Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নিয়ে সংবিধানে কী আছে

বঙ্গভবনে রবিবার মাহফুজ আলমসহ তিন উপদেষ্টার শপথ অনুষ্ঠানের সময়ও দরবার হলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছিল।
বঙ্গভবনে রবিবার মাহফুজ আলমসহ তিন উপদেষ্টার শপথ অনুষ্ঠানের সময়ও দরবার হলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছিল।
[publishpress_authors_box]

উপদেষ্টা হওয়ার পর দৃশ্যত নিজের প্রথম কাজটি সারলেন মাহফুজ আলম, তা হলো বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামালেন।

সংবিধানের প্রথম ভাগেই বঙ্গবন্ধুর ছবি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে রাখার বাধ্যবাধকতার কথা রয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তার আগেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নামানো হলো।

যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগরদের একজন মাহফুজ মনে করেন, গত ৩ আগস্ট এক দফার দাবি দেওয়ার পরই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে।

যদিও এখন পর্যন্ত সংবিধান স্থগিত কিংবা বাতিল হয়নি এবং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাংবিধান অনুযায়ী নতুন সরকার এবং মাহফুজসহ উপদেষ্টাদের শপথ পড়িয়েছেন।

বাঙালির মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি তোলার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তান সরকার।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে কারামুক্ত হওয়ার পর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-জনতার সংবর্ধনা সভা থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলা হলেও তা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর।

তার দেড় দশক পর অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে আন্দোলনকারী নেতাদের কাছে এখন ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসাবে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ এবং এই দলের নেতারা।

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন শফিকুর রহমান চৌধুরী; তখন সব মন্ত্রীদের দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিও দেখা যেত। ফাইল ছবি

ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন’ বাতিল করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রণীত এই আইন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানরা রাষ্ট্রীয় বিশেষ নিরাপত্তা এবং আবাসন সুবিধা পেতেন।

সেই আইন বাতিলের কারণ দেখিয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, “আমাদের এই সরকারটা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটার ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে।”

অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারেও একটি কমিশন গঠন করেছে। প্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন সেই কমিশনে মাহফুজও একজন সদস্য।

কমিশন এখনও তাদের কাজ শেষ করেনি। তার মধ্যেই রবিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার পরদিনই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলার কথা জানালেন মাহফুজ, যা শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে এরই মধ্যে তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস।

প্রতিকৃতি নিয়ে সংবিধানে কী আছে

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। তাতে শাসনতন্ত্রের প্রথম ভাগে ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি’ শিরোনামের চতুর্থ ধারাটি যুক্ত হয়।

এই ধারায় আছে- “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সকল সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।”

সংবিধানের সপ্তম ধারায় আবার বলা আছে, সংবিধানের প্রথম ভাগ পরিবর্তন করা যাবে না।

সেখানে বলা আছে- “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনও পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।”

সংবিধানে প্রস্তাবনার পর প্রজাতন্ত্র শিরোনোমের প্রথম ভাগে সাতটি অনুচ্ছেদ রয়েছে।

সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে বলা আছে ১৪২তম অনুচ্ছেদে।

সেখানে বলা আছে, “সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোনও বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে;

তবে শর্ত থাকে যে,

(অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোনও বিলের সম্পূর্ণ শিরনামায় এই সংবিধানের কোনও বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না;

 (আ) সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোনও বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;

 (খ) উপরি-উক্ত উপায়ে কোন বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন, এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

মাহফুজ আলম
ফেইসবুক পোস্টে এই ছবিটি শেয়ার করেছেন মাহফুজ আলম, যেখানে তার পেছনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি নেই।

মাহফুজ যা বলছেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাহফুজ শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী ছিলেন; রবিবার পদোন্নতি পেয়ে উপদেষ্টা হন তিনি।

সোমবার তিনি এক ফেইসবুক পোস্টে বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেওয়ার পর সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের তোলা একটি ছবি শেয়ার করেন মাহফুজ। ছবিতে মাহফুজ যেখানে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন, তার ঠিক পেছনের দেয়ালেই আগে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি ছিল। কিন্তু এখন নেই।

সেই ছবি সরানোর কারণ তুলে ধরে মাহফুজ লিখেছেন, “একাত্তর-পরবর্তী ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দরবার হল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন উপদেষ্টার সভাকক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখা যেত। তানিয়ে আন্দোলনকারী অনেকের সমালোচনাও ছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপদেষ্টা হওয়ার ১২ দিন পর ২০ আগস্টও তার দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখা গিয়েছিল। ফাইল ছবি

মাহফুজ লিখেছেন, “এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে, আমরা ৫ আগস্টের পর বঙ্গভবন থেকে তার ছবিটি সরাতে পারিনি। ক্ষমাপ্রার্থী। তবে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা টিকে থাকা পর্যন্ত তাকে কোথাও দেখা যাবে না।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোনও স্থান এখন আর নেই, বলে আসছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

মাহফুজও বলেন, “শেখ মুজিব ও তার মেয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যা করেছেন তা আওয়ামী লীগকে স্বীকার করতে হবে এবং এর জন্য অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। বাহাত্তরের সালের অগণতান্ত্রিক সংবিধান থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষ, শত শত কোটি টাকার পাচার এবং হাজার হাজার বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (৭২-৭৫, ২০০৯-২০২৪)– সবকিছুর জন্য।

“এরপর আমরা ’৭১ পূর্ববর্তী শেখ মুজিব সম্পর্কে কথা বলতে পারি। ক্ষমা প্রার্থনা ও ফ্যাসিস্টদের বিচার ছাড়া কোনও ধরনের মীমাংসা সম্ভব নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত