রিকন্ডিশন্ড বা ব্যবহৃত গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার নির্বাচন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
২১ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন নির্ধারিত রয়েছে। তার আগে সংগঠনের এক সদস্য বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। সেগুলো তদন্ত করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ নিতে বারভিডায় প্রশাসক নিয়োগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তিনি।
ওই আবেদনে গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারভিডা সভাপতিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। তাতে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী আমেজ যতটা ছিল, তাতেও পড়েছে ভাটা।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন-২ শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পুলক কুমার মন্ডল সকাল সন্ধ্যাকেবলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় কারণ দর্শানো নোটিস জারি করেছে। জবাব পেলে আমরা পরবর্তী কার্যদিবসে সেটি নিয়ে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেব।”
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়ে বারভিডার প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলী সকাল সন্ধ্যাকেবলেন, “আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি আছে। সেভাবেই আগাচ্ছে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি নতুন করে কোনও নির্দেশনা দেয় তাহলে আমরা সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।”
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বারভিডার এবারের নির্বাচন যে জমছে না, তা আগেই আঁচ করা যাচ্ছিল। কারণ প্রতিবার দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল থাকলেও এবার ‘গণতান্ত্রিক পরিষদ’ নামে একটি প্যানেলই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে।
সেই প্যানেলে সভাপতি পদে আবদুল হক ও সেক্রেটারি জেনারেল পদে রিয়াজ রহমান প্রার্থী হয়েছেন। ঘোষিত হয়েছে প্যানেলের ২৫ জনের প্রার্থী তালিকা।
বিপরীতে অন্য কোনও প্যানেল শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেনি। তবে সেই প্যানেলের বাইরে অন্তত ১৬ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে আছেন।
বারভিডার নির্বাচনে ২৫ সদস্য নির্বাচিত হবেন। সেই ২৫ সদস্যই নির্বাচন করবেন সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেলসহ কার্যনির্বাহী কমিটি। কমিটি দুই বছরের জন্য বারভিডার নেতৃত্ব দেবে।
এবার শুরু থেকেই নির্বাচনে লড়ার কথা বলে আসছিলেন বর্তমান সদস্য এবং সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল হাবিবুর রহমান। কিন্তু মনোনয়নপত্র কেনার শেষদিন তিনি ফরম না কিনে সবাইকে চমকে দেন।
তার মতো প্রভাবশালী গাড়ি ব্যবসায়ী অনেকেই শেষপর্যন্ত মনোনয়ন ফরম কেনেননি। ফলে শুরু থেকেই নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় ছিল।
একইসঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করে গণতান্ত্রিক প্যানেল জয়ী হওয়ার জন্য একটি সমঝোতা বৈঠক হয় ঢাকায়। সেখানে প্রত্যেক সদস্য প্রার্থীকে একটি করে আইফোন-১৬ প্রো ম্যাক্স দেওয়াসহ নানা অফার দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়।
নির্বাচনে না লড়ার বিষয়ে হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বারভিডার এসব বিষয়ে তিনি কথা বলতে আগ্রহী নন।
এরপর নির্বাচনে প্রশাসক নিয়োগের দাবি জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন বারভিডার সদস্য মুজিবুল হক খোকন।
২৪ নভেম্বর আবেদন পেয়ে যাচাই করে ১১ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নিয়ে বারভিডা সভাপতিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন শাখা। সেই নোটিসে চার দিনের মধ্যে কেন বারভিডায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে না, তা জানার নির্দেশনা আছে।
বারভিডার এক সদস্য সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী চার কর্মদিবস হিসাবে আগামী বুধবারের মধ্যে জবাব দিতে হবে বারভিডাকে। কারণ ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। ১৩, ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর সরকারি ছুটি। সেই ছুটি বাদ দিলে চার কর্মদিবস হিসেবে বারভিডাকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে জবাব দিতে হবে।
“জবাব পেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে পরবর্তী পদক্ষেপের চিঠি ইস্যু করার জন্য সময় থাকে শুধু বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর। এর দুদিন পরই ২১ ডিসেম্বর নির্বাচন। ফলে সেদিন নির্বাচন করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। ফলে সবার ধারণা নির্বাচন সেই তারিখে হবে না। আর বারভিডায় যদি সরাসরি প্রশাসক বসে, তাহলে নির্বাচন একেবারেই অনিশ্চিত। এখন বারভিডা কী জবাব দেয়, তার অপেক্ষায় আছি আমরা।”
বারভিডার নির্বাচন স্থগিত, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং প্রশাসক নিয়োগের দাবি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৩০ নভেম্বর আরেকটি অভিযোগ করেন বারভিডার সদস্য দীনুল ইসলাম।
সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, কঠোর গোপনীয়তায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ডাকযোগে সব সদস্যকে তফসিল পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। এতে অনেক সদস্য তফসিল পায়নি। ফলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মূলত পাতানো নির্বাচন করতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।
ওই অভিযোগের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে ১২ ডিসেম্বর একটি রিট আবেদন করা হয়। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১১ ডিসেম্বর আরেকটি চিঠিতে সেই অভিযোগ শুনতে ২৩ ডিসেম্বর দিন ঠিক করেছে। কিন্তু বারভিডার নির্বাচনের তারিখ তারও আগে ২১ ডিসেম্বর।
দীনুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২১ ডিসেম্বর নির্বাচন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের অভিযোগ শুনতে সময় দিয়েছে ২৩ ডিসেম্বর। এটা গ্রহণযোগ্য নয়, হাস্যকর। উচ্চ আদালতে আগামী সপ্তাহে শুনানির সময় আমরা বিষয়টি আদালতকে জানাবো। একইসঙ্গে সময় আগানোর বিষয়টি তুলব।”
জানতে চাইলে বারভিডার সেক্রেটারি জেনারেল শহীদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলো একেবারেই অবান্তর, মিথ্যা। এসব অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কারণ দর্শনো নোটিসের জবাব আমরা বৃহস্পতিবারই দিয়েছি।”
তিনি অভিযোগকারীদের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, “বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। সেটি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছেন। এটি তো কোনও একক সিদ্ধান্তে হয়নি।
“আর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর যে কথা বলা হচ্ছে, বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে সেই সফরে যাওয়া একটা কমন বিষয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, সাবেক সভাপতি আবদুল হক অবৈধ কোনও সুবিধা নিয়েছেন কি না? দলীয় কোনও পদে ছিলেন কি না? আমার মনে হয় না তিনি দলীয় কোনও পদে থেকে সুবিধা নিয়েছেন। আমিই তো কোনও দলীয় সুবিধা নিইনি।”
কী সেই অভিযোগ
বারভিডার বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে বড়সড় অভিযোগ দিয়েছেন মুজিবুল হক খোকন। তিনি জোনাকি এন্টারপ্রাইজের মালিক।
তার অভিযোগ, “বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের ২৮ জুন। ১৮০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বর্তমান পরিষদ তিন দফায় সময় আট মাস বাড়িয়ে নেয়, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। এতবড় আইনের লঙ্ঘন ঘটিয়ে তারা নিজেদের বলয়ে থাকা একাধিক ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশন গঠন করে একটি পাতানো নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন।”
তার অভিযোগে আরও বলা হয়, “সেই নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ ভোটারদেরই কোনও আগ্রহ নেই। মূলত বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে হাবিব উল্লাহ ডন ও শহীদুল ইসলাম ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন বারভিডায়। সেই অনিয়ম জায়েজ করতেই তাদের প্যানেলের লোকজনকে নির্বাচিত করে আনতে এই পাতানো নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে।”
বারভিডার সদস্য খোকন বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মদদপুষ্টদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইতে প্রশাসক নিয়োগ করে সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন করা গেলে তা বারভিডায় কেন করা যাবে না?
তার অভিযোগ, বারভিডার নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী আবদুল হক ও সেক্রেটারি জেনারেল প্রার্থী রিয়াজ রহমান দুজনই ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। এর মধ্যে আবদুল হক মোংলা বন্দর থেকে ৯০ শতাংশ অবচয় সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ গাড়ি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খালাস করতে পেরেছেন। এতে সরকারের বিপুল রাজস্বহানি হয়েছে। রিয়াজ রহমানের বিরুদ্ধে আগস্টের ঘটনায় একটি হত্যা মামলাও হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে গণতান্ত্রিক পরিষদের প্যানেল লিডার আবদুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্তে অনুমোদন নিয়েই গাড়িগুলো ছাড় পেয়েছে। বিষয়টি অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে। এখন নতুন করে সেগুলো আনার কী কারণ বুঝি না।
“আর এখানে আমি তো ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হইনি। আমি বরঞ্চ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ ৬/৭ বছর আমার গাড়িগুলো মোংলা বন্দরে পড়েছিল। যেখানে আমার শতকোটি টাকা লোকসান হয়েছে।”
পাতানো নির্বাচনের অভিযোগের বিষয়ে আবদুল হক বলেন, “বাণিজ্য সংগঠনের মহাপরিচালক ১৮০ দিন সময় বাড়াতে পারেন। কিন্তু সরকার চাইলে তো আরও বেশি সময় বাড়াতে পারে। অভিযোগকারীরা বোধহয় সেটি জানেন না। আর আমরা চাইছি একটি ভালো নির্বাচন হোক। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক। কিছু সদস্য ছাড়া বাকি সব সদস্যই চায় বারভিডায় দ্রুত নির্বাচন হোক। এখন নির্বাচনের সেই পরিবেশ আছে।
“আর প্রশাসক নিয়োগ হবে কিনা, সেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর বারভিডা দেখবে। আমি তো বারভিডার নেতৃত্বে এখন নেই।”