যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অস্ত্র হিসেবে শুল্ককে ব্যবহার করে চীনকে ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই চীনের উদ্ভাবিত নতুন চ্যাটবট ডিপসিক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেই ধাক্কা দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন। তাদের কাছে এখন চীনের নতুন ও সস্তা কিন্তু কার্যকর ডিপসিক প্রযুক্তি আগ্রহের বিষয়। তাই তো গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি বাজারে বড়সড় ধাক্কা দেয় ডিপসিক।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ডিপসিক এআইয়ের কার্যক্ষমতা এরই মধ্যে চ্যাটজিপিটি, জেমিনি ও ক্লডের মতো বিভিন্ন এআই মডেলকে পেছনে ফেলেছে।
ডিপসিক কী
ডিপসিক হলো চীনের হাংজু শহরে অবস্থিত একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কোম্পানি। কয়েক বছর আগে এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্টার্টআপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। কোম্পানিটির লক্ষ্য হলো মানুষের পর্যায়ের কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা, যা এখনও কোনও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান করতে পারেনি।
যদিও ডিপসিক এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তবে তাদের ভিন্নধর্মী পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি এআই মডেল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলোর তুলনায় অনেক সস্তায় পরিচালিত হয়।
ডিপসিক কম খরচে এআই তৈরি করার পেছনে আছে চীনা বিজ্ঞানীদের সীমিত সংখ্যক চিপ দিয়ে কাজ করার অভ্যাস। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনে চিপ পাওয়া কঠিন। তাই তারা এই পরিস্থিতি সামলাতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন।
আগে কেন ডিপসিক সম্পর্কে শোনা যায়নি
ডিপসিক তাদের উদ্ভাবন দিয়ে কিছুদিন হলো এআই জগতে চমক সৃষ্টি করেচলেছে। তাদের মডেলের খরচ-কার্যক্ষমতার অনুপাত মেটা ও ওপেনএআইয়ের তুলনায় অনেক কম। তবে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলোর মতো তারা তাদের সাফল্য নিয়ে খুব বেশি প্রচার করেনি।
সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘসময় ধরে নতুন পণ্যের ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ তুলে নেয়। সঙ্গে থাকে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য। তবে আশা করা যায়, ডিপসিকের নীল তিমি লোগোটি আরও বেশি দেখা যাবে। কারণ বিশ্বজুড়ে মানুষ এটি ডাউনলোড করে পরীক্ষা করতে আগ্রহী হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের উন্নত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। শুধু তাই নয়, এআইখাতে চীনকে চাপে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ডিপসিক সেই চাপকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মডেল বাজারে এনে বড় ধরনের চমক তৈরি করছে।
R1 মডেলটি কী
ব্যাপক আলোচিত ডিপসিক এআই মডেলটির উদ্ভাবক কোম্পানির দাবি, এর কার্যক্ষমতা ওপেনএআইয়ের R1 মডেলের সমতুল্য। এই মডেলটি গত ডিসেম্বরে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল। সোমবারও এটি যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া বিনামূল্যের অ্যাপ ছিল।
ডিপসিক কেন আলাদা
এই মডেলটি ব্যবহারের সময় কম মেমোরি ব্যবহার করে। ফলে প্রতিটি অনুসন্ধান বা চ্যাটবট ব্যবস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় তুলনামূলক ব্যয় অনেক কম হয়।
গবেষকরা এর জটিল যুক্তি নির্ধারণের ক্ষমতা, বিশেষ করে গণিত ও কোডিং বিষয়ে প্রশংসা করেছেন। এটি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কম কম্পিউটিং শক্তি ব্যবহার করে একই রকম ফল দিচ্ছে।
ডিপসিক জানিয়েছে, মডেলটি তৈরি করতে দুই মাস এবং ৬ মিলিয়ন ডলারেরও কম খরচ হয়েছে। তবে কিছু বিশ্লেষক এটির মূল্যায়ন এখনই করতে চাননি। এটি অবশ্য সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিলিয়ন ডলারের ব্যয়বহুল প্রকল্পের তুলনায় অনেক কম এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা।
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
চীনা কুইন্টিটেটিভ হেজ ফান্ড পরিচালনা করতেন লিয়াং ওয়েনফেং। এই প্রতিষ্ঠান এখন ডিপসিককে তহবিল দেয়।
এক সাক্ষাৎকারে ওয়েনফেং বলেন, “অনেক বছর ধরে চীনা কোম্পানিগুলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন অন্যদের থেকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত ছিল। আর আমরা অ্যাপ্লিকেশন মনিটাইজেশনে মনোযোগ দিচ্ছিলাম।
“এই নতুন যুগে আমাদের শুরু করার লক্ষ্য দ্রুত মুনাফার সুযোগ নেওয়া নয়, বরং প্রযুক্তির সীমান্তে পৌঁছানো এবং পুরো ইকোসিস্টেমের উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, অর্থনীতি উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন ধীরে ধীরে একটি অবদানকারী দেশে পরিণত হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারমূল্য কমছে কেন
ডিপসিক চ্যাটবটের কার্যক্ষমতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারমূল্য কয়েকশ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
কারণ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এআইয়ের উন্নয়নে আরও কয়েকশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই বিনিয়োগের বেশিরভাগই এআইয়ের সাধারণ বুদ্ধিমত্তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কম্পিউটিং অবকাঠামো এবং শক্তির উৎস নির্মাণে ব্যবহৃত হবে, এমনটাই কথা ছিল। তবে ডিপসিকের কার্যক্ষমতা এই ধারণাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এনভিডিয়ার উদ্বেগ
এনভিডিয়া হলো সেই কোম্পানিগুলোর একটি, যারা এআই বিস্ফোরণের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে। এটি ভিডিও গেমের জন্য গ্রাফিকস কার্ড তৈরির কোম্পানি থেকে এআই শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিপ নির্মাতায় পরিণত হয়েছে।
ডিপসিককে যারা পর্যবেক্ষণ করছে, এমন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হয়তো ভাবছে, এখন তাদের এনভিডিয়ার সরঞ্জাম কিনতে হবে কি না? সোমবার এনভিডিয়ার বাজারমূল্য ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
ডিপসিকের প্রতিবন্ধকতা
এটি এখনও কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) অর্জন করেনি। এটি সেই স্তর যেখানে এআই যুক্তি দিয়ে কাজ শুরু করে। ওপেনএআই ও সিলিকন ভ্যালির অন্যান্য কোম্পানিগুলোও এটি অর্জনের চেষ্টা করছে।
ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান সতর্ক করেছেন যে, এমন বড় অর্জন খুব শিগগিরই আসবে না। তবে ডিপসিক অন্যদের তুলনায় অনেক কম খরচে একই কাজ করতে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে।
কতটা সুখবর
উন্নত এআই এখন হয়তো আগে যেমন মনে করা হয়েছিল তার চেয়ে কম শক্তি, কম্পিউটিং ক্ষমতা এবং মাইক্রোচিপ ব্যবহার করেও কাজ করতে পারবে। তবে ডিপসিক এআই প্রযুক্তি জগতের জন্য কতটা সুখবর বয়ে নিয়ে আসছে- তা সময়ই বলে দেবে। যেমনটা হয় সব নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই।