ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আড়াই মাস পর রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির আসনে থাকা মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে সরব রাজনৈতিক অঙ্গন। এই প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে মতভিন্নতা। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক যারা, সেই জনগণের চাওয়া কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, রাষ্ট্রপতিকে রাখা কিংবা না রাখা তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। তারা চিন্তিত বাজারদর নিয়ে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মনোযোগ দেয়, তাই চান তারা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের পথে যেতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এই সরকার।
তবে আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে সরানোর দাবি সম্প্রতি তোলে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভও হয়েছে।
তবে দেশের বড় রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ার বিরোধী। তারা বলছে, এটা সাংবিধানিক সংকট গভীর করবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতিকে বিদায় করে দিতে চায়।
রাষ্ট্রপতিকে রাখা না রাখা নিয়ে রিকশাচালক শরীফ উদ্দিনের মত জানতে চেয়েছিল সকাল সন্ধ্যা। তিনি বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। আমরা কি জানি? যা ভালো হয়, তাই হোক।”
আরও কিছুক্ষণ কথা চালানোর পর তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি তো আওয়ামী লীগের লোক। এদের না থাকাই ভালো। সে সম্মান নিয়ে চলে গেলেই ভালো হয়।”
রিকশা চালাতে ময়মনসিংহ থেকে আসা শরীফের মতোই বক্তব্য দিলেন খিলগাঁওয়ের গোড়ান বাজারের চায়ের দোকানির মো. সুমন। তার ভাষ্যে, “রাষ্ট্রপতিরে শেখ হাসিনাই নিয়োগ দিছে। তারে ওইখানে না রাখলেই ভালো।”
তবে রাষ্ট্রপতিকে কীভাবে সরানো যায়, সে বিষয়ে কিছু জানা নেই শরীফ কিংবা সুমনের। সুমন বলেন, “আমি তো জানি না, কেমনে কী হয়। সব দল মিলে আলাপ করলেই তো ঝামেলা শেষ হয়।”
ভ্যানে সবজি বিক্রেতা হাসান আলীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমি কেমনে কমু? রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের তা টিকটকে দেখছি। তার না থাকাই ভালো। যারা জানে বুঝে, তারা মিইল্যা ঠিক করলেই হয়।”
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফয়সাল আহমেদ মত দিলেন, রাষ্ট্রপতিকে যদি সরাতেই হয়, তবে সবার মতের ভিত্তিতে তা করা উচিৎ।
“রাষ্ট্রপতিকে যদি বাদ দেওয়া জরুরি হয়, তাহলে তা সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করুক। এরকম মারামারি করার তো দরকার নাই। আমরা দেশে শান্তি চাই।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এক্ষেত্রে সাংবিধানিক জটিলতা এড়িয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষপাতি।
“এটা একটা জটিল অবস্থা। আপনি দাবি করলেই তো এটা হয়ে যাবে না। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করলে সাংবিধানিক জটিলতা হওয়ার কথাও আমরা শুনছি। ফলে, সব রাজনৈতিক দল আলোচনা করে সিদ্ধান্তই নেওয়া উচিৎ।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মুহম্মদ মোস্তাকিম আড়াই মাস পর রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের দাবি তোলা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতির এই সমস্যা শুরুতেই সমাধান করা উচিৎ ছিল। এই রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশেই তো এই সরকার হয়েছে। রাষ্ট্রপতি না থাকলে তো এই সরকারও অবৈধ হয়ে যাবে।
“এখন এটা নিয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি করা তো উচিৎ হবে না। এতে তো দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তো হবে না। এখন এই ঝামেলা কীভাবে মেটানো যায়, সেটা নিয়ে সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে আলাপ করাই ভালো।”
বাজার আর আইনশৃঙ্খলায় হতাশা
যাদের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যার কথা হয়েছে, তারা সবাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আড়াই মাসের কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের এই হতাশার কারণ বাজার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
আওয়ামী লীগ আমলে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতিতে এখনও লাগাম দিতে পারেনি এই সরকার।
জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছিল, সেপ্টেম্বরে তা এক অঙ্কের কোঠায় নামলেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরেই ছিল।
বাজারের সেই ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে রিকশাচালক শরীফ বলেন, “আওয়ামী লীগের উপর মানুষ ক্ষেপছেই তো বাজার ঠিক করতে পারে নাই। বাজারে কিছু কিনা যাইত না। এখনও তো একই অবস্থা। এই নিয়া আলাপ তো কোথাও হয় না।”
বাইকচালক মো. সুহেল বললেন, “আমরা তো সাধারণ মানুষ। আমাদের তো দল নাই, আমাদের নীতি পেটনীতি। এদিকে মনোযোগ তো কম। দেশে আইন ঠিক করা উচিৎ। আমরা যেন একটু আরামে থাকি। কিন্তু এই আলাপ তো কেউ করে না।”
অন্তর্বর্তী সরকারকে এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফয়সাল।
তিনি বলেন, “সরকারের বুঝতে হবে এখন কী জরুরি? মানুষ কেন আগের সরকারের উপর রাগ ছিল? তা যদি না বোঝে, তাহলে তো সমস্যা।
“বাজারে দাম কমে নাই, বরং বেড়েছে। সবাই জানে বাজারে সিন্ডিকেট কারা করেছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে তো কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। এদিকে সরকারের মনোযোগ বাড়ানো উচিৎ। তারপর বাকি কাজ করুক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তাকিমও একই মত জানিয়ে বলেন, “সরকারের অর্থনীতির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। গত আমলে লুটপাট করে তো আমাদের অর্থনীতি খারাপ হয়েছে। কিছু মানুষ বাদে বাকিদের কাছে টাকা নেই। এই দিকে সরকারের মনোযোগ সর্বোচ্চ থাকা উচিৎ।”
এই মুহূর্তে জনগণের চাওয়া কী, সেদিকে সরকারের মূল দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন অর্থনীতির অধ্যাপক, নাগরিক আন্দোলনের নেতা আনু মুহাম্মদও।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার মতে এই সরকারের দুটি কাজ প্রাধান্য দিয়ে করা উচিৎ। একটি হল বাজার নিয়ন্ত্রণ। বাজারে জিনিসপত্রের দামকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া। সিন্ডিকেট কারা ছিল তা কিন্তু চিহ্নিত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে মানুষের সমর্থন পাবে এই সরকার।
“আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পুলিশ ব্যবস্থা কীভাবে জনগণের পক্ষে কাজ করবে, সেইদিকে নজর দেওয়া জরুরি।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে সামনে থেকে অংশ নেওয়া আনু মুহাম্মদ রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন নিয়ে বলেন, “রাষ্ট্রপতি থাকলে কী কী সমস্যা হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি।
“যেকোনও সিদ্ধান্ত হলে সকল অংশীজনের সাথে বসেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাকেই প্রধান কাজ হিসাবে দেখা উচিৎ না।”