“পোলাপানরা সব সড়কে বইসা আছে, কোনও গাড়ি চলতাছে না। আমি এখন ভালুকা কেমনে যামু বাবা?”- সোমবার বেলা ২টার দিকে পরিচিত কাউকে ফোন করে এভাবেই নিজের বিপদের কথা বলছিলেন এক বৃদ্ধা। অবরোধের কারণে ঢাকার মহাখালীতে আটকা পড়েছিলেন তিনি।
তাহেরা বেগম নামে ওই বৃদ্ধা জানান, কেরানীগঞ্জে নিজের মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। এখন নিজের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকায় ফিরবেন। সকালে অটোরিকশায় মহাখালী এসে বাসে উঠবেন। কিন্তু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে আটকে পড়েছেন।
এই অবরোধের মধ্যে আক্রান্ত হয় নোয়াখালী থেকে আসা উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি। দুপুর পৌনে ১২টায় ট্রেনটি মহাখালী রেলক্রসিংয়ে এলে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা এটি থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্রেনটি না থেমে গতি কমিয়ে চলতে থাকলে সেটি লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা।
তাতে আহত হন নোয়াখালী থেকে আসা ফোরকান উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস এবং তাদের শিশু সন্তান। জান্নাতুলের মাথায় ১৪টি সেলাই লেগেছে।
চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে ঢাকায় এসেছিলেন ফোরকান। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পড়ে স্ত্রী-সন্তানের চিকিৎসা করিয়ে চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে পুনরায় রওনা হন নোয়াখালীতে।
ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মহাখালীতে সকাল থেকে অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাতে অচল ছিল সড়ক; প্রায় গোটা দেশের সঙ্গে রাজধানীর ট্রেন চলাচল ছিল বন্ধ।
বিকালে সেনাবাহিনী ও পুলিশের হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা মহাখালী মোড় ছেড়ে গেলে গাড়ি ও ট্রেন চলাচল পুনরায় শুরু হয়। তবে সন্ধ্যায় তারা কলেজ ক্যাম্পাসের সামনের সড়কে অবস্থান নিলে মহাখালী-গুলশান সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাত পর্যন্ত তারা সড়কেই ছিল।
তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের একাংশ আবার সচিবালয়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। তারাও সেখানে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল।
জিন্নাহ কলেজ থেকে তিতুমীরের নামে হওয়া ঢাকার কলেজটির শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে।
কেন বিশ্ববিদ্যালয় চাওয়া?
বর্তমানে তিতুমীর কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত। কিন্তু তাতে নানা সংকট দেখা দেওয়ায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল বহু দিন ধরে। সেই সমস্যার সমাধানের দাওয়াই হিসাবে তারা ভাবছে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
এর আগে গত ৬ নভেম্বর এই দাবিতে কলেজের সামনের সড়কে মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিল তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা। তার আগে ৩০ নভেম্বরও কলেজের সামনের সড়ক ২ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে তারা। এরপর সোমবার মহখালীতে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি ডাকে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরই একমাত্র দাবি নয় বলে জানান বিক্ষোভে থাকা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. লিমন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে আমাদের মূল দাবি, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন। চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পড়াশুনা শেষ করতে করতে ৭-৮ বছর সময় লেগে যায়। আমরা চাই এই সেশনজট থেকে মুক্তি পাক শিক্ষার্থীরা।”
আন্দোলনে নামার কারণ ব্যাখ্যা করে লিমন বলেন, “আমাদের কলেজে প্রত্যেকটি বিভাগে শিক্ষকের সংকট, ল্যাব ফ্যাসিলিটি নেই। দীর্ঘদিনের এসব সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। তাই বাধ্য হয়েই সড়কে নামতে হয়েছে আমাদের।”
কলেজের ভূগোল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীর মো. আল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা ক্লাস করি কলেজের শিক্ষকদের কাছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় আমাদের প্রশ্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এই ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাই আমরা।”
একই বিভাগের শিক্ষার্থী শান্ত ইসলাম বলেন, “আমি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম ২০২১-২০২২ সেশনে। এখন পড়ছি সেকেন্ড ইয়ারে। এরই মধ্যে আমাদের ৫ মাস সেশনজট হয়ে গেছে। আমাদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে আগামী ২০ জানুয়ারি, আর শেষ ৯ এপ্রিল। মাত্র ৮টি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ৪ মাস সময়ের প্রয়োজন কেন?
“আবার এই পরীক্ষার পর আরও ১-২ মাস লাগবে প্র্যাক্টিক্যাল ও ভাইভা শেষ হতে। তার মানে সেকেন্ড ইয়ার শেষ করতে করতেই ১ বছরের বেশি সময় সেশনজটে পড়তে হবে আমাদের।”
তিনি বলেন, “আমাদের সময়ের কী কোনও মূল্য নেই? এই বাড়তি সময়ের জন্য আমাদের থাকা-খাওয়ার পেছনে কত বাড়তি খরচ হয়, সেই হিসাব কি কেউ করে?”
কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ হাসান মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় না হলে তাদের এই সংকটের সুরাহা হবে না।
“এই দাবি পূরণ হলেই কেবল আমরা এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাব। তাই এটা আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক আন্দোলন।”
শুধু তিতুমীরই নয়, ঢাকার সরকারি আরও ছয়টি কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত। এগুলোকে অধিভুক্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৭ সালে। এরপর বিভিন্ন সময় এই কলেজের শিক্ষার্থীরা নানা সংকট নিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সবগুলোর জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। তবে এখন তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের জন্যই একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাইছে।
ফরহাদ বলেন, “আমরা চাই, সরকারি তিতুমীর কলেজকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপান্তরের জন্য কমিশন গঠন করা হোক। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে ৭ কলেজ থেকে সরকারি তিতুমীর কলেজকে আলাদা করতে হবে। একই সঙ্গে একক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা দিক সরকার।”
তবে তাদের আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাও স্বীকার করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, “আমরা বুঝতেছি, অনেক মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য এই আন্দোলনের বিকল্প ছিল না।”
ট্রেনে পাথর ছোড়ার কারণ জানতে চাইলে ফরহান বলেন, “এটা কারা করেছে, আমরা জানি না। কাজটি আসলেই উচিৎ হয়নি। কয়েকজন আহতও হয়েছেন, বিষয়টি দুঃখজনক।”
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, “আমাদের এই দাবি দীর্ঘদিনের। আমরা শুরুতেই রাস্তায় নামিনি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেও আমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি।
“কিন্তু কারও পক্ষ থেকে আমরা কোনও রেসপন্স পাইনি। তাই বাধ্য হয়েই সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি নিতে হয়েছে আমাদের।”
তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সোমবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, “তিতুমীর কলেজের ভাই-বোনদের বলব, আপনারা শান্ত হন। ৭ কলেজের বিষয়ে কথা চলছে। একটা আশু সমাধান আসবে বলে আমরা আশা করি।”
জিন্নাহ থেকে তিতুমীর
ঢাকার মহাখালীতে তিতুমীর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। তখন নাম ছিল জিন্নাহ কলেজ। স্বাধীনতার পর কলেজটির নাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা তিতুমীরের নামে করা হয়। ১১ একর আয়তনের এই কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ৩৫ হাজারের মতো।
এক সময় দেশের সব কলেজই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ছিল। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সব কলেজই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
তারপর েথকে এভাবেই চলছিল। ২০১৭ সালে আকস্মিক এক সিদ্ধান্তে রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
তিতুমীর বাদে অন্য কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর থেকে কলেজগুলোতে নানা ধরনের সমস্যা লেগেই রয়েছে। পাঠদানে সমন্বয়হীনতা, খাতার অবমূল্যায়ন, ফল বিপর্যয়সহ নানা সমস্যা নিয়ে রাজপথও নেমেছে এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কলেজগুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা সমাধানে গত ২৪ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।
এদিকে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করতে চাইছে- এমন বার্তাও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজকে আলাদা করা হোক, তা তারাও চান।
তারমধ্যেই স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুলেছে তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশে বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি।