Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

কলাম

দুদক গদাইলস্করী ছেড়ে অটোমোবাইলের গতি পাবে কবে

মঈদুল ইসলাম। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, কথায় আছে। কিন্তু, কতগুলো চোর পালালে বুদ্ধি বাড়বে তা কি আছে কথাতে। না, নেই। চোরই তো। পরের দ্রব্য হরণ করে যে সেই চোর। বলছে দণ্ডবিধিতেও। ইতরজনায় করলে সেটা চুরিই থাকে। ৩৭৯ ধারায় ধরবে তাকে পুলিশে। ভদ্রজনে সরকারি পদে বসে করলে সেটা হয় দুর্নীতি। ধরার কথা দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদকের। কিন্তু, একটার পর একটা তার চোর পালিয়েই যাচ্ছে, একা নয়, একেবারে দারাপরিবার নিয়ে, পালিয়ে যাচ্ছে বমাল, কখনো-বা চোরাই মাল হস্তান্তর করে দিয়ে। বুদ্ধি কিন্তু বাড়ছে না তার এক রত্তি। চলছে সেই গদাইলস্করীর চালে।

গদাইলস্করী চলত আসলে নদীপথে। মাল বোঝাই নৌকা রাতদিন বেয়ে নিয়ে যেতে হবে দূর বন্দরে, সে লম্বা কয়েক দিনের মামলা। তাড়াহুড়া করার উপায় নেই, ধীরেসুস্থে তাল মিলিয়ে চলতে হবে নদীর সঙ্গে। সেসব নদনদীর অনেকগুলো মরেছে শুকিয়ে প্রতিবেশীর বেশি বেশি পানি টানাতে। দখল আর দূষণ বাঁচিয়ে যে-ক’টা টিকে আছে তা আর মালামাল পরিবহনের পথ হিসেবে নয়, এদেশে এখন টিকে আছে ব্রিজ, সেতু বানাবার খাত হিসেবে। মালামাল পরিবহন হয় এখন ব্রিজের ওপর দিয়ে, সেতুর ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে (যদি যানজট না বাধে) ট্রাক-লরিতে করে সড়ক পথে। নদীপথে যা দু-একখানা চলে, তাও চলে শ্যালো নৌকায় ভটভটিয়ে। গদাইলস্করী এখন জলপথে পাওয়া ভার। টিকে আছে শুধু কথাতে, কারো কারো চলার গতিতে।   

ভদ্রজনার ইতরপনার কাহিনী বেরুচ্ছে সব একের পর এক, বেরুচ্ছে তাদের বেশুমার সব সম্পদ। দেখে চক্ষু ছানাবড়া সবার, হয়ত-বা দুদকেরও। হাজির হতে ডাকছে নোটিশ দিয়ে। দিচ্ছে না কেউ সাড়া তাতে। প্রশ্ন উঠছে দুদক আগে কেন জানতে পারেনি, ব্যবস্থা কেন নেয়নি আগেই। উত্তর খুবই সোজা। জানতে চেষ্টা করেনি তাই জানতে পারেনি, আর জানতে পারেনি তাই ব্যবস্থা নিতে পারেনি। 

এখনো তাকিয়ে থাকে, কে কবে একখানা অভিযোগ দেবে, কিংম্বা মিডিয়ায় কবে কখন একখানা কাণ্ড বের হবে, সেই অপেক্ষায়। পায় যদি তো বাছবে ধীরেসুস্থে, বাছার পরে যদি ধরে একটা, তো নামবে অনুসন্ধানে। বিধিতেই বলা আছে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক সত্যতা যাচাই। কাজটা হওয়ার কথা ঝটপট এবং যথাসম্ভব গোপনে। কিন্তু, এরা প্রকাশ্যে ডাকবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে আগে। আসতে পারবে না তো সময় নাও, চলতে থাকবে কত কাল তা কেউ বলতে পারবে না।

গোপনে খবর নেবার ব্যবস্থা পাকা করেনি দুদক। আইনে কি সুযোগ নেই তার? সুযোগ আছে বিস্তর, সোর্স মানিও দেওয়া হয় অল্পবিস্তর। ২০১৯-এর মে মাসের শেষে যখন চলে আসি অবসরে, তখন বলে এসেছিলাম লিখিত দিয়ে, নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে বড়ো বড়ো দুর্নীতির খবর গোপনে সংগ্রহের ব্যবস্থা করে নিজ উদ্যোগে এসব দুর্নীতিবাজদের ধরতে। কাঙালের সে-কথা কানে তোলেনি। এখনো তাকিয়ে থাকে, কে কবে একখানা অভিযোগ দেবে, কিংম্বা মিডিয়ায় কবে কখন একখানা কাণ্ড বের হবে, সেই অপেক্ষায়। পায় যদি তো বাছবে ধীরেসুস্থে, বাছার পরে যদি ধরে একটা, তো নামবে অনুসন্ধানে। বিধিতেই বলা আছে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক সত্যতা যাচাই। কাজটা হওয়ার কথা ঝটপট এবং যথাসম্ভব গোপনে। কিন্তু, এরা প্রকাশ্যে ডাকবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে আগে। আসতে পারবে না তো সময় নাও, চলতে থাকবে কত কাল তা কেউ বলতে পারবে না। আর সেই নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে যদি হাইকোর্টে ছোটে তবে তো কথায় নেই, সেখান থেকে ছুটবে সেটা কবে তা কেউ জানে না। অনুসন্ধান হাতে নিয়েই অভিযুক্তকে নোটিশ দিয়ে ডাকার কথা নেই বিধিতে। আইন বিধির বাইরে এটা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন।

বরং, অনুসন্ধান-তদন্ত আসামি/অভিযুক্তের অজান্তেই চালাতে হবে বলে হাইকোর্ট বিভাগের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত : All the inquiries/investigations will be conducted behind the back of the accused person, and the trial of a criminal case shall be commenced and then continued in presence of the accused. Before commencing trial, all the steps taken by the investigating officers and the Magistrates are the part of inquiries/ investigations, which require to be carried out without notifying the accused. [Dr. Akhtaruzzaman vs State, 70 DLR 531]

দুদক বিধিমালাটা প্রণীত হয় বহুল আলোচিত-সমালোচিত এক-এগারোর সময় ২০০৭ সালে। তাতে অনুসন্ধানের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল প্রথমবারে ১৫ কর্মদিবস, তার মধ্যে না পারলে আরো ১৫ কর্মদিবস, সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবস। বিধিমালার যে সংশোধন হয় ২০১৯ সালে, তার কাজ যখন শুরু করি ২০১৭ সালের দিকে, তখন অনুসন্ধানের এই সময়সীমা বাড়াবার জন্য চেপে ধরেন দুদক কর্মকর্তারা। একই কর্মকর্তার হাতে একই সময়ে একাধিক অনুসন্ধান-তদন্তকাজ থাকার বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে সে সময়সীমাটা বাড়িয়ে করে এসেছিলাম প্রথমবারে ৪৫ তারপরের বারে ৩০, সর্বোচ্চ ৭৫ কর্মদিবস। কিন্তু, কত পঁচাত্তর কর্মমাস চলে যায়, প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের অনুসন্ধানটুকু তবু শেষ হয় না। এক কর্মকর্তার হাত থেকে আরেক কর্মকর্তার হাতে ঘুরাতে থাকবে একই অনুসন্ধানকাজ। একটু সময় নিয়ে বিস্তারিত তুলে আনা, বিচারে সোপর্দ করার জন্য আইনানুগ সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হলো তদন্তের কাজ। অনুসন্ধান আর তদন্তের ফারাক বোঝে না এরা।

অনুসন্ধানের পর দুদকের কী কাজ হবে তা স্পষ্ট ছিল না বিধিতে আগে। অভিযোগ পেলে যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানে নামতে হবে বলে স্পষ্ট বিধান ছিল তাতে। আবার, থানা অভিযোগ পেয়ে এজাহার করে তদন্তের জন্য দুদকে পাঠাতে পারবে আর সিনিয়র স্পেশাল জজ অভিযোগ পেলে তা নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকে পাঠাতে পারবে বলে বিধান ছিল। থানা ও আদালত হয়ে অভিযোগ এলে দুদককে যদি সরাসরি তদন্তেই নামতে হয় তাহলে দুদক নিজে অভিযোগ পেলে কেন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের দীর্ঘসূত্রতা বাদ দিয়ে সরাসরি তদন্তে নামতে পারবে না, ভেবে পাইনি। দুদকের সরাসরি মামলা করার ও তদন্তে নামার স্পষ্ট বিধান ছিল না বিধিতে।

সব ক্ষেত্রেই সম্পদ বিবরণী চাওয়ার প্রয়োজন আর থাকল না। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদ কেউ অর্জন করছে বলে যে-কোনোভাবে বিশ্বাস করার কারণ থাকলেই দুদক সরাসরি মামলাই করতে পারবে, শুরু করতে পারবে তদন্ত।

মহীউদ্দিন খান আলমগীরের মামলায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারির বৈধতার প্রশ্নে হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত আপিলে হেরে দুদকের আইনজীবীরা অবৈধ সম্পদের অন্য সব মামলায় যুক্তি তোলেন যে, অবৈধ সম্পদের মামলা করার আগে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারিরই প্রয়োজন নেই আইনে। মহীউদ্দিন খান আলমগীরের মামলায় এ-যুক্তিটি তখন পর্যন্ত ছিল না, রিভিউতে গিয়ে অন্যান্য যুক্তির সঙ্গে এটাও তোলা হয়। রিভিউ নিষ্পত্তির আগেই হাইকোর্ট বিভাগ এ-যুক্তি গ্রহণ করে অবৈধ সম্পদের মামলাগুলোতে দুদকের পক্ষে রায় দিতে থাকেন ২০১১-২০১২ সালের দিক থেকেই এবং আপিল বিভাগেও সেগুলো বহাল হতে থাকে [দেখুন, ৬৬ ডিএলআর (এডি) ১৮৫, ৭০ ডিএলআর (এডি) ১০৯]। অবশেষে, মহীউদ্দিন খান আলমগীরের রিভিউতেও আপিল বিভাগ এই যুক্তি গ্রহণ করেন [দেখুন, ৬৮ ডিএলআর (এডি) ১১৮]। সব ক্ষেত্রেই সম্পদ বিবরণী চাওয়ার প্রয়োজন আর থাকল না। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদ কেউ অর্জন করছে বলে যে-কোনোভাবে বিশ্বাস করার কারণ থাকলেই দুদক সরাসরি মামলাই করতে পারবে, শুরু করতে পারবে তদন্ত।  

কিন্তু, সরাসরি মামলা করার সুষ্পষ্ট বিধান দেওয়া ছিল না দুদক বিধিমালাতে। বিধিমালার যে সংশোধন হয় ২০১৯ সালে, তার কাজ যখন শুরু করি ২০১৭ সালের দিকে, তখন সরাসরি মামলা করার সুস্পষ্ট বিধান যুক্ত করে দেই, যেটা এখন জ্বলজ্বল করছে ১০(১)(চ) বিধিতে। সুপ্রিম কোর্টের সেই সিদ্ধান্তের ও ১০(১)(চ) বিধির সুযোগ আজও পর্যন্ত কাজে লাগায়নি দুদক, চলছে সেই গদাইলশকরি চালে। এখন যে-সব নজীর-বেনজীর ছাগলকাণ্ড বের হয়েই চলেছে তার পেছনে দুদক ছুটছে গতানুগতিক অনুসন্ধানের নোটিশ হাতে নিয়ে। কে কোথায় কী ধরনের কত অবৈধ সম্পদ করেছে তার মোটামোটি বিস্তারিত খবরই বেরিয়েছে জাতীয় দৈনিকগুলোতে। সেগুলোর প্রাথমিক সত্যতা দ্রুত যাচাই করে নিয়ে সরাসরি মামলা করতে ও তদন্ত শুরু করতে পারত দুদক, এগিয়ে থাকত একধাপ তাহলে।  

এখন যে অনুসন্ধান করছে তাতে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিয়ে ছেড়ে না দিলে মামলা করে শুরু করবে তদন্ত। আসামিকে আবার ডাকবে আগে। আইনে তদন্তের নির্ধারিত সময়সীমা প্রথমবারে ১২০ কর্মদিবস, তার মধ্যে না পারলে আরো ৬০ কর্মদিবস, সর্বোচ্চ ১৮০ কর্মদিবস। এর মধ্যে না পারলে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা। দিবস গড়িয়ে, মাস গড়িয়ে কত কর্মবছর চলে যায়, তদন্ত আর শেষ হয় না। এক কর্মকর্তার হাত থেকে আরেক কর্মকর্তার হাতে ঘুরাতে থাকবে একই তদন্তকাজ। নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্তের দায়ে বিভাগীয় সাজার কথা শোনা যায় না। 

আইনে তদন্তের নির্ধারিত সময়সীমা প্রথমবারে ১২০ কর্মদিবস, তার মধ্যে না পারলে আরো ৬০ কর্মদিবস, সর্বোচ্চ ১৮০ কর্মদিবস। এর মধ্যে না পারলে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা। দিবস গড়িয়ে, মাস গড়িয়ে কত কর্মবছর চলে যায়, তদন্ত আর শেষ হয় না। এক কর্মকর্তার হাত থেকে আরেক কর্মকর্তার হাতে ঘুরাতে থাকবে একই তদন্তকাজ। নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্তের দায়ে বিভাগীয় সাজার কথা শোনা যায় না।

এখনকার নজীর-বেনজীর ছাগলকাণ্ডের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের তো কোনো চেষ্টাই করেনি দুদক, পালিয়ে গেছে তারা দেশের বাইরে। মামলা না থাকলেও আপাত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও যৌক্তিক সন্দেহ থাকলেই দুর্নীতিবাজকে দুদক গ্রেপ্তার করতে পারে, পরিষ্কার কথা আপিল বিভাগের: We hold that an officer of the Durnity Daman Commission or a police officer deputed by the Commission to investigate or inquire into a case in respect of any of the offences mentioned in the schedule to the Ain of 2004, if he has a reasonable ground to believe that any person has been concerned with any of the offences or against whom a reasonable complaint or an FIR has been made or credible information has been received or a reasonable suspicion exist of his having been so concerned may arrest the offender with prior approval of the Commission. He may also arrest an offender without prior permission in case of emergency as mentioned above. [ACC vs Abdullah-al-Mamun, 21 BLC (AD) 162, para 29]  

এতসব আইনি শক্তি আর ক্ষমতা যে তার আছে সে-ব্যাপারে চেতনা হারিয়েছে কি দুদক? এ-সম্বন্ধে সজাগ হবে কবে? গদাইলস্করী ছেড়ে অটোমোবাইলের গতি নেবে কবে?   

লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: moyeedislam@yahoo.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত