Beta
বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৫

পানচিনি পেরিয়ে বৌভাতে বিবাহনামা

পানচিনি পেরিয়ে বৌভাতে বিবাহনামা
[publishpress_authors_box]

নিকাহনামা ১

গ্রামের রাতের বেলা নারীদের খুব ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। কেউ ছামে কুটছে, কেউ বাটনা বাটছে, আবার কেউ পান বানাচ্ছে। হারিকেন জ্বালিয়ে কয়েকজন নারী হাতে তালি দিয়ে গান জুড়েছে – ‘কাইল আমরার কুসুম রানির বিবাহ হইব… বিবাহ হইব’।    

হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় এভাবেই ধরা পড়েছে গ্রামের বিয়ে আয়োজন।

নিকাহনামা ২

সিলেটের এক ভ্লগার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে পানচিনি ডালার ভিডিও তুলেছেন। কোনো ডালায় আছে ফল, কোনোটিতে কান, গলা ও হাতের গহনা। একটি ডালায় কারুকাজ করা শাড়ি রাখা; এর সঙ্গে জুতাও আছে। একটি ডালা সাজানো হয়েছে লিপস্টিক, আইশ্যাডোর সঙ্গে আরও নানা প্রসাধনী পণ্য ও চুলের কাঁটা দিয়ে। 

একটি ডালায় রাখা হয়েছে মুরুলি। এক ডালা ভর্তি চকলেট-ক্যাডবেরি, আরেক ডালায় সাজানো রয়েছে নানা রকম মিষ্টি।

একটি বিশেষ ডালা আছে; তাতে থরে থরে রাখা হয়েছে মিষ্টি মশলা ছড়িয়ে তিন কোনা ভাঁজ করা পান। 

নিকাহনামা ৩

অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্টের বিয়ের মাসখানেক আগে থেকে চলা প্রাকবিবাহ অনুষ্ঠানে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্ব মাতিয়ে রেখেছিল আম্বানি পরিবার।

এই বছর জানুয়ারিতে অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্টের বাগদান হয়। এরপর মার্চে টানা তিনদিন ধরে হয় তাদের প্রথম প্রথম প্রি-ওয়েডিং পার্টি। এরপর মে মাসে ইউরোপের একটি ক্রুজে দ্বিতীয় প্রি-ওয়েডিং পার্টি অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানও সাজানো হয় কয়েক পর্বে। ২৯ মে স্বাগত মধ্যাহ্নভোজ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেদিন ‘স্ট্যারি নাইট’ থিমে হয় সন্ধ্যার অনুষ্ঠান। ৩০ মে ছিল অতিথিদের রোম ঘুরে দেখার বন্দোবস্ত। সেদিন ডিনারের পর রাত ১টায় বসে আফটার পার্টি আয়োজন। ৩১ মে অতিথিদের ফ্রান্সের কান ভ্রমণের পর ১ জুন ইতালির পোর্টোফিনোতে শেষ হয় এই প্রাকবিবাহ উদযাপনের দ্বিতীয় পর্ব।

১২ জুলাই বিয়ে করেন অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্ট। শুভ বিবাহ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে ১৪ জুলাই মঙ্গল উৎসব বা সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিবাহ উদযাপন। 

নিকাহনামা ৪

২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে ব্যাংকার সনি পোদ্দারের সঙ্গে আংটিবদল করেন বাংলাদেশি নায়িকা বিদ্যা সিনহা মিম। জানুয়ারি মাসে দুই দিন পরিবার নিয়ে গায়ে হলুদের পর্ব সারেন। এরপর ৪ জানুয়ারি রাজধানীর একটি পাঁচাতারা হোটেলে সনাতন পদ্ধতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

নিকাহনামা ৫  

২০২১ সালে ছাদনা তলায় বসেছিলেন ক্যাটরিনা কাইফ ও ভিকি কৌশল। মেহেদি ও সংগীত একই দিন আয়োজন করেছিলেন তারা। পরদিন ছিল গায়ে হলুদের আয়োজন। আর এর পরেরদিন সাত পাকে বাঁধা পড়েন দুজনে। 


বিয়েবাড়ির ব্যস্ততা

গ্রামে হোক কি শহরে, নিম্নবিত্ত হোক কি ধনাঢ্য – বিয়ে মানেই উজ্জ্বল রঙ আর একান-ওকান হাসির সঙ্গে শশব্যস্ত হয়ে ওঠার ধুম। বলিউডের সিনেমায় দেখানো বিয়েবাড়ির সাজ আর নাচ-গানে ভরপুর আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে ভারত থেকে বাংলাদেশেও। বিয়ের নানা পর্বের নামকরণেও লেগেছে নতুনের ছোঁয়া। 


পাকা কথার পানচিনি  

হলুদ, ধান আর দুর্বা দিয়ে বরপক্ষকে বরণ করে নিল কনেপক্ষ। আশীর্বাদ বিনিময়ের ফাঁকে হলো কথা দেয়ানেয়াও; আসন্ন আষাঢ়ে হবে বিয়ে। ব্যাঙের বিয়ে দিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পানচিনি পর্ব হয়েছিল ২০১৭ সালে।

গ্রামাঞ্চলের বিয়েতে পানচিনি আয়োজন নিয়ে ছুটোছুটো দেখা যেত খুব। পানচিনি মানে পাকাকথা। পানচিনি মানে সেদিন আকদ; মেয়ে দেখতে এসে ছেলেপক্ষ বিয়ে পড়িয়ে গেছে এমন অহরহ হয়। অর্থ্যাৎ পানচিনি মানে সম্পর্কের শুরু। তাই মেয়েপক্ষের আগাম প্রস্তুতিই থাকে পাকাকথা হওয়ার এই দিন ঘিরে।

‘ঢাকাইয়া বিয়ে’ মানে পুরান ঢাকার বিয়েতে পানচিনি আয়োজনেও হাত খুলে খরচ করা হয়। কনেপক্ষ থেকে উপহার পাঠানো হয় বরের বাড়িতে। মিষ্টি আর পান-সুপারির সাজানো ঢালায় বিয়ে খবর পৌঁছে যায় প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও।

পানচিনিতে কনের বাড়িতে বরপক্ষও খালি হাতে আসে না। ডালায় সাজানো উপঢৌকনে থাকে শাড়ি, গহনা, আংটি এবং কয়েক পদের মিষ্টি।  

হিন্দু সনাতন বিয়েতেও পানচিনি অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন তরুণ পুরোহিত অমিতাব আচার্য্য পার্থ।  

পানচিনির আরেক নাম ‘পানখিলি’।

“পানখিলি অর্থই হচেছ এখানে পান থাকবে, সুপারি থাকবে। সুপারি কাটার জন্য যাঁতি থাকবে। অন্তত পাঁচ-সাতজন মহিলা একত্রে  সুপারি কাটবে। পান সঙ্গে রাখবে। মিষ্টি থাকবে। আগে বাতাসা পাওয়া যেত খুব; চিনি-বাতাসা থাকতো। উচ্চবিত্ত পরিবার হলে মিষ্টি নিয়ে আসতো। পানখিলির অনুষ্ঠানে এক ধরনের গীত করতো মহিলারা। আসলে শুভকাজের শুরুটাই হয় পানখিলি দিয়ে।”

বিয়েতে পানখিলি পর্ব গ্রামাঞ্চলেও কমে এসেছে; এমনকি শহরেও তেমন করে চোখে পড়ে না, বললেন অমিতাব আচার্য্য পার্থ।   

বিয়ের অনেক আয়োজনে এখন কাটছাঁট চলে এবং ধরনেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া জানিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হিন্দু বিয়েতে বাদ্যযন্ত্রের উপস্থিতি বেশ প্রবল। যদিও প্রজন্মের পরিবর্তনে গীতের বদলে এখন ডিজে সংগীতও হচ্ছে বিয়েতে।

“আবার মঙ্গলাচরণ দিয়ে বিয়ের সূচনা হতো। এতে কনের জন্য শাড়ি-গহনা সব পাঠানো হতো। এর পরে আসে গায়ে হলুদ। এখন বিয়ের দিনই মঙ্গলাচরণ সেরে ফেলে। মানে ঢাকায় হিন্দু বিয়ে বেশ সংক্ষিপ্ত ভাবে হচ্ছে।”

বাগদান

বাগদান মানে প্রতিশ্রুতি। পশ্চিমা বিয়েতে যেমন এনগেজমেন্ট দেখা যায়, তেমনি বাংলাদেশেও অনেকেই ঘরোয়া ভাবে আংটি বিনিময় করেন। এরপর চলে বিয়ের তারিখ ঠিক করার আলোচনা। বাগদানের পর দ্রুত বিয়ে আয়োজন হতে পারে। আবার অনেকে কয়েক মাস সময় নিয়ে গুছিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

বাগদানের আয়োজন ছোট হোক বা বড়, তারকাদের দেশি-বিদেশি তারকাদের বাগদান মানে বড় শিরোনামের খবর; সেই সঙ্গে সোশাল মিডিয়াতে চলবে সাজগোজ, পোশাক নিয়ে গল্প।

হলুদ বাটো মেন্দি বাটো

পানচিনির পরেই শুরু হয়ে যায় গায়ে হলুদের আয়োজন। আগে একদিন কনের গায়ের হলুদ হতো, আর অন্যদিন হলো বরের গায়ে হলুদ। গত ১৫-২০ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে বর-কনের গায়ে হলুদ একসঙ্গেই আয়োজন করছে অনেকে। বিশেষ করে প্রেমের বিয়েতে বরকনের বন্ধুরা পরিচিত বলে গায়ে হলুদে একসঙ্গে আনন্দ করতে চায় তারা।

গায়ে হলুদ বা ‘গাত্রহরিদ্রা’ পর্বে কাঁচা হলুদ বাটা কপালে ছোঁয়ানো শুভ মানা হয়। আর হলুদের আয়ুর্বেদিক গুণ তো আছেই; এতে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে। বিয়ের সময় বরকনের মুখে বিশেষ দ্যুতি ছড়াতে তাই বন্ধু-স্বজনরা একে একে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে যান। সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসাবে হিন্দু বিয়েতে গায়ে হলুদ পর্বে আরও সাজানো থাকে মেথি, সুন্ধা, সরিষা, চন্দন।

ঘরে হোক বা ছাদে অথবা কমিউনিটি সেন্টারে, বর ও কনেকে সাধারণত মঞ্চে বসানো হয়। সামনে ডালায় আলাদা আলাদা মাটির বাটিতে সাজানো থাকে হলুদ বাটা ও মেহেদি বাটা। মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরোয়া বিয়েতে আনারসের গায়ে কাঠিতে করে আঙ্গুর গেঁথে বসিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় মঞ্চে। এছাড়া হলুদে বর-কনেকে খাওয়ানোর জন্য ছোট ছোট মিষ্টি কাঠিতে গেঁথে সাজানো থাকে। মঞ্চে আরও থাকে বাটি ভরা জর্দা-ফিরনি।

মঞ্চের পেছনে থার্মোকল বা ককশিট কেটে গায়ে হলুদ সন্ধ্যা লেখা দেখা যায় খুব বেশি। অনেকে বাড়ির মেয়েদের রঙিন শাড়ি একটির পর একটি লম্বা করে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে মঞ্চ সাজায়। বর ও কনের কোলে হলুদ রঙের মোটা তোয়ালে বিছানো থাকে, যেন হলুদ কাপড়ে লেগে না যায়।

অনেকে মজা করে একটু বেশি বেশি হলুদ ঘষে দেন কনে ও বরের কপালে; তাই বাড়তি হলুদ মুছে নিতে পাশে টিস্যুর ঢাউস বাক্সও রাখা থাকে।

আগে হলুদের অনুষ্ঠান অনেকখানি ঘরোয়া হলেও, এখন গায়ে হলুদেও শাড়ি, গহনা, খাওয়া এবং নাচগানে বেশ খরচা করার চর্চা চলছে। এখন হলুদে কনে ও বরের বন্ধুস্বজনরা আগেই পরিকল্পনা করে এক রঙ ও নকশার শাড়ি-পাঞ্জাবি পরছে।

একই দিনে মেহেদি ও সংগীত আয়োজন করেছিলেন ক্যাটরিনা কাইফ ও ভিকি কৌশল

মেহেদি নাইট

বিয়ের সময় কনের হাতে মেহেদি পরানোর চল বহু পুরনো। আসলে হলুদের আসরেই মেহেদি পর্ব হয়ে যেত। কিন্তু সামর্থবানরা আজকাল মেহেদির জন্যও আলাদা করে আয়োজন করছেন।

মেহেদি শরীর শীতল রাখে। বিয়ের ব্যস্ততায় মানসিক চাপ থেকেও মুক্তি মেলে মেহেদির সুবাসে। গ্রাম থেকে শহরের বিয়েতেও তাই হাতে মেহেদি পরে কনে থেকে কনের বোন এবং নারী বন্ধু-স্বজনরা।

কনের হাতে মেহেদির নকশার ভেতরে লুকানো থাকে বরের নাম। সিনেমা থেকে বাস্তবের বিয়েতেও এমন হচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশেও।

কেমিকেল মেহেদিতে রঙ অনেক গাঢ় হয়। উৎসবে আর বিয়েতে অনেকেই এমন মেহেদি দিচ্ছেন। যদিও বলিউডের ক্যাটরিনা কাইফের শর্ত ছিল কেমিকেল ছাড়া মেহেদি দেবেন হাতে। আর তাই রাজস্থানের সোজত জেলা থেকে লাখ টাকায় মেহেদি আনিয়েছিলেন তিনি।

কনের বোন কি বান্ধবী অথবা প্রতিবেশী থেকে কেউ এসে মেহেদির কারুকাজ করিয়ে দিত হাতে; আগে এমনই হতো। এরপর বিউটি পার্লারে কনের মেকআপের পাশাপাশি মেহেদিও যোগ হলো। আজকাল অনেক পেশাদার মেহেদি আর্টিস্ট বা উদ্যোক্তা আছেন যারা দুই হাত ভরে নকশা এঁকে দেন।

বিয়ের গীত থেকে সংগীত নাইট

গ্রামাঞ্চলের সংস্কৃতিতে বিয়ের গীত মানে পুরোপুরি নারীদের দখলেই থাকত সেই আয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন বিয়েতে হেলেদুলে, ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার মতো ঝুঁকে ঝুঁকে বিয়ের গীত হতো, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, সিলেট, পুরান ঢাকাতেও আছে বিয়ের গীতের তেমন ইতিহাস। গ্রামে গ্রামে ‘গীত গাওনি’ মেয়েদের ডাক পড়ত বিয়েতে।

বিয়ের গানে রঙ্গরস, হাসি-তামাশা এমনকি বিদ্রুপও থাকে ছন্দে ছন্দে। নাটক-সিনেমায় অনেকের শোনা ‘লীলাবালি লীলাবালি ভরা যুবতী সইগো কী দিয়ে সাজাইমু তরে’ একেবারেই গ্রামগঞ্জের বিয়ের গীত। ২০২১ সালে এক তরুণীর বিয়ের নাচ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসকের নাচের ভিডিও ভাইরাল হয় ফেইসবুকে; ওই জনপ্রিয় ‘আইলো রে নয়া দামান’ হলো সিলেট অঞ্চলের বিয়ের গীত।

ফার্সি শব্দ মিরাশিন নামে বিয়ের গানের দল দেখা যেত পুরান ঢাকায়। এরা উর্দু-হিন্দি মিশেলে মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতো। পানচিনি, গায়ে হলুদ থেকে বিয়েতেও গান গাইতো মিরাশিন দল। কিন্তু এখন মিরাশিন সংস্কৃতি বিলুপ্ত বলেই ধরে নেয়া হয়।

‘গাও হ্যালানি দিয়া নাচ রে গোলাপী, চুল হ্যালানি দিয়া নাচ রে গোলাপী’ হলো রংপুরের বিয়ের গীত। জলচৌকিতে বসে থাকা কনের গায়ের উপর হেলে হেলে আর ঝুঁকে ঝুঁকে একদল মেয়ে থেকে মধ্যবয়সী নারীর বিয়ের গীত গাওয়ার রেওয়াজ উঠে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ থেকেও।

শহরে কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক ঘরোয়া আচার-সংস্কৃতি বাতিলের পথে যেতে শুরু করে। দশ-পনের বছর আগেও পাড়ায় বাড়ির ছাদে বিয়ের আয়োজনে রাতদুপুর পর্যন্ত ধুমধাড়াক্কা গান বাজতো; তাতে প্রতিবেশীদের থেকে অভিযোগও উঠতো বলে এমন আয়োজনও কমে গেছে।

এসবের ফাঁকে বিয়েতে ডিজে পার্টির চল হয়েছিল। হালে অনেকে সংগীত নাইট আয়োজন করছেন কমিউনিটি সেন্টার, নিজেদের সুবিশাল বাড়ি অথবা রিসোর্টে। তারকাদের বিয়ে সংগীত পর্ব থাকে, মধ্যবিত্ত থেকে বিত্তবানদের বিয়েতেও থাকছে নিজ নিজ বাজেট অনুসারে সংগীত সন্ধ্যা।

মুরুব্বীরা বলছেন, আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি জুড়ে ছিল বিয়ের গীত; আর নতুন প্রজন্মের রয়েছে বিয়েতে সংগীত নাইট।

আকদ মানেই বিয়ে

আকদ অথবা নিকাহ হলো আরবি শব্দ। আকদ মানে চুক্তি করা। কেউ কেউ বলে কাবিন হয়েছে। আকদ, নিকাহ অথবা কাবিন মানে হচ্ছে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

টেন মিনিটস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক এবং ইংরেজি প্রশিক্ষক মুনজেরিন ২০২৩ সালে শহীদ মিরপুর ডিওএইচএস মসজিদে পরিবার ও নিকট স্বজনদের নিয়ে আকদ সেরেছিলেন।

কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজনে মানুষ বেশি থাকে বলে শহরে বেশিরভাগ সময় বর-কনের পরিবারের কাছের স্বজনরা মিলে দিনের শুরুতে সাদামাটা ভাবে আকদ অর্থ্যাৎ কাবিন সেরে ফেলে। সাধারণত বাড়িতেই বিয়ে পড়ানো হয়। এরপর সাজগোজ করে কমিউনিটি সেন্টারে অতিথিদের মাঝে হাজির হয়ে চলে ছবি তোলা ও খাওয়াদাওয়ার পর্ব।

বৌভাত

বিয়ের এক কি দুইদিন পর সাধারণত বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করা হয়। ইংরেজিতে নিমন্ত্রণ কার্ড ছাপালে লেখা হয় ‘রিসেপশন’ আর বাংলায় হলে মুসলমান পরিবারে ওয়ালিমা লেখার চল অনেকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে। তবে গ্রামে এই আয়োজন বৌভাত নামেই চেনা।

দেশেও ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ হাওয়া

২০১৪ সাল থেকে যাত্রা শুরু করেছে বিয়ের অনুষ্ঠানে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘আয়োজক’। আয়োজকের কার্যালয় রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায়।

সকাল সন্ধ্যার কাছে আয়োজকের নির্বাহী প্রধান আরাফাত হোসেন রিফাত জানালেন, আজকাল দেশেও অনেকে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

হলিউড থেকে বলিউড সিনেমায় ডেস্টিনেশন ওয়েডিং দেখানো হয়। এই আয়োজন শুধু সিনেমার হয়েই থাকে না যদিও। বাস্তবেও স্বপ্নের বিয়ে স্বপ্নে মতো করে আয়োজনে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং হয়ে উঠছে তারকাদের গন্তব্য। যেমন, ইতালির লেক কোমো থেকে শুরু হয়েছিল দীপিকা পাড়ুকোন এবং রণবীর সিংয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। তাদের আগে তারকা দম্পতি বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মাও বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ইতালি।

বাংলাদেশে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং কোথায় হচ্ছে?

আরাফাত হোসেন রিফাত বললেন, “আমরা এখন ডেস্টিনেশন ওয়েডিং অনুষ্ঠান বিভিন্ন রিসোর্টে করছি।

“এখানে তিন দিনের মতো আয়োজন হয়। হলুদ, গানের অনুষ্ঠান করে আর বিয়ের অনুষ্ঠান। বরপক্ষ, কনেপক্ষ ওখানেই থাকছে।”

“দেড়-দুই বছর থেকে ঢাকাতেই এ ধরনের আয়োজনে আগ্রহী পাচ্ছি আমরা। আর ওয়েডিং ফটোশুট হয়তো ঢাকার বাইরে যেমন কক্মবাজারে করতে চান কেউ কেউ।”

ঘরোয়া আয়োজন থেকে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং আয়োজনে কেমন বাজেট হয়?

খরচ পুরোপুরি স্থান, খাবার, সাজসজ্জার ধরনের উপর নির্ভর করে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালো আয়োজক।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান আরাফাত হোসেন রিফাত বললেন, “মেয়েপক্ষ অনেক অনুষ্ঠান ছাদ বা বাসায় এখনও করছে। তখন বাসা ডেকোরেশন করে দিচ্ছি আমরা।

“বাজেটের উপর নির্ভর করে আমরা হয় পুরোটা হোস্ট করি বা শুধু ডেকোরেশন করি। যেমন স্টেজ, ফটো সেশন ফ্রেম-বুথ, বাসার লাইটিং হলে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার হতে পারে।”

“আবার রিসোর্টে হলে এখানে জায়গা, খাবার অর্থ্যাৎ কতজন অতিথি তা ধরে বাজেট আসে। রিসোর্টে সাধারণত আমরা ৫০ থেকে ৭০ জনের মতো অতিথি পাই। এ ধরনের আয়োজনে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা খরচ হতে পারে।”

দেশেও লেগেছে ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ হাওয়া। ছবি: ওয়েডিং প্ল্যানিং কনফারেন্স ডটকম

বিয়ের বাজারে ওয়েডিং প্ল্যানার’

নিজেদের ‘ওয়ান স্টপ সল্যুশন’ বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালো শাহজাহান ওয়েডিং প্ল্যানার অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানটি; যারা ২০১০ সাল থেকে বিয়ের আয়োজন নিয়ে কাজ করছে।

মহাখালীর নিউ ডিওএইচএস এলাকার এই প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগের তরুণ কর্মকর্তা তাসফিয়া বিনতে মোস্তফা জানালেন, আজকাল বিয়েতে কী করা যায় এবং কীভাবে করা যায় এসব পরিকল্পনার জন্যও বর-কনের পরিবার আসছে তাদের কাছে।

বাজেট অনুসারেই সাজানো হয় একেকটি অনুষ্ঠান।

“অনেক বিত্তবান পরিবার বিয়ের আয়োজন সীমিত রাখতে পছন্দ করে। আবার অনেকে হলুদ, সংগীত এসব আয়োজনে আগ্রহী থাকে।”

বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে সংগীত কেমন করে সাজানো হয়?

তাসফিয়া বিনতে মোস্তফা বলেন, “এখানে সংগীতে অনেকে কাওয়ালি নাইট করতে চায়। তেমন আয়োজনে গ্রাহকের আগ্রহ ও বাজেট হিসাবে মঞ্চসজ্জা থেকে শিল্পীর ব্যবস্থাও করেছি আমরা।

“আমরা সামনে একটা কাজ করবো … কাবিন হয়ে গেছে ক্লায়েন্টের। তারা একসঙ্গেই সংগীত করবেন।”

“অনেকে মেহেদি আর সংগীত একসঙ্গে করেন। হাতে মেহেদি দিয়ে বসে থাকতে হয়, তখন সংগীত চলে। আবার মেহেদি দেয়ার সময় তো শুধু মেয়েরা মজা করে, তাই পরে ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে সংগীতে থাকে।”

শাহজাহান ওয়েডিং প্ল্যানার অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ফেইসবুক পেজ ঘুরে দেখা গেল তাদের ঝলমলে ডেকোরেশনের অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিও। এধরনের ভারী সজ্জার জন্য বড় পরিসরের জায়গা পছন্দ করে এই প্রতিষ্ঠানটি।

“আমরা একটু হেভি টাইপ ডেকোরেশন করি। তাই বাসায় হলে যদি স্পেস বেশি থাকে মানে বাসাটা বড়… ডুপ্লেক্স-ট্রিপলেক্স… তাহলেই করি।”

“এছাড়া সেনাকুঞ্জ, সেনামালঞ্চ, ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারে রাজকীয় সজ্জায় বিয়ের আয়োজন করেছি আমরা। ড্রিম হলিডে পার্কেও বিয়ের আয়োজন করেছি আমরা। ওখানে দেখা গেছে ডেকোরেশনের কাজই তিন-চারদিন ধরে করতে হয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত