Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সিরিয়ার ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বী কারা

Syria Forces
[publishpress_authors_box]

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাত করেছে দেশটির বিদ্রোহীরা। দেশ ছেড়ে রাশিয়ার নিরাপদ আশ্রয়ে গেছেন আসাদ। আর এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসনের সমাপ্তি হলো।

গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপগুলো আসাদ সরকারকে উৎখাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। এজন্য আদর্শ, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকারী ভিন্ন হলেও বিদ্রোহীরা একাট্টা হয়েছিল।

শেষমেষ মাত্র ১১ দিনের লড়াইয়ে পতন হলো বাশার আল আসাদের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোহামেদ আল বাশিরের নাম ঘোষণা হয়েছে। তাতেও প্রশ্ন থাকছে, সিরিয়ার শেষমেষ ক্ষমতায় কে বসবে?

হায়াত তাহরির আল-শাম

হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস)। এটি ছিল সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার একটি পুরোনো সহযোগী গোষ্ঠী। কয়েক বছর আগে আল-কায়েদা থেকে ওই গোষ্ঠী পৃথক হয়ে সিরিয়ার বিরোধী শক্তির শেষ ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

এই গোষ্ঠীই ছিল সর্বশেষ আক্রমণের নেতৃত্বদানকারী প্রধান বিদ্রোহী দল। তারা নভেম্বরের শেষে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার নিজেদের ঘাঁটি থেকে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে আসাদ সরকারের পতন ঘটায়।

গোষ্ঠীর সদস্যদের ইসলামিক স্টেট ও পরে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ২০১৬ সালে তারা তাদের মৌলবাদী শিকড় ত্যাগ করার চেষ্টা করে এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে হায়াত তাহরির আল শাম প্রতিষ্ঠা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি এখনও এইচটিএসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে।

এইচটিএসের নেতা হলেন আবু মোহাম্মদ আল জুলানি। এটি তার ছদ্মনাম। তার আসল নাম আহমেদ আল শারা। তিনি সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল ‘এই নিষ্ঠুর শাসন থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা’। তিনি ইদলিব প্রদেশের বাসিন্দাদের সেবা দিয়ে নিজেদের বৈধতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন।

কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ অনুসারে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হওয়া এবং তার শিকড়ের কারণে এইচটিএসকে অর্থ সংগ্রহে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। গোষ্ঠীটি সীমান্ত শুল্ক, বাসিন্দাদের উপর কর আরোপ এবং জনসেবা সংস্থাগুলোর উপর একচেটিয়া অধিকার গ্রহণ করে অর্থ সংগ্রহ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি সিন্থেটিক উত্তেজক ক্যাপটাগন মাদক পাচারেও জড়িত।

সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস

সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হলো জাতিগত কুর্দি সংখ্যালঘু। তারা সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্থানীয় অংশীদার হয়ে ওঠে সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের পতাকায়।

২০১৯ সালে ইসলামিক স্টেটের বৃহত্তর পরাজয়ের পর কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেখানে তারা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলে। তবে কুর্দি যোদ্ধাদের এখনও দীর্ঘদিনের শত্রু তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। তুরস্ক কুর্দিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে মনে করে।

বিদ্রোহীরা যতই দামেস্কে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক, তুরস্ক ও কুর্দিদের মধ্যে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে তুরস্ক সীমান্তের কাছে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত মানজিব শহরে যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। সম্প্রতি তুরস্কের সঙ্গে লড়াইয়ে মানজিব ও এর আশপাশে কমপক্ষে ২২ জন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের সদস্য নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছেন।

দ্য সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি

এই দলটির অধীনে আছে বিভিন্ন বিশ্বাসে বিশ্বাসী একাধিক গোষ্ঠী। এরা তুরস্ক থেকে অর্থ ও অস্ত্র পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় একটি নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের টার্গেট হলো কুর্দিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কারণ তারা কুর্দিদের হুমকি মনে করে।

তুরস্ক এমন একটি এলাকা তৈরি করতে চায় যেখানে সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ৩০ লাখ শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা যায়। এই শরণার্থীরা বর্তমানে তুরস্কের সীমান্তের ভেতরে বাস করছে। তবে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিভিন্ন অগোছালো গোষ্ঠীকে একত্রিত করতে তুরস্ককে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এই গোষ্ঠীটি প্রধানত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অবশিষ্ট অংশ দিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে অনেক যোদ্ধা রয়েছেন, যাদের যুক্তরাষ্ট্র অপরাধী ও দুর্বৃত্ত হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিছু যোদ্ধা যুদ্ধের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। তবে অধিকাংশকেই খুব বেশি চরমপন্থী বা অপরাধী হিসেবে বাতিল করা হয়েছিল। অধিকাংশের কোনও নির্দিষ্ট আদর্শ নেই। গোষ্ঠীটি গঠিত হওয়ার সময় এর সদস্যরা তুরস্ক থেকে মাসে প্রায় ১০০ ডলার করে পেত।

সোমবার উত্তর সিরিয়ার মানজিব শহরে তুর্কি বিমান হামলা এবং গোলাবর্ষণের সমর্থনে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ও কুর্দি সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়।

ব্রিটেনভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ গোষ্ঠী সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস অনুযায়ী, মানজিব শহরের দখল নিয়েছে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের এক মুখপাত্র জানান যে, সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির যোদ্ধারা শহরের মাত্র ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই দাবিগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

দ্য দ্রুজ মিলিশিয়া

সিরিয়ার দ্রুজ সংখ্যালঘু জনগণ দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুইদা এলাকায় বাস করে। ওই এলাকায় জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। অনেক দ্রুজ পুরুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করে। এই সপ্তাহে দ্রুজ যোদ্ধারা আসাদ সরকারের পতনের জন্য লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল। সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক অভিযানে আসাদ বাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয় দ্রুজ বাহিনীর।

দ্রুজ যোদ্ধারা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের একটি নতুন গোষ্ঠীর অংশ। অংশটি ‘সাউদার্ন অপারেশনস রুম’ নামে পরিচিত।

দ্রুজ মূলত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী। এটি ১১শ শতকে ইসলাম ধর্মের একটি উপধারা হিসেবে বিকশিত হয়। এর মধ্যে খ্রিস্টান, হিন্দু, গনোসিসসহ অন্যান্য দার্শনিক মতবাদও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ইসরায়েলে দশ লাখেরও বেশি দ্রুজ বাস করেন।

দ্য ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া

ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া মূলত আইএসআইএস নামে পরিচিত। এটি ২০১৪ সালে সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকা দখল করে নিষ্ঠুর শাসনের জন্য সমালোচিত। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত জোটের হাতে তারা পরাজিত হয়। বর্তমানে তাদের সদস্যরা মূলত গোপনে রয়েছে।

সম্প্রতি সিরিয়ায় আইএসআইএসের পুনরুত্থানের লক্ষণ দেখা গেছে। মূলত এটি ঘটেছে ওই অঞ্চলের ব্যাপক অস্থিতিশীলতার কারণে। পেন্টাগন গত জুলাইয়ে সতর্কতা জানায় যে, সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেটের আক্রমণ গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হতে পারে। গ্রুপটি বারবার তার সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কিছু অংশে ছায়া সরকার পরিচালনা করছে।

গত রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানান, ইসলামিক স্টেটকে পুনরায় শক্তি অর্জন করতে না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। আসাদ সরকারের পতনের পর সৃষ্টি হওয়া ক্ষমতার শূন্যতার মধ্যেও এই হামলা চলছে।

সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯০০ সেনা অবস্থান করছে। সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সেনা প্রত্যাহার করবে কি না, এবিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, “আমরা স্পষ্টভাবে জানি যে, আইএসআইএস যে কোনো শূন্যতার সুযোগ নেবে তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করতে। আমরা এটা হতে দেব না।”

তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত