যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয় যাত্রা শুরু করেই নানা বক্তব্যে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভিবাসন, শুল্কসহ তার ঘোষিত নানা নীতির প্রভাব পড়বে বিশ্বের অন্য সব দেশেই।
ট্রাম্পের এই ফেরা দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশীদার ভারতের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে বিবিসি বাংলা শুক্রবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
তাতে প্রতিবেদক শুভজ্যোতি ঘোষ দেখাতে চেয়েছেন, নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ধরে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো ভারত-মার্কিন সমীকরণের যে নতুন সম্ভাবনায় বুক বাঁধছিলেন, তা থিতিয়ে গেছে কয়েকদিনেই।
তবে বাংলাদেশ নিয়ে পূর্ববর্তী জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের যে তৎপরতা ছিল, রিপাবলিকান ট্রাম্পের প্রশাসনে তার পরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশা করছে নয়া দিল্লি।
বাংলাদেশকে মূল্যায়নে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে মতভেদের বিষয়টি তুলে শুভজ্যোতি ঘোষ লিখেছেন, “শেখ হাসিনার আমলকে দিল্লি আগাগোড়া ‘স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল’ বাংলাদেশ বলে বর্ণনা করে এসেছে, যে মূল্যায়নের সঙ্গে আমেরিকা কখনওই একমত ছিল না।
“বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে – আর তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ সামনেও এসেছে বহুবার।”
বাংলাদেশে যে শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে মূল্যায়নে দিল্লি-ওয়াশিংটনে মতভেদ ছিল, সেই শেখ হাসিনা গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। তারপর থেকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কেও চলছে টানাপড়েন।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, “ভারত এখন আশা করছে, ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার অতি সক্রিয়তা অনেকটাই কমে আসবে। কারণ সুদূর দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশে কী ঘটছে না ঘটছে, তা নিয়ে নতুন প্রশাসন হয়ত তেমন মাথা ঘামাবে না।”
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার আগে দিল্লিতে বলেছিলেন, “এখন আমরা সবাই সম্ভবত এক নতুন যুগের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। আমেরিকা তার নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে বিদেশ নীতি তৈরি করবে এবার, গোটা বিশ্বের ভালোমন্দ নিয়ে অত মাথা ঘামাতে যাবে না।”
ফলে বাংলাদেশ নিয়েও ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক নিস্পৃহতা দেখাবে এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আবার আগের মতো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেবে, দিল্লির পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে এমন ব্যাখ্যা পাওয়ার কথা লিখেছেন শুভজ্যোতি ঘোষ।
জয়শঙ্কর এই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গও এসেছে। তবে ঠিক কী আলোচনা হয়েছে, তা তিনি খোলাসা করেননি।
তবে বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন শুরুতেই ভারতের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ দেখছেন না জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ।
তবে তিনিও বিবিসিকে বলেন, “বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর যে নির্যাতনের প্রশ্নে ভারত গত বেশ কিছুদিন ধরে সরব কিংবা বাংলাদেশের মাটিতে ইদানীং যে ধরনের ভারতবিরোধী কার্যকলাপ দিল্লিকে উদ্বিগ্ন রেখেছে, সেগুলোতে অন্তত ট্রাম্প প্রশাসন ইতিবাচক ভূমিকা নেবে বলে অবশ্যই আশা করা হচ্ছে।”
গত নভেম্বরে ভোটের ঠিক আগেই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে মনে করা হয়, ভারতীয়দের ভোট টানাই ছিল তার সেই সরবতার উদ্দেশ্য।
তবে বাইডেন জমানায় বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মতপার্থক্য যতটা তীব্র রূপ নিয়েছিল, তার বেশি অবনতি আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন ভারতের কূটনৈতিক মহল।
মোদীতে কি মজবেন ট্রাম্প
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রে মোদীর ট্রাম্প বন্দনা আজকের নয়। গত ৬ নভেম্বর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে উচ্ছ্বসিত অভিবাদন জানাতে দেরি করেননি মোদী।
মোদী ও ট্রাম্পের যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যমে আলোচনা কয়েক বছর ধরেই। দুজনের ‘পপুলিস্ট’ চরিত্রে সমরূপতার কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও আসে বহুবার।
২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য লড়েছিলেন, তখন মোদীই একমাত্র বিশ্বনেতা, যার সঙ্গে তিনি দুটি প্রকাশ্য জনসভায় অংশ নেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেক্সাসের হিউস্টনে ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের হাত ধরে ‘আব কি বার, ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান দিতেও দ্বিধা করেননি। ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রীর বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদেশি কোনও নেতার হয়ে নির্বাচনী জয়ধ্বনি দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনাটি মোদীই ঘটিয়েছিলেন।
আবার তার মাস পাঁচেকের মধ্যেই গুজরাটের আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে।
দুই নেতার মধ্যে তখন যে ধরনের প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব ও মাখামাখি চোখে পড়ত, গত কয়েক মাসে তার ছিটেফোঁটাও না দেখার কথা লিখেছে বিবিসি।
গত সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরেও দুজনের দেখা হয়নি। নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর মোদী তাকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এরপর আর দুজনের মধ্যে সরাসরি কথাবার্তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্পের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও মোদীকে দেখা যায়নি, তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।
এর মধ্যে নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে দিল্লিতে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে।
ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’র পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন এই বছরই ভারতে হওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাম্প সেখানে যাবেন কি না, তাও এখনও নিশ্চিত নয়।
এর মধ্যে ট্রাম্পের কয়েকটি পদক্ষেপ ভারত সরকারের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে বিবিসি।
শুল্ক যুদ্ধ : প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্ক বসানোর পরিকপ্লনা জানান।
আমেরিকায় বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের চাহিদা কমাতে এবং বিশ্বের অন্যান্য বাজারে মার্কিন পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে তিনি যে এই বাণিজ্য অস্ত্রটি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবেন না, সেই হুমকি তিনি আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।
ভারতেরও এনিয়ে শঙ্কার কারণ আছে। কারণ এক সময় ট্রাম্প ভারতকে ‘ট্যারিফ কিং’ বলেছিলেন। তার দাবি, ভারতের মতো এত চড়া হারে আমদানি শুল্ক আর কোনও দেশই বসায় না, অথচ তারা আমেরিকার বাজারে কম শুল্কে রপ্তানি করতে চায়।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে এই হুমকির কিছুটা অন্তত ট্রাম্প কাজেও করে দেখাবেন বলে ভারতের পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
ভারতকে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। আমেরিকা বিশ্বে ভারতের সব চেয়ে বড় বাজার। ফলে সেখানে চড়া হারে শুল্ক বসানো হলে সেই ঘাটতি যেমন বাড়বে, ভারতের প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক স্বামীনাথন আইয়ার বিবিসিকে বলেন, “এটা তো পরিষ্কার যে আমেরিকাকে গ্রেট বানানোই তার লক্ষ্য, ভারতকে নয়! কাজেই ভারত যদি তাদের নিজেদের চড়া শুল্ক না কমায়, আমেরিকায় বাজারেও ভারতের ওপর বিরাট ট্যারিফ বসানোটা একরকম অবধারিত। আমি নিশ্চিত, ট্রাম্প এক্ষেত্রে অন্তত ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেন না।”
আইয়ার সেই সঙ্গেই আশঙ্কা করছেন, ইরান ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ট্রাম্পের আমলে আরও কঠোর করা হবে।
“এটাও ভারতের জন্য সুখবর নয়, কারণ গত কয়েক বছর ধরে ওই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ভারত যেভাবে রাশিয়া ও ইরান থেকে সস্তায় তেল কিনে আসছে, সেটাও এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।”
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত তিন বছরের মধ্যে রাশিয়া ভারতের প্রধান তেল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে সেই তেল ভারতে পরিশোধন করে ইউরোপে রপ্তানিও করছে।
ভিসা-অভিবাসন : ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, আমেরিকার কোম্পানিগুলো যাতে বিদেশ থেকে এনে কর্মী নিয়োগ না করে আমেরিকার বাসিন্দাদেরই চাকরি দেয়, সেই লক্ষ্যে তিনি এইচ-ওয়ানবি ভিসার সংখ্যায় ব্যাপক ছাঁটাই করবেন।
এই নন-ইমিগ্র্যান্ট মার্কিন ভিসায় কোম্পানিগুলো আধুনিক বিশেষায়িত প্রযুক্তি বা তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বিদেশি কর্মীদের সাময়িকভাবে নিয়োগ করতে পারে। গত কয়েক দশকে লাখ লাখ ভারতীয় এই ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তাদের অনেকেই তথ্য প্রযুক্তি খাতে কর্মরত।
এছাড়া প্রতি বছর যে হাজার হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে যায়, তাদের ভিসার সংখ্যাও কমানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
ফলে ট্রাম্প জমানায় ভারতীয়দের জন্য এইচ-ওয়ানবির দরজা আরও কঠিন হয়ে যাবে, এই শঙ্কা আছে। তবে সংখ্যায় কম হলেও ভারতীয়রা হয়ত এখন যুক্তরাষ্ট্রে বেশি বেতনের চাকরি পাবেন, এই সম্ভাবনাও থাকছে।
আবার সঠিক কাগজপত্র ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছনো কয়েক লাখ ভারতীয়র ভবিষ্যৎও এখন অনিশ্চয়তা পড়েছে। ২০২৪ সালে পিউ রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আমেরিকায় ‘আনডকুমেন্টেড ইমিগ্র্যান্ট’দের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ৭,২৫,০০০।
অভিবাসনের প্রশ্নে অনেক শিথিল মনোভাব দেখানো বাইডেন আমলেই ২০২৪ সালে দেড় হাজারের মতো ভারতীয়কে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সেখানে ট্রাম্প আরও কঠোর। আর সেটা মোদী সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে।
আইনি অস্বস্তি: গত বছর প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে নিউ ইয়র্কে একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ভারতের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল তা দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ডেকে এনেছিল অস্বস্তি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সেই মামলা এখনও চলছে।
আমেরিকায় ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুশান্ত সিং বলছেন, এই মামলার বিষয়ে যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করছে কানাডা। সেই তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও এই মামলায় অভিযুক্ত করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাম্পের নতুন নিয়োগ এক্ষেত্রে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে, যা তুলে ধরেন অধ্যাপক সুশান্ত সিং।
তিনি বলেন, “ট্রাম্প কিন্তু মানবাধিকার বিষয়ক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে নিয়োগ করলেন হরমিত ধিলোঁকে, যিনি ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরব।
“ভারতে কৃষক আন্দোলনের সময় তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানের নিন্দা করেছিলেন ধিলোঁ। কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর খুন হওয়ার পর তিনি প্রকাশ্যেই মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ফলে নতুন পদে নিয়োগ পাওয়ার পর হরমিত ধিলোঁ তার এই কঠোর অবস্থান ত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না।”
যুক্তরাষ্ট্রের চলমান আর একটি যে মামলা নিয়ে ভারতে তুমুল আগ্রহ আছে, তা হলো ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মামলা। যেই আদানিকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি হিসাবে গণ্য করা হয়।
ভারতের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে লাগাতার আক্রমণ করে আসছেন। যার জবাব দিতে গিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিজেপি নেতারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলছেন।
অধ্যাপক সুশান্ত সিং বলেন, “মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কিন্তু সে দেশের শাসক দলের কোনও বিভাগ নয়। বাইডেনই ক্ষমতায় থাকুন বা ট্রাম্প, এটি মূলত একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই কাজ করে। আর এই মার্কিন আমলাদের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর।”
সম্পর্ক তবে কেমন হবে
চার দিনের ব্যস্ত ওয়াশিংটনের সফর সেরে বুধবার দেশে ফেরার আগে জয়শঙ্করকে ভারতীয় একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে একেবারে সামনের সারিতে, প্রায় ট্রাম্পের মুখোমুখি আসনটা তিনি পেলেন কীভাবে?
জয়শঙ্কর জবাব দেন, “অনুষ্ঠানে যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ প্রতিনিধি, তিনি যে এটুকু খাতিরদারি পাবেন, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
শুভজ্যোতি ঘোষ লিখেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা থেকে স্পষ্ট, মোদী আর ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত রসায়ন’ আর সৌহার্দ্যপূর্ণ সমীকরণকে তারা এবারও খুব বড় করে দেখাতে চাইছেন, যার প্রভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও পড়বে বলে ভারত বোঝাতে চাইছে।
নতুন মার্কিন প্রশাসনে একটা উদ্দীপনা ও প্রাণশক্তির ছাপ দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন জয়শঙ্কর। মোদী ৩.০ যে ট্রাম্প ২.০ এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছে, সেটাও বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি।
ভারতের বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও পররাষ্ট্রনীতির পর্যবেক্ষক প্রভু চাওলা অবশ্য বিষয়টাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চান।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি মনে করি না, পার্সোনাল কেমিস্ট্রির এখানে তেমন কোনও ভূমিকা থাকবে। ট্রাম্প আসলে ভারতকে বলতে চাইছেন, আমেরিকার সঙ্গে তোমরা ডিল কর, অন্য দেশের সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক সেটা ভুলে গিয়ে, নইলে পরিণাম ভোগার জন্য প্রস্তুত থাক।
“এখন যদি ভারত দক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে এই কঠিন ভারসাম্যের খেলা দেখাতে পারে, তাহলে ভালো। তবে ভারত এই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে আমি নিশ্চিত নই।”
প্রভু চাওলা বলেন, নির্বাচনে জেতার দু’সপ্তাহের মধ্যেই ব্রিকস দেশগুলোকে ট্রাম্প হুমকি দেন যে তারা যদি ডলারের বদলে একটি ‘ব্রিকস কারেন্সি’ আনার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন।
ব্রিকসের সদস্য অন্য দেশগুলো এনিয়ে কিছু না বললেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মন্তব্য করেন, ভারত কখনোই বিশ্ব অর্থনীতিকে ডলারমুক্ত করার পক্ষে নয়।
এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, ভারত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ট্রাম্পকে এখনই কোনোভাবে চটাতে চাইছে না।
ট্রাম্পের প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভুত অনেকের জায়গা পাওয়া নিয়েও উচ্ছ্বাস রয়েছে ভারতীয়দের মধ্যে। তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক হতে যাচ্ছেন, এফবিআইর প্রধান হচ্ছেন কাশ প্যাটেল, স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বে আসবেন জয় ভট্টাচার্য, ‘এআই জার’ হবেন শ্রীরাম কৃষ্ণান।
তবে প্রভু চাওলা এই বিষয়টিতে অতটা গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তিনি বলেন, “এরা ভারতীয় অরিজিনের বলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা বলতে, পরস্পরকে বুঝতে হয়ত সুবিধা হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, তারা ভারতীয় নাম বা পেডিগ্রির অধিকারী হতে পারেন, কিন্তু তারা সবার আগে নির্ভেজাল ও আপসহীন আমেরিকান!”
সার্বিক বিষয় মিলিয়ে প্রভু চাওলার মতে, ভারতকে পা ফেলতে হবে সাবধানে।
কেন? তার উত্তর তিনি দিলেন এভাবে- “মোটের ওপর বাইডেন ২০২১-২৪ ছিল ভারতের জন্য একটা নো-উইন-নো-লস পর্ব, মানে লাভ-ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প ২০২৫-২৮ হতে যাচ্ছে ‘ডুয়েল টাইম’, মানে মুখোমুখি দ্বৈরথের সময়; যেখানে হারজিত এক রকম অবধারিত!”