Beta
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

কীভাবে ঘুমালে ভালো ঘুম হয়?

sleep-position-01
[publishpress_authors_box]

কেউ রাতে চিৎ হয়ে শোয়, কেউ পাশ ফিরে, কেউ বা উপুড় হয়ে। কিন্তু কোন ভাবে শুলে আসলে ঘুম ভালো হয়? ভালো হওয়া মানে- ঘুম ভাঙার পর নিজেকে সতেজ মনে হওয়া, শরীরে কোনও অস্বস্তি না বোধ করা ।

অনেক সময়ই এরকম হয় যে বিছানায় শুয়ে একটি ভালো ঘুমের পজিশন বাছাই করতে করতেই ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। সে যাইহোক আরামপ্রদ গভীর ঘুমের বিষয়টিতে জোর দিয়ে বেশকিছু গবেষণা হয়েছে। যদিও বিস্ময়করভাবেই ব্যাপক পরিসরের গবেষণা খুব বেশি হয়নি।

ভালো ঘুমের জন্য শয়নের রকমফের নিয়ে কন্টেইনার জাহাজে কর্মরত নাবিক থেকে শুরু করে ওয়েল্ডার পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের নাইজেরিয়ান নাগরিকের ওপর করা একটি গবেষণা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।

তবে শুরুতেই আমাদের জেনে নিতে হবে ঘুমের জন্য কোন কোন শয়নের ধরন আমরা বেছে নিই। ঘুমে ঢলে পড়ার ঠিক আগে এবং ঘুম ভাঙার সময়ে আমরা যেভাবে শুয়ে থাকি, কেবল সেই দুই পজিশনই আমাদের মনে থাকে। ঘুমের ভেতরে নড়াচড়া সম্পর্কে আরও বেশি জানতে গবেষকরা ঘুমন্ত মানুষকে ক্যামেরায় রেকর্ড করা এবং তাদের শরীরে মোশন সেন্সর বসানোসহ নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করেছেন।

সঠিক তথ্য পেতে হংকংয়ের গবেষকরা ‘ব্ল্যানকেট অ্যাকোমোডেটিভ স্টিপ পোসচার ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’ প্রয়োগ করেছেন। এই পদ্ধতিতে এমনকি কম্বলের মধ্যে ঘুমন্ত ব্যক্তির নড়াচড়া ইনফ্রারেড ক্যামেরার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব।

ডেনমার্কের গবেষকরা স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরে ছোট ছোট ‘মোশন সেন্সর’ বসিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন। ঘুমানোর আগে অংশগ্রহণকারীদের পায়ের উরু, পিঠের উপরিভাগ এবং উপরের দুই বাহুতে সেন্সরগুলো সেট করা হয়- যাতে ঘুমের মধ্যে তাদের স্বস্তিদায়ক শয়নের ধরন নিয়ে জানা যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, মানুষ ৫০ ভাগেরও বেশি সময় কোনও এক পাশ ফিরে, ৩৮ ভাগ সময়ের মতো চিৎ হয়ে এবং ৭ শতাংশ সময় বুকের ওপর ভর দিয়ে অর্থাৎ উপুড় হয়ে ঘুমাযন। যার বয়স যত বেশি, তিনি তত কাত হয়ে ঘুমান।

কাত হয়ে ঘুমানোর এই প্রবণতাটি আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেই তৈরি হয়। কারণ তিন বছরের বেশি বয়সী শিশুরা গড়ে তাদের পাশ, পিঠ এবং পেটের ওপর সমান পরিমাণ সময় ধরে ঘুমায়। অন্যদিকে শিশুরা প্রধানত তাদের পিঠে ভর দিয়ে ঘুমায়, কারণ নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে ওভাবেই দোলনায় রাখা হয়।

সুতরাং ঘুমের ভেতর পাশ ফিরে ঘুমানোটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনভাবে ঘুম ভালো হয় সেটি জানতে চাইলে মানুষের অভিজ্ঞতার কথা শুনতেই পারি। তবে এ সম্পর্কে ডেটা কী বলে- সেটি জানাটাই বরং বিজ্ঞানভিত্তিক।

একটি ছোট আকারে পরিচালিত পর্যবেক্ষণমূলক সমীক্ষার কথা  এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই সমীক্ষা চালানোর সময় অংশগ্রহণকারীদের তাদের পছন্দ মতো ঘুমের জায়গা বাছাই করে নিতে দেওয়া হয়েছিল। দেখা গিয়েছে যে, যারা তাদের পছন্দের জায়গায় ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমাত, তারা বাম পাশে কাত হয়ে শোয়াদের তুলনায় সামান্য ভালো ঘুমিয়েছেন। আর  চিৎ হয়ে ঘুমানো ব্যক্তিরা উপরের দুই দলের তুলনাতেই আরেকটু কম ভালো ঘুম দিয়েছেন।

কারও যদি পাশ ফিরে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে তাহলে সেটি তার আশপাশের ঘুমসঙ্গীর জন্য ভালো। নতুবা নাক ডাকার জন্য ঘুম নাও হতে পারে সঙ্গীর।

জাহাজে কর্মরত ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের ওপর চালানো আরেকটি ছোট পরিসরের গবেষণা বলছে, পিঠে ভর দিয়ে নিয়মিত শোয়ার কারণে মানুষেরা নাক ডাকেন বেশি, কেননা শ্বাস নিতে বাঁধার সৃষ্টি হয়।

এর বিপরীতে পাশ ফিরে ঘুমালে উপরের দিকে থাকা নাকের ছিদ্র দিয়ে বাতাস অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে এবং আলজিহ্বা (গলার পিছনের দিকে ঝুলে থাকা মাংসপিণ্ড) ও জিহ্বাকে গলা বন্ধ করতে দেয় না। বাতাসের অবাধ চলাচলের ফলে নাক ডাকার পরিমাণ কম হয়। প্রকৃতপক্ষে, কিছু ক্ষেত্রে, চিৎ হয়ে শোয়ার ধরন বদলে পাশ ফিরে শোওয়ার কারণে ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’র (ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা) সমস্যা সম্পূর্ণরূপে সমাধান করা গিয়েছে।

পাশ ফিরে শোয়ার আরো কিছু উপকারিতাও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়ার কন্টেইনার জাহাজে ওয়েল্ডারদের ঘুমের ধরন নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের পিঠের ওপর ভর দিয়ে ঘুমাতেন, পাশ ফিরে শোয়াদের তুলনায় তাদের পিঠে ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।

কিন্তু তার মানে এই নয়, পাশ ফিরে ঘুমানো সবার জন্য সমান উপকারি এবং সবার সমস্ত ব্যথা ও বেদনার উপশম ঘটাবে। এটি ব্যক্তিবিশেষের অসুস্থতা এবং ঘুমের সময় সে যে সঠিক অবস্থান নেন তার ওপর নির্ভর করে।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ব্যবহার করে রাতে ১২ ঘণ্টা স্বেচ্ছাসেবকদের ঘুম পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, নিয়মিত ঘাড় শক্ত হয়ে জেগে ওঠা ব্যক্তিরা ‘অস্বাভাবিক ধরনে পাশ ফিরে’ বেশি সময় ধরে ঘুমান।

‘অস্বাভাবিক ধরন’-টি আবার কীরকম- এ সংক্রান্ত প্রশ্ন যে কারও মনে আসতেই পারে। এর অর্থ হলো পাশ ফিরে এমনভাবে শোয়া যাতে একজন ব্যক্তির একটি উরু আরেকটি উরুর ওপর উঠে যায় এবং মেরুদণ্ড একটি মোচড়ানো অবস্থানে থাকে। বিপরীতে, কোন কিছুতে ভর দিয়ে বা সাপোর্ট নিয়ে পাশ ফিরে যারা ঘুমিয়েছেন তারা ঘাড়ের ব্যথা কম হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

অবশ্য এ গবেষণাটি নিশ্চিত করতে পারেনি- ‘দুমড়েমুচড়ে’ পাশ ফিরে ঘুমানোটাই ঘাড় ব্যথার কারণ নাকি ঘুমন্ত ব্যক্তিরা আরাম পাওয়ার একমাত্র উপায় ওভাবে ঘুমানো বেছে নিয়েছিলেন!

ঘুমের পর শরীরের বিভিন্ন অংশে যে ব্যথা হয়, এমন কিছু মানুষকে তাদের শোয়ার পজিশন পরিবর্তন করার ফলাফল নিয়েও গবেষণা রয়েছে।

পর্তুগালে একটি ফিটনেস প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায়, পিঠে ব্যথাযুক্ত ব্যক্তিদের পাশ ফিরে ঘুমাতে এবং ঘাড়ে ব্যথাযুক্ত ব্যক্তিদের তাদের চিৎ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল। চার সপ্তাহ পরে ৯0  শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেন যে তাদের নিজ নিজ ব্যথা কমেছে।

এই গবেষণার ফলাফলটি চমকপ্রদ হলেও এর সংকট হলো মাত্র ২০ জন এই গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন। এতো ছোট গবেষায় এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে ঘুমের অবস্থানের এই সাধারণ পরিবর্তনটি পিঠ বা ঘাড়ে ব্যথা ভোগকারী সকলের এত ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে আরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আরও অধ্যয়নের প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে আবার শয়নের ধরনের রকমফের পিঠে বা পাশে শোয়ার প্রশ্নে আটকে থাকে না। বরং কোনদিক উঁচু বা নিচু করে শুতে হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন- অ্যাসিডিটিতে গ্যাস পেট থেকে উঠে আসে, বুকে তীব্র জ্বালা সৃষ্টি করে। কখনও কখনও চিকিৎসকরা এই খুব অপ্রীতিকর ধরনের ব্যথা-জ্বালা-পোড়া উপশমে উঁচু করা বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর পরামর্শ দেন।

যদি অস্বস্তি বার বার হয়, তবে তাকে ‘গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ’ বলা হয়। যার পরিণতি গুরুতর হতে পারে। এর কারণ স্পষ্ট নয়, তবে একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো বাম দিকে পাশ ফিরে ঘুমালে পাকস্থলী এবং খাদ্যনালীর সংযোগস্থল গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের স্তর থেকে উপরে থাকে। ডান দিকে ঘুমালে খাদ্যনালীর স্ফিংটার বা গোলাকার পেশী শিথিল হয়ে অ্যাসিড বের হতে পারে। যদি কারো বুকজ্বালা হয়, তবে তার বাম দিকে বেশি ঘুমানোর চেষ্টা করা উচিত।

বেশিরভাগ মানুষ পাশ ফিরে বা পিঠের ওপর ঘুমান। যারা পেটে-বুকে ভর উপুড় হয়ে ঘুমান, তারা চোয়ালের ব্যথায় ভুগতে পারেন।

মুখ বালিশে চেপে রাখলে কী বলিরেখা বাড়ে? প্লাস্টিক সার্জনেরা বলছেন, মুখের ত্বককে ‘একটি ডাঁটার সাথে বাঁধা সামুদ্রিক শৈবাল’ এর মতো রাখলে অর্থাৎ খোলা বা চাপমুক্ত রাখলে সবচেয়ে ভালো থাকে।

ঘুমানোর সময় মুখমণ্ডলে সবচেয়ে কম চাপ দেওয়া উচিত, তাই উপুড় হয়ে ঘুমানো বাদ দিতে হবে। ত্বকের সুরক্ষা কারো কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলে, পাশ ফিরে ঘুমানোও আদর্শ নয়।

সবকিছু বিবেচনায় পাশ ফিরে ঘুমালে বেশি সুবিধা পাওয়া যায় বলেই মনে হয়। তবে সঠিক ভঙ্গি না হলে ঘাড় ও পিঠে ব্যথা হতে পারে। ঘুমানোর পজিশনের ওপর অ্যাসিডিটি সংকট কমা কিংবা বাড়া নির্ধারিত হতে পারে। চিৎ হয়ে ঘুমালে নাক ডাকা বাড়ে। তবে প্রত্যেকটি মানুষটি আলাদা বিধায় এটি এখনও কারো ভালো ঘুম হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে।

যদি কারও ঘুমের অবস্থানের কারণে এখন ভালো ঘুম না হয়, তাহলে তার শোয়ার ধরনে পরিবর্তনের চেষ্টা করা উচিত। একটি ডায়েরি বা কোনও জায়গায় পরিবর্তনের ধরন লিখে রাখা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন অবস্থান নিয়ে বেশি চিন্তা না করার কথা বলা হয়েছে, কারণ এতে হয়তো ঘুমের বদলে জেগে থাকতে হতে পারে।

বিবিসি অবলম্বনে

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত