Beta
মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

কে এই বুশনেল, কেন তার আত্মাহুতি

ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে গায়ে আগুন দেন অ্যারন বুশনেল।
ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে গায়ে আগুন দেন অ্যারন বুশনেল।
[publishpress_authors_box]

ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলি দূতাবাসে রবিবার দুপুরে হাজির হন এক তরুণ। নাম অ্যারন বুশনেল। বয়স ২৫। কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে। দূতাবাস ফটকের সামনে পৌঁছেই তিনি তার মোবাইল ফোনটি মাটিতে রেখে লাইভ শুরু করেন। এরপর নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, “ফিলিস্তিনকে মুক্ত কর!”

লাইভটি যতক্ষণে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল, ততক্ষণে বুশনেল আর নেই। রাতেই হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুতে উত্তাল সোশাল মিডিয়া।

দেশে দেশে বুশনেলকে নিয়ে আলোচনা চলছে। কেউ ব্যথিত, কেউবা ক্ষুব্ধ। গাজায় পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের গণহত্যায় এই প্রথম কোনও আমেরিকান নাগরিক শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার মতো প্রতিক্রিয়া দেখালেন।

বুশনেলের কর্মজীবন

২০২০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন বুশনেল। সেখানে তাকে ক্লায়েন্ট সিস্টেমস টেকনিশিয়ান হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে পড়াশোনা ছিল তার। পরে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সান এন্টোনিও শহরে বিমানবাহিনীর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

কাজের পাশাপাশি তিনি সাউদার্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও স্নাতক করছিলেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে বেশিদিন কাজ করার ইচ্ছে তার ছিল না, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল তার আগ্রহের জায়গা। কর্মক্ষেত্র নিয়ে এই পরিকল্পনা নিজের লিঙ্কডইন পেজে লিখেছিলেন তিনি।

বুশনেলকে ‘সবচেয়ে দয়ালু, বিনয়ী ও বোকা ছোট্ট বাচ্চা’ হিসেবে অভিহিত করে তার এক বন্ধু বলেছেন, “মুখে হাসি নিয়ে সবসময় সবার মুক্তির চেষ্টা করত সে।” 

ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলি দূতাবাস। ছবি: রয়টার্স

দূতাবাসের সামনে আত্মাহুতি

ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে দেহে আগুন জ্বালানোর কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ফেইসবুক পাতায় টুইচের (ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং সেবা) একটি লিংক পোস্ট করেন বুশনেল। যার শিরোনাম ছিল এমন-

“আমার মতো আরও অনেকে নিজেকে প্রশ্ন করে, “দাসপ্রথার সময় জীবিত থাকলে কী করতে? বা দক্ষিণে জিম ক্রো আইনের সময় যখন জাতিতে জাতিতে বিভাজন তৈরি করা হয়েছিল তখন? বা জাতিবিদ্বেষের সময়? আমার দেশ যখন গণহত্যা করছে, তখনই বা কী করা উচিৎ? এসবের প্রশ্নের উত্তর হলো, যা করতে চাও, এখনই করো।”     

ফেইসবুকে এই পোস্ট দেওয়ার পর দাহ্য তরল পদার্থভরতি পানির বোতল নিয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসে পৌঁছান বুশনেল। শুরু করেন লাইভ। বলতে থাকেন, “গণহত্যায় আমি আর নিজেকে জড়াতে চাই না। তীব্র প্রতিবাদ করে যেতে চাই। অবশ্য ফিলিস্তিনের মানুষ প্রতিদিন তাদের উপনিবেশকারীদের হাতে যে অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে, সে তুলনায় আমার প্রতিবাদকে তীব্র বলা যায় না। আমাদের শাসকগোষ্ঠীর নেওয়া সিদ্ধান্ত একসময় স্বাভাবিক হয়ে যায়।”    

এই বলেই বুশনেল ফোন মাটিতে রাখেন এবং দূতাবাসের ফটকের দিকে হাঁটতে থাকেন। ফটকের সামনে পৌঁছেই তিনি বোতল থেকে দাহ্য তরল নিজের গায়ে ঢালতে থাকেন। গায়ে আগুন ধরাতে ধরাতে বলে ওঠেন, “ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো!”         

অ্যারন বুশনেলের আত্মাহুতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনেকেই ফেইসবুকে এই ফটোকার্ড তাদের প্রোফাইল পিকচার করছেন।

সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য বুশনেলের দিকে এগিয়ে যান। তাকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?” ঠিক তখন বুশনেলের শরীর আগুনে জ্বলে ওঠে। আগের চেয়ে আরও জোরে চিৎকার করে বলতে থাকেন, “ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো!”    

মুহূর্তের মধ্যে বুশনেলের পুরো শরীরে আগুনে ঢেকে যায়। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য (মোবাইল ফোনের ক্যামেরার বাইরে ছিলেন তিনি) চিৎকার করে বুশনেলকে মাটিতে বসে পড়তে বলেন। সে সময় আরেক সদস্যকে বলতে শোনা যায়, “আমার বন্দুকের প্রয়োজন নেই। আগুন নেভানোর যন্ত্র দরকার।”

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হয় ওয়াশিংটন ডিসির দমকল বাহিনী ও জরুরি চিকিৎসা সেবা (ইএমএস)। বুশনেলের দেহে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন তারা নেভান।

ইসরায়েলি দূতাবাসের কাছে দাঁড়ানো দমকল বাহিনী। ছবি: এএফপি

মৃত্যুপরবর্তী ঘটনা  

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বুশনেলের মৃত্যু সম্পর্কে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, “ইসরায়েলি দূতাবাসের বাইরে মানসিক কষ্টে ভোগা এক ব্যক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে কিছু করে ওঠার আগেই তিনি নাম না জানা তরল দিয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

“দমকল বাহিনী পৌঁছার আগেই ওই কর্মকর্তারা তার গায়ের আগুন নেভাতে সক্ষম হন। বুশনেলকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টা ৬ মিনিটে তিনি মারা যান।”                                

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে বেশ কয়েকটি বামপন্থি ওয়েবসাইটে মেইল পাঠিয়েছিলেন বুশনেল।

মেইলে তিনি লেখেন, “ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার পরিকল্পনা নিয়েছি।”

ওই মেইল পরে বিবিসিকে পাঠানো হয়। 

শর্ত ভাঙার অভিযোগে বুশনেলের ভিডিও সরিয়ে নেয় টুইচ। যদিও ভিডিওটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে বুশনেলের জ্বলন্ত শরীর ঝাপসা করে দেওয়া হয়।     

ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ দপ্তরের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও মদ, তামাক, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যুরো বুশনেলের আত্মাহুতির ঘটনা তদন্ত করছে।            

গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে বুশনেলই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি নিজের গায়ে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।

যুদ্ধ শুরুর পর ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে ইসরায়েলি কনস্যুলেটের সামনে এক নারী পেট্রোল দিয়ে তার গোটা শরীর জ্বালিয়ে দেন।

ওই নারী প্রাণে বাঁচলেও তার ত্বকের তৃতীয় স্তর পর্যন্ত পুড়ে যায়। আটলান্টা পুলিশ প্রতিবাদকারীর পরিচয় প্রকাশ করেনি।

কনস্যুলেটের ৬১ বছর বয়সী এক নিরাপত্তারক্ষী ওই নারীকে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তার শরীরেরও অনেকাংশ গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়। 

গায়ে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তিউনিসিয়ায় ‘আরব বসন্তের’ সময় এভাবে প্রতিবাদ বিশেষ গুরুত্ব পায়।                               

প্রতিবাদের এ ধরন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর নাটকীয় হলেও বিরল।    

তথ্যসূত্র: টাইম, ইন্টেলিজেন্সার, নিউজউইক

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত