Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেভাবে নারী বনাম পুরুষ ভোট হয়ে উঠল

US_President_Election_2024_Men_Women
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরুষ ভোটারদের মধ্যে বিশাল সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন। একইভাবে নারী ভোটারদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস।

রাজনীতিতে নারী-পুরুষের এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে গভীর পরিবর্তনকেই প্রতিফলিত করে। এই পরিবর্তন এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।

কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এছাড়া কমলা হলেন দ্বিতীয় নারী যিনি প্রেসিডেন্ট পদের এত কাছাকাছি চলে এসেছেন। তাই কমলা হ্যারিস তার লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে কথা না বলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

গত মাসে সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে কমলা হ্যারিস বলেন, “শুনুন আমি প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার দৌড়ে নেমেছি কারণ আমি বিশ্বাস করি, জাতি এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে এই মুহূর্তে আমেরিকানদের জন্য এই কাজটি করার জন্য আমিই সেরা ব্যক্তি।”

প্রতিযোগিতাটিকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ রাখার জন্য তার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও লিঙ্গ পরিচয়ই এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি বড় বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।

‘ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট’ আমেরিকার জন্য একটি নতুন ঘটনা হবে। আর এটি ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে, অনেক ভোটার ধারণাটিকে পছন্দ করলেও, কেউ কেউ একে কিছুটা বিরক্তিকর বলেই মনে করেন।

কমলা হ্যারিসের প্রচারদল বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি। তবে একজন কর্মকর্তা সম্প্রতি বিবিসির যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সংবাদদাতার কাছে স্বীকার করেছেন, তাদের বিশ্বাস ভোটারদের মধ্যে লুকানো লিঙ্গ বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যে কারণে অনেকে প্রেসিডেন্ট পদে কোনও নারীকে ভোট দেবেন না।

এই ২০২৪ সালে এসে খুব কম লোকই এটা প্রকাশ্যে বলার ঝুঁকি নেবে যে, তারা প্রেসিডেন্ট পদের জন্য কোনও নারীকে উপযুক্ত বলে মনে করেন না (যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লিঙ্গবিদ্বেষমূলক মিম শেয়ার করেন)।

একজন ডেমোক্রেট কৌশলবিদ বলেন, যখন কোনও ভোটার জরিপকারীদের বলেন যে, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ‘প্রস্তুত’ নন। তার সঠিক ‘ব্যক্তিত্ব’ বা ’প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যা দরকার’ তা নেই। এসব কথার মধ্যদিয়ে আসলে তাদের নারীবিদ্বেষই ফুটে ওঠে। তাদের এই কথাগুলোর পেছনের কথাটি হলো কমলা একজন নারী, তাই তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন।

তবে ট্রাম্পের প্রচার শিবির বলে, অনেকের কমলাকে পছন্দ না করার সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। গত সপ্তাহে বলা হয়েছে, “কমলা দুর্বল, অসৎ এবং বিপজ্জনকভাবে উদারপন্থী, এবং সে কারণেই আমেরিকান জনগণ তাকে ৫ নভেম্বর প্রত্যাখ্যান করবে”।

তবে ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের একজন সিনিয়র উপদেষ্টা ব্রায়ান ল্যাঞ্জা বিবিসির প্রতিবেদককে টেক্সট করেছেন, তিনি আত্মবিশ্বাসী যে ট্রাম্প জয়ী হবেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “আমাদের প্রার্থী একজন পুরুষ“।

আট বছর আগে হিলারি ক্লিনটন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে লড়াই করার সময়ও নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব স্পষ্টতই তার পরাজয়ের একটি বড় কারণ ছিল। তার প্রচার শিবিরের একটি স্লোগান ছিল ‘আইএম উইথ হার’, যেটিও তার গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে প্রতিফলিত করেনি।

কংগ্রেস সদস্য লিজ চেনি, যিনি ট্রাম্পকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলেছেন, কমলা হ্যারিসকে রিপাবলিকান নারীদের কাছে তুলে ধরতে সাহায্য করছেন।

পেনসিলভেনিয়ার কংগ্রেসওম্যান ম্যাডেলিন ডিন ভোটারদের সঙ্গে ক্লিনটনের প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনার কথা মনে রেখেছেন। গত সপ্তাহে ডিন যখন তার জেলায় প্রচার চালাচ্ছিলেন, তখন সিএনএনের প্রতিবেদক এক বিকালে তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাকে বলেন, ২০১৬ সালে লোকে তাকে বলত, “তার একটা বিশেষ ব্যাপার আছে”।

তিনি বলেন, তিনি দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন, “ব্যাপারটি তার লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কিত। তিনি যে নারী সেটাই একটা ব্যাপার ছিল। হিলারি যে একজন নারী, সেটাও একটা ব্যাপার ছিল।”

ডিন মনে করেন, সমাজে সেরকম অনুভূতি এখন অনেক কমে এসেছে। তথাপি তিনি স্বীকার করেছেন, এমনকি এখনও, “কিছু লোক আছে যারা একজন শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান নারীকে মেনে নিতে পারেন না”।

২০১৬ সাল থেকে নারীদের জন্য অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৭ সালে #MeToo আন্দোলন কর্মক্ষেত্রে নারীরা যে বৈষম্যের সম্মুখীন হয় সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছে। এটি কর্মজীবী নারীদের সম্পর্কে আমরা যেভাবে কথা বলি তাতে বদল এনেছে। MeToo হয়তো কমলা হ্যারিসের মতো প্রার্থীর জন্য মনোনয়ন নিশ্চিত করাও সহজ করে দিয়েছে।

কিন্তু বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে এই বড় পদক্ষেপগুলোকে কেউ কেউ এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া বলে ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষ করে তরুণ পুরুষদের জন্য, যারা মনে করছে যে তাদের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। অথবা পরিবর্তনগুলো কেবলমাত্র রক্ষণশীল আমেরিকানদের জন্য অনেক বেশি ছিল, যারা নারী-পুরুষের আরও ঐতিহ্যগত ভূমিকা পছন্দ করেন।

রবিবার প্রকাশিত সিবিএস নিউজের জরিপের ফলাফল ইঙ্গিত করে, এবারের প্রেসিডেন্ট প্রতিযোগিতায় প্রার্থীদের লিঙ্গ পরিচয় একটা বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। এ থেকে নারী-পুরুষের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর মনোভাবও প্রতিফলিত হয়।

সিবিএস নিউজের জরিপে দেখা গেছে, পুরুষরা বলে যে যুক্তরাষ্ট্রে লিঙ্গ সমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে; আর তাদের ট্রাম্প সমর্থক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

অন্যদিকে, বেশিরভাগ নারী বলেছেন, প্রচেষ্টাগুলো যথেষ্ট ছিল না। আর তাদের কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করার সম্ভাবনা বেশি।

কমলা হ্যারিস একজন শক্তিশালী নেতা হবেন, পুরুষদের এমনটা মনে করার সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় অনেক কম। বেশিরভাগ পুরুষ বলেছেন, তারা মনে করেন ট্রাম্প একজন শক্তিশালী নেতা হবেন।

তাই অনেক ভোটারের জন্যই এই নভেম্বরের নির্বাচন পুরুষ বনাম নারীর এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর সামাজিক উত্থান-পতনের গণভোটে পরিণত হয়েছে। এটি বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের বেলায় বিশেষভাবে সত্য বলে মনে হয়, কমলা হ্যারিস যাদের কাছে ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে পারছেন না। এই তরুণরা এমন একটি বিশ্বে বাস করে যা তরুণদের জন্য দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্স-এর পোলিং ডিরেক্টর জন ডেলা ভলপে বলেন, “তরুণ পুরুষরা প্রায়ই মনে করে যে, তারা প্রশ্ন করলে তাদের নারীবিদ্বেষী, সামকামী বিদ্বেষী, বা বর্ণবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে।”

“তাই তাদেরকে কেউ বুঝতে পারছে না, এমন অনুভূতি থেকে হতাশ হয়ে তাদের অনেকেই তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ইলন মাস্কের ব্রো-কালচারে আকৃষ্ট হয়। তারা দেখে যে ডেমোক্র্যাটরা কাকে অগ্রাধিকার দেয়— নারী, গর্ভপাতের অধিকার, এলজিটিবিকিউ সংস্কৃতি। তখন তারা জিজ্ঞেস করে “আমাদের সম্পর্কে কী? বা আমাদের কী হবে?”

তরুণ ভোটারদের ভোটদান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডেলা ভলপে বলেন, তিনি যে যুবকদের উল্লেখ করছেন তারা কোনও চরম ডানপন্থী চক্রের অংশ নয়। তারা আমাদের ছেলে, অথবা আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীর ছেলে।

তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের অনেকেই নারী-পুরুষের সমান অধিকারের সমর্থন করে। কিন্তু তারা এও মনে করে যে, তাদের নিজেদের উদ্বেগগুলো শোনা হচ্ছে না।

পুরুষালি বয়ান দিয়ে ট্রাম্প তরুণ পুরুষ ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন।

ডেলা ভলপে একাধিক পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেন, তরুণ নারীদের তুলনায় তরুণ পুরুষদের অবস্থা এখন বেশি খারাপ। তাদের প্রেমের সম্পর্কের সম্ভাবনা কম, আগের তুলনায় তাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনাও কম। নারীদের তুলনায় তাদের আত্মহত্যার হারও বেশি।

অন্যদিকে তরুণ আমেরিকান নারীরা এগিয়ে চলেছে। তারা পুরুষদের তুলনায় ভাল শিক্ষিত। তারা পরিষেবা শিল্পে কাজ করে যা ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমবর্ধমানভাবে তারা পুরুষদের থেকে বেশি উপার্জন করছে।

এমনকি গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তরুণ নারীরাও তরুণ পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি উদার হয়ে উঠেছে।

এমন পরিস্থিতি আমেরিকান সমাজে লিঙ্গগত তথা নারী-পুরুষ বিভাজন বাড়িয়েছে। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের মতে, গত ৭ বছরে যেসব যুবক বলেছে যুক্তরাষ্ট্র লিঙ্গ সমতায় ‘অনেক বেশি’ এগিয়ে গেছে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

যুবকদের এই অসন্তোষ টের পেয়ে ট্রাম্প পুরুষদের হতাশাকে পুঁজি করে প্রচরণা চালাচ্ছেন। প্রচারণার শেষ সপ্তাহগুলোতে তিনি পুরুষালি বয়ান দ্বিগুণ করেছেন। ট্রাম্প তার নিজের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, ট্রুথ সোশ্যালে একটি সতর্কবাণী পুনরায় পোস্ট করেছেন। ওই পোস্টে তিনি দাবি করেছেন, ‘পুরুষত্ব আক্রমণের মুখে।’

সম্প্রতি তিনি একজন বিখ্যাত গলফারের যৌনাঙ্গ নিয়ে রসিকতা করেছেন। ট্রাম্পের শ্রোতারা তার এই রসিকতা পছন্দ করে। কিন্তু এই ধরনের রসিকতা রাজনৈতিক শিষ্টাচার ধ্বংসের একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসাবেই দেখা হচ্ছে।

অন্যদিকে, তাদের সমাবেশে এবং বিভিন্ন সম্প্রচার চ্যানেলে অসন্তুষ্ট পুরুষদের প্রতি ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া কঠিন প্রেমের ডোজ বলে মনে হয়।

বারাক ওবামা তিরস্কার করে বলেন, “কিছু পুরুষ একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ভাবতে পারছেন না এবং তারা এর জন্য অন্য কারণ ও অজুহাত খাড়া করছেন।”

একটি নতুন টিভি বিজ্ঞাপনে অভিনেতা এড ও’নিল একটু চটকদার কিন্তু আরও সরাসরি বলেন, “পুরুষ হও: একজন নারীকে ভোট দাও।”

প্রচারের শেষ দিনগুলোতে পুরুষ বনাম নারী বিষয়টি সর্বত্র রয়েছে— আবার কোথাও নেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দৌড়ের সামনে ও কেন্দ্রে পুরুষত্ব চান। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস খুব কমই তার লিঙ্গ পরিচয় সামনে আনেন এবং তিনি নারী হিসাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তা দেখান না।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক জরিপে দেখা গেছে, পুরুষ ভোটারদের মধ্যে সমর্থনে ট্রাম্প কমলার চেয়ে ১৪ শতাংশ এগিয়ে রয়েছেন। আর কমলা হ্যারিস নারীদের মধ্যে সমর্থনে ট্রাম্পের চেয়ে ১২ শতাংশ এগিয়ে।

ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক, ছেলে এবং মেয়ে— তারাই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করে দিতে পারে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত