Beta
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা থেকে রাশিয়া কী চায়

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলী আকবর আহমদিয়ান।ছবি: এপি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলী আকবর আহমদিয়ান।ছবি: এপি।
[publishpress_authors_box]

রুশ গবেষক ও ফটোগ্রাফার-ডকুমেন্টারিয়ান আন্না লেভিনা দীর্ঘদিন ধরেই লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বসবাস করেন। সম্প্রতি ইসরায়েল লেবাননে হামলা শুরু করলে তিনি খাবারসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসায় মজুত করতে থাকেন।

গত বছরের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও সীমান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সেসময়ও আন্না যুদ্ধের আশঙ্কায় কিছু অপচনশীল খাদ্য কিনেছিলেন। সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু খাবারও এখনও তার রান্নাঘরে রয়ে গেছে।

লেভিনা বলেন, “অনুভূতিটা অবশ্যই অপ্রীতিকর, তবে আমি এক বছর ধরে এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

গত দুই সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল লেবাননে ভয়াবহ বিমান হামলা চালাচ্ছে। এর মাঝেই গত সোমবার রাত থেকে স্থল হামলাও শুরু করেছে। ইসরায়েলি হামলায় ইতোমধ্যে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং প্রায় ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ইসরায়েল কীভাবে অনবরত আবাসিক ভবনগুলোতে বোমা বর্ষণ করছে সে সম্পর্কে লেভিনা আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আর ঠিক তখনই তার বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি মেডিকেল সেন্টারে আরেকটি বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।

লেভিনা বলেন, “মানবিক স্তরে এর মোকাবেলা করা কঠিন।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্নার দেশ রাশিয়ার জন্যও ইসরায়েল ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ কৌশলগত পর্যায়ে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি ‘মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড’ বা বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা চায়। হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনাও বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হল, এই সংকট একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসাবে রাশিয়ার স্বার্থের জন্য কী অর্থ বহন করে?

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারঅ্যাকশন অ্যান্ড কো-অপারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাব থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সদস্য আলেক্সি মালিনিন আল জাজিরাকে বলেন, “আরব-ইসরায়েল সংঘাতের চলমান বৃদ্ধি রাশিয়ার জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।”

এ কারণেই রাশিয়া বারবার সকল বিরোধ কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে বলে জানান তিনি।

“তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় যেকোনোও পরিস্থিতিতে সামরিক দিক থেকে ইসরায়েলকে সহায়তার ইচ্ছা প্রকাশ করার ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো ক্রমাগত ভেস্তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন পেয়েই ইসরায়েল লেবাননকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার সাহস পায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে যেসব বিবৃতি দিয়েছে, সেগুলোও অর্থহীন এবং বাতিল হয়ে যায়”, বলেন আলেক্সি মালিনিন।

ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবিচল সমর্থনের বিপরীতে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লেবাননে ইসরায়েলি সৈন্যদের প্রবেশের নিন্দা করেছে। এমনকি ইসরায়েলকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বানও জানিয়েছে। রাশিয়া হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছে যে, “ইসরায়েলই এই যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী।”

রাশিয়া এখনো একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের সঙ্গেও যদি ইসরায়েলের সরাসরি সংঘাত শুরু হয়, তখন আর রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না।

ইরানের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে রাশিয়া

ইউক্রেনে আগ্রাসনে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য ইরানি সহায়তা পেয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে তেহরানের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে মস্কো।

আজারবাইজানের বাকু ভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক স্বাধীন রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ রুসলান সুলেমানভ বলেন, “রাশিয়া গত আড়াই বছর ধরে সামরিক ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করছে।

“ইরানি অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে গেছে অনেক, যা আগে আর কখনোই দেখা যায়নি। রাশিয়া ইরানের অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।”

সুলেমানভ বলেন, ইরানের সামরিক প্রশিক্ষকরা এখন প্রায়ই রাশিয়া সফর করছেন এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে শাহেদ ড্রোন তৈরির জন্য একটি কারখানা তৈরি করতে সহায়তা করছেন।

তিনি বলেন, “এর ফলস্বরূপ, রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্রদের, যেমন হিজবুল্লাহ আন্দোলনকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে।”

মালিনিন যেখানে শান্তির প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার জন্য ওয়াশিংটনকে দোষারোপ করেছেন, সেখানে সুলেমানভের মতে, এই অঞ্চলে রাশিয়ার বর্তমান নীতিগুলো ‘ইরানের কক্ষপথে ঢুকে পড়ার’ প্রত্যক্ষ ফলাফল।

বিশৃঙ্খলা চাইলেও যুদ্ধ চায় না

মালিনিন ও সুলেমানভ উভয়েই অবশ্য একমত যে, রাশিয়া আরেকটি যুদ্ধ চায় না। সুলেমানভ বলেন, “মস্কো বিশাল কোনও অগ্নিঝড়ে আগ্রহী নয়, যা আমরা এপ্রিল মাসেও দেখেছি। যখন মনে হচ্ছিল যে ইরান ও ইসরায়েল একটি বড় যুদ্ধে প্রবেশ করছে, তখন রাশিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে ইরানের পক্ষ নেয়নি। ইরান ও ইসরায়েল উভয়কেই সংযম দেখানোর আহ্বান জানায় রাশিয়া।”

এপ্রিলে দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের কয়েকজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার নিহত হন। এর জবাবে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে প্রতিক্রিয়া জানায়। সেসময় দেশ দুটির মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। রাশিয়া সেই উত্তেজনা থামাতে ইরানকে সংযত থাকার আহ্বান জানায়।

তবে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ না চাইলেও বিশৃঙ্খলা চায়, কারণ এতে তাদের সুবিধা হয়। সুলেমানভ বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের বিশৃঙ্খলা থেকে রাশিয়া লাভবান হয়।”

তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউক্রেনে বেশি নজর দিতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি সমাধানেই তাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। ফলে রাশিয়া ইউক্রেনে নিজের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারবে।”

সুলেমানভ বলেন, “তবে রাশিয়া আরেকটি বড় যুদ্ধও দেখতে চায় না।”

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও ইরান উভয়েরই শত্রুতা রয়েছে। এজন্য তারা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারকে সমর্থন দেয়। রাশিয়ান যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহরগুলোতে বোমা বর্ষণ করে। আর হিজবুল্লাহ আসাদ সরকারের বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। সিরিয়ায় রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, যার মধ্যে সামরিক ঘাঁটি এবং তেল ও গ্যাসের মজুতও অন্তর্ভুক্ত।

ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত করতে মস্কো তেহরানের ওপর তার প্রভাব ব্যবহার করে হিজবুল্লাহকে সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে সরে যেতে রাজি করায়।

বৈরুত-ভিত্তিক রাশিয়ান গবেষক লেভিনা বলেন, পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে যে, সিরিয়া নিয়ে ইসরায়েল ও রাশিয়ার মধ্যে নিরঙ্কুশ বোঝাপড়া রয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক হার্ডওয়্যার সরবরাহ করতে রাজি হয়নি ইসরায়েল। রাশিয়াও ইসরায়েলকে এর প্রতিদান দেয়। ইসরায়েল যখন দক্ষিণ সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর অবস্থানগুলোতে হামলা চালায়, রাশিয়া তখন ইসরায়েলকে বাধা দেয়নি। অথচ সেখানে রাশিয়ার সৈন্যরা মোতায়েন ছিল।

লেবানন ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে রাশিয়ার জটিল সম্পর্কের ইতিহাস

লেবাননের ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্বার্থ সীমিত। সোভিয়েত আমলে লেবাননের ছাত্রদের বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বর্তমান রাশিয়ার জন্যও তাদের কিছু সহানুভূতি রয়েছে, যা মাঝে মাঝে শিয়া এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টান এলাকায় প্রদর্শিত পুতিনের বিলবোর্ড দেখে বোঝা যায়।

লেভিনা বলেন, “সোভিয়েত রাশিয়া লেবাননের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল এবং তাদের স্বার্থে মিল ছিল। লেবাননে বসবাসকারী ফিলিস্তিন ও আর্মেনীয়দের বিষয়েও তারা এক ছিল।

“কিন্তু এখন লেবাননের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ততটা বিস্তৃত নয়। আর হিজবুল্লাহর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান দীর্ঘকাল ধরেই জটিল।”

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহ সোভিয়েত রাশিয়ার তিনজন কূটনীতিককে জিম্মি করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে দিয়ে সিরিয়াকে চাপ দেওয়ানো, যাতে তারা ত্রিপোলিতে গোলাবর্ষণ বন্ধ করে। সিরিয়ার সেসময়কার সরকারের ওপরও রাশিয়ার বেশ প্রভাব ছিল।

কিন্তু হিজবুল্লাহ একজন জিম্মিকে হত্যা করলে রাশিয়া ক্ষেপে যায়। এর বদলা হিসেবে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এক হিজবুল্লাহ নেতার একজন আত্মীয়কে অপহরণ করে এবং তার অণ্ডকোষ কেটে হিজবুল্লাহর কাছে প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেয়।

এতে হিজবুল্লাহ ভয় পেয়ে বাকি দুই জিম্মিকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে দেয়। তবে এই ঘটনা হিজবুল্লাহ বা রাশিয়া কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।

লেবানন ও রাশিয়া কার্যত মিত্র হলেও খুব বেশি ঘনিষ্ঠ নয় এবং সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর অব্যাহত উপস্থিতি নিয়েও উত্তেজনার খবর পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার রাশিয়া একটি জরুরি বিমানে করে লেবানন থেকে রুশ কূটনৈতিক কর্মীদের পরিবারের মোট ৬০ জন সদস্যকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে এখনও ৩ হাজারের বেশি রুশ নাগরিক দেশটিতে রয়ে গেছে। বিমানটিতে করে রাশিয়া লেবাননকে খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং পাওয়ার জেনারেটর সহ ৩৩ টন মানবিক সহায়তাও পাঠিয়েছে। রাশিয়া তার আরও নাগরিককে লেবানন থেকে সরিয়ে নিতে পারে।

লেভিনার প্রত্যাশা হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, “পরিস্থিতি অবশ্যই খুব অপ্রীতিকর ছিল, কিন্তু আমি বলতে সাহস করি, স্থল হামলাটি ছিল ভালো খবর। কারণ ইসরায়েল তৃতীয়বারের মতো এই ভুল করছে।”

লেভিনা ১৯৮২ ও ২০০৬ সালে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের উল্লেখ করেন। অবশ্য ১৯৭৮ সালেও একবার ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছিল।

আন্না লেভিনা বলেন, “ইসরায়েলিরা লেবাননে আগের আগ্রাসনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে মোটেও কোনও শিক্ষা গ্রহণ করেনি।”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত