Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বৈঠক থেকে মূল খেলোয়াড়রা কী চায়

ukraine war
[publishpress_authors_box]

পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। এখন পর্যন্ত দেশটির পাঁচ ভাগের এক ভাগ অঞ্চল রাশিয়ার দখলে। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগই ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বে।

দীর্ঘসময় ধরে চলা এই যুদ্ধ বন্ধে অনেকটা তাড়াহুড়ো করে সোমবার ও মঙ্গলবার প্যারিস ও রিয়াদে আলোচনার আয়োজন করেছেন বিশ্বনেতারা। তাদের এই তাড়াহুড়োর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি চাইছেন।                       

ট্রাম্পের চাওয়া মোতাবেক তাই একদিকে সোমবার প্যারিসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ইউরোপীয় নেতারা।

অন্যদিকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে মঙ্গলবার বৈঠক করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।

প্যারিস ও রিয়াদে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত বন্ধে যে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে, তাতে ডাকা হয়নি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইউক্রেনকে।

দুই দিনের বৈঠক থেকে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো কী অর্জনের আশা করছে, তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।   

যুক্তরাজ্য

ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় করছে না। গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর ইউরোপকে এজন্য তিরস্কারও করেন ট্রাম্প।

এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় নেতা ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করতে চাইছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।

তিনি ইউক্রেনের মাটিতে যুক্তরাজ্যের সেনা মোতায়েন করতে চান। তিনি আশা করেন, প্যারিস বৈঠকে ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে সমর্থন দেবে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি করতে। রাশিয়া যাতে ইউক্রেনে আবার আক্রমণ করে না বসে, সে চেষ্টাও ‍তিনি করবেন।    

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

জার্মানি

ট্রাম্প চেয়েছিলেন ইউক্রেন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে শান্তিচুক্তি করতে। তার এই পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেছিল জার্মানির মূলধারার সব রাজনৈতিক দল।

জার্মানির কট্টর ডানপন্থি ও পপুলিস্ট বাম রাজনীতিকরা প্যারিসে পুতিনের সঙ্গে বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা চান, কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিতে।

বিবিসির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই জার্মানিতে আসুক না কেন, ইউক্রেনের প্রতি বার্লিনের সমর্থনে ভাটা পড়বে না, মজবুতই থাকবে।

কারণ বার্লিনের রাজনীতি সচেতন অভিজাত শ্রেণি মনে করে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে এমন কোনও চুক্তি জার্মানির জন্য ভয়াবহ হবে।

গত তিন বছরে জার্মানি রাশিয়ার জ্বালানি থেকে সফলভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক বাড়িয়েছে।

এতে জার্মান অর্থনীতিতে মারাত্মক ধাক্কা লাগে। একপর্যায়ে বাজেট ঘিরে বিরোধ জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের সূচনা করে।

তাই ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা বা ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো- এসব জটিল আলোচনা এড়াতে চাইছেন জার্মানির রাজনীতিকরা।     

পোল্যান্ড

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনের প্রধান সমর্থক পোল্যান্ড। দেশটি মনে করে, যুদ্ধে রাশিয়া জিতলে গোটা ইউরোপের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

বৈঠকে অংশ নিতে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় তাই পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বলেন, “আমরা ইউরোপীয়রা যদি এখন প্রতিরক্ষা খাতে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হই এবং বৃহত্তর যুদ্ধ ঠেকাতে না পারি, তাহলে আমাদের আরও ১০ গুণ বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হতে হবে।” 

নর্ডিক ও বাল্টিক দেশ

সোমবারের বৈঠকে নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে কেবল ডেনমার্কই উপস্থিত থাকবে।

তবে ইউরোপীয় কূটনীতিকরা বলেছেন, বৈঠকে ডেনমার্ক পূর্ব দিকে তার বাল্টিক প্রতিবেশী এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার স্বার্থেরও প্রতিনিধিত্ব করবে।

এই দেশগুলোর প্রতিটিরই রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত আছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আগামীতে কোথাও হামলা চালালে নর্ডিক ও বাল্টিক দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।

তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড দখলের ইচ্ছা ডেনমার্কের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কেরই অধীনে স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের মতো এখনও ইউক্রেনে নিজেদের সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেননি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেতে ফ্রেদেরিকসেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ফ্রান্স

ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে ইউরোপের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার বলে মনে করেন ফ্রান্সের সামরিক বিশেষজ্ঞ ফ্রাঁসোয়া হাইসবার্গ।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “ইউরোপীয়রা ঐক্যবদ্ধ নয়। তবে প্যারিসের বৈঠক থেকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি।”

একই মত পোষণ করেন ফ্রান্সের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক জোঁ নোয়েল ব্যারত। তিনি বলেন, “ইউরোপজুড়ে একতার বাতাস বাইছে, যা করোনাভাইরাস মহামারির পর এই মহাদেশে দেখা যায়নি।”          

রাশিয়া

গত গ্রীষ্ম থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছেন, যুদ্ধে রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোর স্বীকৃতি যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা শুরুর প্রধান শর্ত। এছাড়া রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও ন্যাটোতে যোগদানে ইউক্রেনের অনুরোধে সাড়া না দেওয়াও শর্ত হিসেবে থাকবে।

পুতিনের এসব শর্ত পূরণে রাজি নয় ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ।

শান্তিচুক্তি করতে রাশিয়াকে কী ছাড় দিতে হতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনায় সতর্ক অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ ও পেন্টাগন সম্প্রতি জানিয়েছে, দুই দিক থেকেই ছাড় আশা করে তারা।

বিবিসির বিশ্লেষকদের ভাষ্য, রিয়াদের বৈঠককে এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার দিচ্ছে মস্কো। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ইউক্রেনে সংঘাত বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব তিনি ‘সর্বপ্রথম ও প্রধানত’ শুনতে চান।

মস্কো মনে করে না, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় ইউরোপকে ডাকার কোনও মানে আছে। কারণ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করে আসছে।

হয়তো এ কারণে দুই শহরে দুই দিনের কূটনৈতিক আলোচনায় ইউক্রেনের কোনও প্রতিনিধি নেই।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রিয়াদে বৈঠকে থাকছেন। তবে বৈঠকে ‘মেইন ভয়েস’ নিঃসন্দেহে রিয়াদ থেকে ১১ হাজার ৯০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে ফ্লোরিডার পাম বিচে অবস্থান করা ট্রাম্প।

তার স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ। আর দীর্ঘমেয়াদে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কম জড়াতে চান। যুদ্ধ শুরুর পর কিয়েভকে যুক্তরাষ্ট্র যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তার বিনিময়ে ইউক্রেনের বিরল প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে চোখ ট্রাম্পের।

ইউক্রেন

২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর সময়ের মতো ইউক্রেনীয়দের ভবিষ্যৎ আজও অনিশ্চিত। তারা শান্তি চায়। সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙুক, এমনটা তারা চায় না।

রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ২৫ শতাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে।

শান্তিচুক্তির বিষয়ে ইউক্রেন আগে বলেছিল, চুক্তিতে অবশ্যই ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেন থেকে সব রুশ সেনা প্রত্যাহারের শর্ত থাকতে হবে।

ইউক্রেনীয়রা ২০১৪ সালের মতো কোনও শান্তিচুক্তি দেখতে চায় না। যে চুক্তির মাধ্যমে বড় লড়াই বন্ধ হলেও রুশ সীমান্তে গোলাগুলি কখনও থামেনি।

যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বৈঠক সম্পর্কে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, “ইউক্রেনীয়দের বাদ দিয়ে ইউক্রেন নিয়ে কোনও আলোচনাকে আমরা স্বীকৃতি দেব না। আমাদের ছাড়া কোনও চুক্তি স্বীকৃতি পাবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত