স্যাটেলাইটের ভগ্নাংশ বা ধ্বংসাবশেষ এড়াতে মাত্র ছয় দিনে দুইবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে (আইএসএস) পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। কৌশলী এই পদক্ষেপই বলে দিচ্ছে আমাদের মহাকাশে আবর্জনা বৃদ্ধির সমস্যা কতটা প্রকট।
রাশিয়ার প্রোগ্রেস ৮৯ কার্গো মহাকাশযানের ইঞ্জিন সম্প্রতি সাড়ে তিন মিনিটের জন্য চালু করা হয়। পুরোনো একটি স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ আইএসএসকে এর কক্ষপথ থেকে ৫০০ মিটার ওপরে তুলতে হয়।
এর আগে গত ১৯ নভেম্বর আইএসএস একইভাবে ২০১৫ সালে ধ্বংস হওয়া একটি আবহাওয়া গবেষণা স্যাটেলাইটের টুকরো এড়িয়ে যায়।
উভয় ঘটনাই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলকভাবে নিচু উচ্চতায় অবস্থিত একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ক্রমবর্ধমান ভিড় ও এর ঝুঁকির বিষয়টি সামনে আনে। বর্তমানে সেখানে ১০ হাজার ২০০’র বেশি সক্রিয় স্যাটেলাইট রয়েছে।
স্পেসএক্সের স্টারলিংকের মতো ব্রডব্যান্ড মেগা কনস্টেলেশন (কয়েক হাজার স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক) মহাকাশ দখল করায় সংঘর্ষ ও ধ্বংসাবশেষ বৃদ্ধির ঝুঁকি আরও বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি পৃথিবী ও এর প্রাণীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে।
মহাকাশে স্যাটেলাইটের ভগ্নাংশ বা ধ্বংসাবশেষ আসলে কি
ভূপৃষ্ঠ থেকে দেখা না গেলেও পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলক নিচু উচ্চতায় অবস্থিত কক্ষপথ এখন মহাজাগতিক আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সেখানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্যাটেলাইটগুলোর লাখ লাখ টুকরো অনেক গতিতে চলাচল করছে।
এসব ধ্বংসাবশেষের উৎস হলো অকেজো স্যাটেলাইট, রকেটের অংশ বা মহাকাশযানের অবশিষ্টাংশ। এমনকি ক্ষুদ্র কণাও এই সমস্যা বাড়াচ্ছে, যেমন মহাকাশযানের রঙের কণা।
অবশিষ্টাংশগুলো কখনও কখনও ঘণ্টায় ১৮ হাজার মাইল গতিতে ছুটে চলে। বুলেটের গতির চেয়ে এই গতি প্রায় সাতগুন বেশি। এমন গতির কারণেই বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানে ও স্যাটেলাইটের ওপর আঘাতের ঝুঁকি বাড়ে।
চীন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নিজেদের ফেংউয়েন-১সি আবহাওয়া স্যাটেলাইট ধ্বংস করে একটি পরীক্ষা চালায়। ওই ঘটনায় ধ্বংসপ্রাপ্ত স্যাটেলাইটের ৩ হাজারের বেশি বড় ও ৩৫ হাজার ছোট টুকরোর সৃষ্টি হয়।
২০০৯ সালে রাশিয়ার একটি নিয়ন্ত্রণহীন স্যাটেলাইন (কমোস-২২৫১) ঘণ্টায় ৪২ হাজার ১২০ কিলোমিটার গতিতে আমেরিকার একটি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটে (ইরিডিয়াম ৩৩) আছড়ে পড়ে। ওই সংঘর্ষের ফলেও মহাকাশে আবর্জনার পরিমাণ বেড়ে যায়।
মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণে কোনো নিয়ম-নীতি নেই। ফলে সরকারি ও বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করছে। প্রয়োজনে ধ্বংসও করছে।
নাসার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে একটি নিচু কক্ষপথকে বলা হয় এলইও। এটি সাধারণত ১৬০ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থান করে। সেখানেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবর্জনার স্তুপ জমা হয়েছে।
কিন্তু চাইলেই এসব আবর্জনা সরানো যাচ্ছে না। কারণ মহাকাশে অভিযান পরিচালনা অনেক ব্যয়বহুল কাজ। আর এলইওতে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করাও অনেক জটিল ও কষ্টকর কাজ।
এই সমস্যা সমাধানে ১৯৭৯ সালে টেক্সাসের হিউস্টনে জনসন স্পেস সেন্টারে নাসা তাদের অরবিটাল ডেব্রিস প্রোগ্রাম চালু করে। এর লক্ষ্য ছিল নতুন ধ্বংসাবশেষ তৈরির পরিমাণ কমানো এবং মহাকাশে থাকা ধ্বংসাবশেষ ট্র্যাক করে সেগুলো সরানোর প্রযুক্তি উন্নয়ন করা। কিন্তু বাস্তবে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
বর্তমানে মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ আমাদের মহাকাশ অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় বড় ঝুঁকি তৈরি করছে না। তবে এর বড় বিপদ হলো অন্য স্যাটেলাইটগুলোর জন্য। ধ্বংসাবশেষ থেকে বাঁচতে স্যাটেলাইটগুলোকে প্রায়ই সরে যেতে হয়। নাসার মতে, বছরে কয়েকশ বার স্যাটেলাইটগুলোকে ধ্বংসাবশেষ এড়ানোর কৌশল নিতে হয়। এর মধ্যে আইএসএসও রয়েছে। এতে মহাকাশচারীরা বাস করেন।
নাসার বিজ্ঞানী ডোনাল্ড কেসলার ১৯৭৮ সালে বলেছিলেন, মহাকাশে অধিকসংখ্যক ধ্বংসাবশেষ থাকলে সেটি চেইন রিঅ্যাকশন তৈরি করতে পারে। এতে আরো অধিকসংখ্যক বস্তু সংঘর্ষ ঘটিয়ে ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ বাড়বে। ফলে পৃথিবীর কক্ষপথ ব্যবহারযোগ্য থাকবে না।
মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ থেকে আমাদের আবহাওয়ার সমস্যা হতে পারে পরোক্ষভাবে। ধ্বংসাবশেষের ঘনত্ব এতটা বেড়ে যেতে পারে যে, এটি আবহাওয়া স্যাটেলাইট ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে আমাদের পরিবেশগত দূষণের কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন মনিটর করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ কমানোর জন্য গাইডলাইন জারি করেছে।
ধ্বংসাবশেষের ছোট কণাগুলো নিয়ে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কণাগুলো সক্রিয় স্যাটেলাইটের সোলার প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো মহাকাশে ভেসে থাকা জ্বালানির ধ্বংসাবশেষ। এই ধ্বংসাবশেষ দাহ্য এবং এটি বিস্ফোরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে দূষণ ছড়াতে পারে। কিছু ধ্বংসাবশেষে পারমাণবিক পদার্থও থাকতে পারে, যা পৃথিবীতে পুনঃপ্রবেশ করলে মারাত্মক দূষণ ঘটাতে পারে।
তথ্যসূত্র : স্পেস ডট কম, টাইমস অব ইন্ডিয়া।