকভাবে জানি না যে, এই সার্টিফিকেশন, এই স্বীকৃতি কতটা আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য হয়ে আসে। কারণ আমাদের দেশে এখনও আমাদের মতো করে গ্রিন সার্টিফিকেশনের কোনও প্রক্রিয়া নেই। অন্য দেশের যে মাপকাঠি সেটা তো আমার দেশের মাপকাঠি না। এটা এখনও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়নি। ফলে এই বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার দরকার আছে।

গ্রিন বিল্ডিংয়ের জন্য উপকরণগুলো কারাখানায় তৈরি হয়। আর জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করা, কার্বন কম তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমাদের এত ভবন তৈরির দরকার আছে কিনা সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করা। এত ভবন তৈরি হচ্ছে আসলে পণ্য হিসেবে। মুনাফা করার জন্য এত ভবন তৈরি হচ্ছে। ফলে আমাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবুজায়নের জন্য আমাকে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতে হবে।

দ্বিতীয়ত, উপকরণ স্থানীয়ভাবে তৈরি করা দরকার। দীর্ঘ সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। তাহলে কার্বন কম তৈরি হবে। স্থানীয় প্রযুক্তি ও জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। বর্জ্যকেও কাজে লাগাতে হবে সঠিকভাবে।

সকাল সন্ধ্যা: শান্তিনগরে আপনার বেড়ে ওঠা। আপনি এই শহর ঢাকাকে নানাভাবে পরিবর্তন হতে দেখেছেন। এই পরিবর্তনকে আপনি কোনভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মেরিনা তাবাসসুম: শহর তো বাড়ছে। যুদ্ধের সময় থেকেই মানে সত্তর দশক থেকে আমার এই শহর দেখা। আমার জন্ম ঢাকায়— শান্তিনগরে। তখনকার ঢাকা আর এখনকার ঢাকা তো এক না। ওই সময় আমরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। বাসার কাছেই ছিল স্কুল। রাস্তা পার হলেই স্কুলে চলে যাওয়া যেত। খোলা মাঠ ছিল। বাবা-মাও ঠিকমতো জানত না ছেলে-মেয়েরা কোথায় খেলছে। এ রকম একটা পরিবেশ ছিল যেখানে পাড়ার একটি ব্যাপার ছিল, সমাজ বলে একটা ব্যাপার ছিল। যেটা এখন তো খুব একটা দেখা যায় না।

আমি মনে করি যে, ঢাকাকে কেউ নিজের শহর মনে করে না। অন্তত মফস্বল কোনও শহর বা চট্টগ্রামে গেলেও দেখবেন তারা তাদের শহরটাকে নিজের মনে করে। সুযোগ খুঁজতে সবাই ঢাকায় আসে। সবাই ঢাকা থেকে নেয়। ঢাকাকে কেউ কিছু দেয় না। আমি যে ঢাকাকে নিজের শহর হিসেবে গ্রহণ করব সেটা আমি এখন দেখি না।

আমি মনে করি যে, ঢাকাকে কেউ নিজের শহর মনে করে না। অন্তত মফস্বল কোনও শহর বা চট্টগ্রামে গেলেও দেখবেন তারা তাদের শহরটাকে নিজের মনে করে। সুযোগ খুঁজতে সবাই ঢাকায় আসে। সবাই ঢাকা থেকে নেয়। ঢাকাকে কেউ কিছু দেয় না। আমি যে ঢাকাকে নিজের শহর হিসেবে গ্রহণ করব সেটা আমি এখন দেখি না।

সকাল সন্ধ্যা: প্রায় ৩০ বছর ধরে স্থাপত্যচর্চা করছেন। প্রখ্যাত স্থপতি আপনি। আপনার নকশা ও স্থাপত্য ভাবনা কতটা বিবর্তিত হয়েছে? অবশ্য আপনি বলেছেন, খুব একটা পরিবর্তন হয়নি আপনার কাজে ও চিন্তায়।

মেরিনা তাবাসসুম: আমি মনে করি এটা একটা ধারার মতো— এটা একটা যাত্রা বা ভ্রমণের মতো। একটা বিশ্বাস নিয়ে শুরু করা। সেই সময়ে যে মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি সেটাতে খুব একটা পরিবর্তন দেখি না।

আমি কথা ও চর্চার মধ্যে মিল রাখার চেষ্টা করেছি। আমি যেটা বিশ্বাস করি, সেটা আমার ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর চেষ্টা করেছি। প্রথম দিকে আমার শুধু ভবন নকশাতেই লক্ষ্য ছিল। একটা সময় পর মনে হলো— আমার কিছু দেওয়ার আছে। শিক্ষকতা শুরু করি। এখন প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছি। সেমিনারে যাচ্ছি। ‘আর্কিটেকচারাল কালচারে’ অনেক বেশি সম্পৃক্ত হয়েছি আগের চেয়ে।

সকাল সন্ধ্যা: স্থাপত্যে আপনার প্রকাশের ভাষাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মেরিনা তাবাসসুম: আমার নকশা করা ভবনে দেখা যাবে, উপকরণ এখানে নানাভাবে খেলা করছে। এটাকে আমার ভাষা-চিন্তার প্রকাশ বলতে পারি। প্রায় সময়েই আমার করা স্থায়ী ভবনে ইটের ব্যবহার করি। বিশুদ্ধ জ্যামিতির অনেক ব্যবহার হয় আমার ভবনে। খুব আনুষ্ঠানিকভাবে সবসময় যাই না। তবে আমার চেষ্টা থাকে, ভবনটাকে কীভাবে নিরন্তর সময়ের জন্য করে তুলতে পারি।

‘টাইমলেস’ বিষয়টি এই অর্থে যে, এটার মধ্যে কোনও সময়ের ছাপ থাকবে না। ১০০ বছর পরও এই ভবনটি দেখলে যেন বলা যায়, এটা এখনও সমকালীন— প্রাসঙ্গিক। এটা কিছুটা লুই আই কানের কাছ থেকেও শেখা। তার নকশার ভবনে এই বৈশিষ্ট্য আছে। এটা আমি সবসময় চেষ্টা করি।

সকাল সন্ধ্যা: ভবিষ্যতেও কি এমন থাকবেন?

মেরিনা তাবাসসুম: ভবিষ্যত কত লম্বা সেটা আমি জানি না। আমি এখন যে পর্যায়ে আছি তাতে কতটা পরিবর্তন হবে সেটা আমি বলতে পারব না। তবে মনে হচ্ছে, অনেকটাই এই রকমই থাকবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মেরিনা তাবাসসুম: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত