মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০২১ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। এর প্রতিবাদে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাজপথে নামা লাখো ছাত্র-জনতার মধ্যে ছিলেন ইয়াঙ্গুনের থো তি। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, প্ল্যাকার্ড। আর পুলিশের হাতে বন্দুক।
ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি ছোড়ার নির্দেশ পেয়েছিল পুলিশ। নির্দেশ মেনে তারা গুলি ছুড়েও ছিল। তাতে প্রাণ হারায় ছয় হাজারের বেশি মুক্তিকামী মানুষ।
সেসময় থো তি প্রাণে বাঁচলেও এই চার বছরে তিনি এবং তার প্রজন্ম অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। সেনাশাসনের নির্মমতা থেকে রেহাই পেতে এবং মুক্তির পথ খুঁজতে থো তির মতো অনেক তরুণ ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পালিয়ে যান। এসব অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে।
থো তি গিয়েছিলেন থাইল্যান্ড ঘেঁষা মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্য কায়িনে, যা আগে কারেন নামে পরিচিত ছিল। সেখানে তিনি দেশটির সবথেকে পুরনো সশস্ত্র গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নে (কেএনইউ) যোগ দেন। গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করে যাচ্ছে এই সংগঠন।
সম্প্রতি থো তির সঙ্গে কথা বলে আল জাজিরা। তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে জানান, ২০২১ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘটনা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল তাকে। সেসময়ই যোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন তিনি।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার পর আর সবার মতো থো তিকেও অস্ত্র চালানো, এবড়োখেবড়ো পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা, আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশল শিখতে হয়েছিল।
বন্দুক থেকে প্রথম গুলি ছোড়া শেখার সময় নিজের ভেতরে এক ধরনের দৃঢ়তা অনুভব করেছিলেন থো তি। চার বছর আগে ইয়াঙ্গুনে চোখের সামনে লড়াইয়ের সাথীদের সেনাবাহিনীর হাতে মরতে দেখেন তিনি।
অনেক অক্ষম মনে হতো নিজেকে তখন তার। এখন তেমনটা মনে হয় না। বন্দুক কাঁধে থাকলে ভয়ডর চলে যায়; নিজেকে শক্তিহীন লাগে না।
হেসেই তাই বললেন, “বন্দুক এখন আমার প্রিয়।”
যোদ্ধা হওয়া হলো না, তাই স্কুলশিক্ষক
বিদ্রোহ করার স্বপ্ন নিয়ে কায়িনে গিয়েছিলেন থো তি। কিন্তু একটা সময় পর বুঝতে পারেন, স্বপ্ন পূরণ সহজ নয়; দৃঢ় মনোবল আর সাহসী হলেই হয় না।
একদিকে রোগা দেহ, অন্যদিকে উচ্চতা কম। শারীরিক এই দুই অক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে বাঁচার মৌলিক জ্ঞান রপ্ত করতে পারলেও কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের মূল সামরিক প্রশিক্ষণে তিনি উতরাতে পারবেন না।
থো তি বলেন, “আমি এখানে বিদ্রোহে যোগে দিতে এসেছিলাম। কিন্তু নারী হিসেবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে।
“মানসিকভাবে পারলেও শারীরিকভাবে বিদ্রোহে শামিল হতে পারছি না আমি।”
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা না পারায় দমে যাননি থো তি। তিনি এবং তার স্বামী দুজনই পড়াশোনা করেছেন। কারেন ভাষা জানেন।
তাই কেএনইউর অনুমতি নিয়ে ওই অঞ্চলে একটি স্কুল খোলেন এই দম্পতি। সেখানে এখন তারা একশর বেশি শিশুকে পড়ান, যারা প্রত্যেকেই সংঘাতের কারণে ঘরছাড়া হয়ে কায়িন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে কারেন জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবি কখনোই মেনে নেয়নি সেনাবাহিনী। থেমে থেমে সেখানকার হাসপাতাল, স্কুলসহ অন্যান্য অবকাঠামো লক্ষ্য করে তারা বোমা নিক্ষেপ করে।
এ কারণে থো তি ও তার স্বামী স্কুলটি নির্মাণ করেছেন গহীন বনে, যাতে যুদ্ধবিমান থেকে তা দেখা না যায়।
স্বভাবতই তাদের এই স্কুল মিয়ানমারের মূলধারার স্কুল থেকে আলাদা। এটি সম্পর্কে থো তি বলেন, কারেনরা দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনদের হাতে অত্যাচারিত, নির্যাতিত। মূলধারার ইতিহাসে তাদের বঞ্চনা, লাঞ্ছনার কথা নেই।
তাই কারেনরা তাদের মতো করে মিয়ানমারের শোষিতদের নিয়ে ইতিহাস লিখেছে। সেই ইতিহাসই স্কুলটিতে পড়ানো হয়।
স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কারেনরা লড়াই করছে এখন না, বহু আগে থেকে। কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সংগঠন তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কেএনইউর সঙ্গে সেনাবাহিনীর (যাদের বড় অংশ বামার জাতিগোষ্ঠীর) লড়াই আরও তীব্র হয়।
কেবল কারেন নয়, মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গেও জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষের মাত্রা অনেক বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে জান্তা বাহিনী।
বিশেষ করে ২০২৪ সালে পশ্চিম সীমান্তের রাখাইন রাজ্যের পুরোটা এবং পূর্ব সীমান্তবর্তী শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলসহ সীমান্ত এলাকার বিস্তীর্ণ ভূ-খণ্ড বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায়। একই সঙ্গে উত্তরে কাচিন ও দক্ষিণ-পূর্বের কায়িন রাজ্যের অনেক অঞ্চল থেকেও জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহীরা।
তবে যোদ্ধাদের দখলে মিয়ানমার সীমান্তের অনেক অঞ্চল চলে এলেও এসব অঞ্চল পরিচালনা করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে জনসেবায়
গত বছরের মার্চে কায়িন রাজ্যের কিয়াকদন শহর জান্তা বাহিনীমুক্ত করে বিদ্রোহীরা। শহরটিতে সম্প্রতি যায় আল জাজিরার সংবাদকর্মীরা। তারা দেখেন, কিয়াকদন শহরের রেস্তোরাঁগুলো বেসামরিক নাগরিক ও কেএনইউর যোদ্ধায় পূর্ণ। দোকানপাট খোলা, প্রধান সড়কে চলছে যানবাহন।
কিয়াকদনের অন্তর্বর্তী প্রশাসকের নাম সো খান্ত। ৩৩ বছর বয়সী এই তরুণকে কেএনইউ নিয়োগ দিয়েছে। এক বছর পর নির্বাচনের আগে স্বাধীন ওই অঞ্চলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা আছে তার।
সো খান্ত বলেন, “এক বছরের মধ্যে আমি জনসেবার কাজ শেষ করতে চাই। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাই। শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে চাই।”
তিনি মনে করেন, বাছাই হওয়ার চেয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়াই শ্রেয়। “জনগণ যদি আমাকে চায়, তাহলে আমি কিয়াকদনের প্রশাসক হবো। যদি তারা অন্য কাউকে নির্বাচিত করে, আমি নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেব,” যোগ করেন তিনি।
শহরটির মানুষের চাওয়ায় জান্তা সরকার কখনোই কর্ণপাত করেনি বলে জানান সো খান্ত।
কিয়াকদন শহরেই বেড়ে ওঠেন তিনি। ছোটবেলায় শহরটির কাছের এক পাহাড়ের চূড়ায় বন্ধুর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই উঠতেন।
সেখানে বসে তারা ধুলোমাখা রাস্তার চারদিক ঘিরে থাকা সারি সারি বাড়ির ছবি আঁকতেন। নদীর ছবি আঁকতেন। কাছেই থাইল্যান্ড সীমান্তঘেঁষা পর্বতমালার ছবি এঁকে ড্রয়িং খাতা ভরাতেন।
বড় হয়ে ছবি আঁকা বাদ দিয়ে ছবি তোলায় মন দেন সো খান্ত। বিয়ের ছবি তোলা ছিল উপার্জনের মাধ্যম।
কিন্তু ২০২০ সালে মিয়ানমারজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্রতিষ্ঠা করে সমাজকল্যাণমূলক এক সংগঠন।
পরের বছর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন শুরু হলে কিয়াকদন শহরের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে।
সো খান্ত বলেন, “এখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে মানুষের কল্যাণে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা শুরু করি।”
কায়িন রাজ্যের কিয়াকদন শহরে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতা সো খান্তের না থাকলেও রাজ্যটির ছোট ছোট অঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে এ কাজ করে আসছে কেএনইউ।
পুলিশের চাকরি ছেড়ে বিদ্রোহে
কায়িন রাজ্যের কোকারিক টাউনশিপের সেক্রেটারি মায়া আয়ে। তিনি আল জাজিরাকে ব্যাখ্যা করেন, দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধবিগ্রহ ও এর ফলে সৃষ্ট লোকবলের অভাব কীভাবে স্থানীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। মানুষের সেবা করতে গিয়ে কেএনইউ কীভাবে প্রতি পদে পদে বাধার মুখে পড়ে, তাও ব্যাখ্যা করেন তিনি।
মায়া আয়ে বলেন, “এখানে কোনও কারখানা নেই। শিল্প নেই। কাজ করে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ারও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে জীবিকার সন্ধানে তরুণরা প্রতিবেশি দেশ থাইল্যান্ডে চলে যাচ্ছে।”
তবে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু সামরিক শাসনের নিষ্ঠুরতা; এটি প্রতিরোধ সংগ্রামকে আরও উসকে দেয় বলে জানান মায়া আয়ে।
প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দেওয়াদের আরেকজন ৩৩ বছর বয়সী উইন তুন। একসময় মিয়ানমার পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। ১০ বছর কাজ করেছেন সেখানে।
২০২১ সালে গণতন্ত্রকামীদের দমন-পীড়ন ও গ্রেপ্তার করার নির্দেশ অমান্য করে কেএনইউতে যোগ দেন তিনি।
উইন তুন বলেন, “কিশোর বয়সে পুলিশের কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করতাম, পুলিশে যারা কাজ করে তারা সৎ এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
“কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতি, বৈষম্য ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি পুলিশ বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।”
বামার জাতিগোষ্ঠীর এই সদস্য জানান, পুলিশে কাজ করার সময় তিনি তার কারেন জাতিগোষ্ঠীর সহকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অন্যায় আচরণ করতে দেখেছেন। তাদের কেউ যদি খুব ছোট কোনও ভুল করতেন, তাহলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হতো।
এসব অন্যায় দেখে বেশ কয়েকবার পদত্যাগপত্র জমা দেন উইন তুন। প্রতিবারই সেগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়।
শেষমেশ ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কারেন জাতিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পালিয়ে যান উইন তুন। এখন তিনি কেএনইউর পুলিশ বাহিনীতে কাজ করছেন।
পথ আরও বাকি
সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও বিপ্লব বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দেখে থো তির মতো শিক্ষিত তরুণ বা দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করা উইন তুনের মতো ব্যক্তিরা মিয়ানমারের সদ্য স্বাধীন হওয়া অঞ্চলগুলোর প্রশাসনে লোকবলের ঘাটতি পূরণ করছেন।
তাদের অধিকাংশেরই ধারণা ছিল, ক্ষমতা থেকে সেনা কর্মকর্তাদের বিতাড়িত করতে মাত্র কয়েক মাস বা বড়জোর কয়েক বছর লাগবে। কিন্তু তা হয়নি। বারবার বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হওয়ার পরও সামরিক বাহিনী এখনও ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
তাই বিপ্লবের পথে অর্জনের পাশাপাশি ভুলগুলোও খতিয়ে দেখছেন থো তি থেকে শুরু করে উইন তুন সবাই।
থো তি বলেন, “আমাদের মনে হচ্ছে আমরা খুব দ্রুত এগিয়েছি; আসলে আমরা বেশিদূর যেতে পারিনি।”