গত ১৩ বছরে সিরিয়াবাসী যে মাত্রায় নৃশংসতা দেখেছে, তার ফল হিসাবে এর চেয়ে কম কিছু হতে পারত না- বাশার আল আসাদ সরকারের পতনকে এভাবেই দেখছে সিএনএন।
রবিবার বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখলের পর ২৪ বছরের প্রেসিডেন্ট বাশারকে পালাতে হয়েছে। ১৩ বছর আগে গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও রাশিয়া-ইরানের সহায়তা নিয়ে টিকে ছিলেন তিনি।
তার এই পতনের খবর দিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে শুধু বলেছে, বাশার আল আসাদ সিরিয়া ছেড়েছেন। যাওয়ার আগে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়েছেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
নানা গুঞ্জন চললেও তিনি কোথায় গেছেন- সেই বিষয়ে কোনও কথা আসেনি তা দীর্ঘদিনের মিত্র দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে।
তবে এই বিজ্ঞপ্তি আসার আগে বিদ্রোহীদের একটি সূত্র যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন সিএনএনকে বলেছে, রুশ বাহিনীই নিরাপত্তা দিয়ে দামেস্ক থেকে নিয়ে গেছে বাশার আল আসাদকে। তাকে নিয়ে একটি বিমান উড়ে যায় সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লাতাকিয়ায়, যেখানে রাশিয়ার একটি বিমান ঘাঁটি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন সিএনএন বাশারের এই পতন অবশ্যম্ভাবি বললেও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সংশয়ই রেখে দিয়েছে। তাদের প্রতিবেতনে বলা হয়েছে, কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, দুর্ভোগের অবসান কীভাবে ঘটবে, তা সিরিয়াবাসীকে এখন প্রমাণ করতে হবে।
সিরিয়াবাসী গত ৫৪ বছর ধরে বাবা-ছেলের কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখে আসছিল। ১৯৭০ সালে হাফিজ আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হন, তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে সেই চেয়ারে বসেন ছেলে বাশার। তবে শাসন ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। লাখো মানুষের রক্তের দাগ লেগে আছে দুজনের হাতেই।
২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায়ও লেগেছিল, তা শক্ত হাতে দমন করেন বাশার। তারপর গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলেও দেশের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকেন বাশার। মাঝে ইসলামি গোষ্ঠী আইএসের হ্যাপাও সামলাতে হয় তাকে।
এদিকে সীমান্তের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে থাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো শক্তি বাড়াতে থাকে। আর এর নেতৃত্বে আসে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), যার নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি এক সময় সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়দায় যুক্ত ছিলেন।
রাজধানী দখলের পর জুলানি বলেছেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত সরকারি সব কার্যক্রম আপাতত বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই চলবে।
বাশারের সরকারে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালি অবশ্য পালাননি। দামেস্কেই রয়েছেন তিনি। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন।
তবে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতা নেওয়ার পর সিরিয়ার পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে এখনও কোনও উপসংহার টানতে পারছে না বিশ্লেষকরা।
আল জাজিরা বলছে, এখন নানা কিছুই ঘটতে পারে। কারণ এখানে অনেকগুলো দল জড়িত, তারা যদি পরস্পরকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ঘটতে পারে নানা কিছু।
বাশারের অচিন্তনীয় পতনের পর সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শুধু এই দেশবাসীর ওপর নয়, মধ্যপ্রাচ্য তথা গোটা বিশ্বের রাজনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে, তা বলছে বিবিসি।
কারণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার কেন্দ্রে ছিল আসাদের সিরিয়া। শিয়া প্রধান রাষ্ট্র ইরানের স্বার্থ রক্ষায় পাশাপাশি অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের বাফার রাষ্ট্র ছিল এটি। ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে না জড়ালেও লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র পাঠানোর রুট হিসাবে কাজ করে যাচ্ছিল সিরিয়া।
ইরানের সমর্থন আর রাশিয়ার অস্ত্রে বিদ্রোহীদের দমন করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন বাশার। তার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল লেবাননের হিজবুল্লাহও। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তারা সবাই এখন বিপাকে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হিজবুল্লাহ ও ইরান; রাশিয়া ব্যস্ত ইউক্রেনের ময়দানে।
সব মিলিয়ে বাশারের মিত্রদের সহায়তায় দেখা দিয়েছিল ঘাটতি; আর তখনই বিদ্যুৎ গতিতে একের পর এক শহর দখল করে কয়েকদিনেই দামেস্কের রাস্তা চিনে নেয় বিদ্রোহীরা।
মিত্র বাশারের পতন ইরানের জন্য একটি বড় আঘাত হিসাবেই দেখা হচ্ছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পক্ষে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হিজবুল্লাহ ও হামাস এখন যুদ্ধক্লান্ত। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীরা থাকলেও তারাও বিমান হামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
ফলে ইরান কোণঠাসা হয়ে পড়তে যাচ্ছে; আর তা ঘটছে তখন, যখন তারা ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি হামলায় জড়িয়ে পড়েছে।
‘অদম্য শত্রু’ বাশারের পতনে ইসরায়েলিদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ততটা খুশি তারা হতে পারছে কই? কেননা উত্তর সীমান্তে ইসলামী জিহাদিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়া তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়েই থাকছে।
আসাদকে শত্রুজ্ঞান করলেও তাকে প্রত্যক্ষ হুমকি মনে করত না তেল আবিব। কিন্তু এখন যারা সিরিয়ার ক্ষমতা নিল, সেই এইচটিএস নেতা আল-জুলানির আল কায়দা সংশ্লিষ্টতা ভুলতে পারছে না ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
দেশটির সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবি মেলামেদ সিএনএনকে বলেন, “ইরান, তার ছায়াযুদ্ধের সঙ্গী আর সিরিয়ার ইসলামি বিদ্রোহীদের মাঝে আছে ইসরায়েল।
“ফলে এর কোনোটিই ইসরায়েলের পছন্দ হওয়ার কারণ নয়; তবে কিছু সময়ের জন্য ইরান দুর্বল হবে, এটা ভালো বলা যায়।”
ইসরায়েলি মন্ত্রী আমিচি শিকিলের প্রতিক্রিয়ায়ও তা উঠে এসেছে যে আসাদের পতন তাদের উৎসবের কোনও উপলক্ষ নয়। স্থানীয় সংবাদপত্র ইসরায়েল হায়মকে তিনি বলেছেন, সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকাই এখন আল কায়দা ও আইএস সংশ্লিষ্টদের করায়ত্ত।
শিকিল সেইসঙ্গে জোর দিয়েছেন গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা মাউন্ট হেরমন দখলের। সিরিয়া ও ইসরায়েলের সীমান্ত রেখা নতুনভাবে তৈরির কথাও তুলেছেন তিনি।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে গোলান মালভূমির বেশিরভাগ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। ১৮৮১ সালে দখলীকৃত এলাকা আরও বাড়ায় হইহুদি রাষ্ট্রটি।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সিরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে সীমান্তে পাহারা জোরদার করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সিরিয়া সীমান্তের বাফার জোনে সেনা পাঠিয়েছেন এবং গোলান মালভূমির তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে বলেছেন।
১৯৭৪ সালের পর এই প্রথম বাফার জোনে ইসরায়েলি সেনারা ঢুকল। সিরিয়ার আরেক প্রতিবেশী দেশ লেবাননও তাদের সীমান্তে পাহারা মজবুত করেছে।
সিরিয়ায় পট পরিবর্তনের পরপরই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন, সীমান্তে পাহারা জোরদারের নির্দেশ দেন।
ইসরায়েলের আশঙ্কার বড় কারণ হচ্ছে, এই ফাঁকে ইরানি সৈন্যরা সিরিয়ায় ঢুকে পড়ে কি না? যদিও তেহরান থেকে কোনও আগ্রাসী বার্তা আসেনি।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা সিরিয়ার জনগণের মতকে শ্রদ্ধা করে। বাশারের পতন ঘটলেও সিরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখবে তেহরান।
দীর্ঘকাল ধরে বাশারকে ছায়া দিয়ে আসা রাশিয়ার বিবৃতিতে বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়।
ধারণা করা হয়, সিরীয় বিদ্রোহীদের সাম্প্রতিক তৎপরতা তুরস্কের সহায়তা ছাড়া সম্ভবই হত না। সিরিয়ার বিভিন্ন বিদ্রোহী দলকে সহায়তা করলেও এইচটিএসকে মদদের অভিযোগ অবশ্য প্রত্যাখ্যান করেছে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ তুরস্ক।
ন্যাটোর ‘মুরব্বি’ যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিরিয়া পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার কথা বলেছেন শুধু। আর ভাবি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেই দিয়েছেন, সিরিয়ায় কোনও যুদ্ধে জড়াবে না যুক্তরাষ্ট্র।
সিরিয়ার ঘটনা যে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশকেই উদ্বিগ্ন করছে, তা বোঝা যায় জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহর বিবৃতি থেকে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি সিরিয়ার সুস্থিতি চেয়েছেন। সিরিয়ার সব পক্ষকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, নতুন করে যেন আর সংঘাতে না জড়ায়।
সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণে সিএনএন লিখেছে, সব সংকটের মধ্যে থাকে সম্ভাবনার বীজ, আবার প্রতিটি সম্ভাবনার মধ্যে থাকে সংকটের ছায়া।
আসাদ গেছেন, দামেস্কের রাজপথে উল্লাস চলছে। কিন্তু এরপর কী? যখন কি না এইচটিএসের গায়ে রয়েছে আল কায়দার গন্ধ আর সংঘাতময় অতীত।
তবে গত কয়েক বছরে আল কায়দার গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন জুলানি; চাইছিলেন নিজেকে জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
তবে তাতে সবার ধন্দ কাটছে না। কেউ কেউ ভাবছেন, এই ভালো সাজা তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নয়ত?
বিবিসি লিখেছে, আবার এই নাটকীয় পরিবর্তন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরি করে দিতে পারে, তেমন আশঙ্কাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আর তা ঘটলে আর গোলযোগপূর্ণ, আরও সহিংস সিরিয়া দেখার জন্য প্রস্তুত হতে হবে দেশটির নাগরিকদের।