Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

ফ্রান্সের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী কে এই জর্দান বারদেলা

ফ্রান্সের সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্ডান বারদেলা।
ফ্রান্সের সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্ডান বারদেলা।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‌্যালির (আরএন) প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ২৮ বছর বয়সী জর্দান বারদেলার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। যে কেউ তার সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইলেও মানা করেন না। টিকটকে তার যে ১৩ লাখ অনুসারী আছে তাদের সঙ্গেও তিনি অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করেন। ফলে পেয়েছেন বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের তকমাও।

মারিন লো পেনের ন্যাশনাল র‌্যালি পার্টি গত রবিবার ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় দুর্দান্ত জয় পেয়েছে। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোট তৃতীয় হয়েছে। প্রথম দফা নির্বাচনের প্রাথমিক ফল অনুযায়ী, লো পেনের আরএন ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বামপন্থী নিউ পপুলার ফ্রন্ট জোট ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোট পেয়েছে ২০ শতাংশ ভোট।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ফ্রান্সে ডানপন্থীদের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। তবে এজন্য তাদেরকে দ্বিতীয় দফায়ও জয় পেতে হবে।

আগামী ৭ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের পর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আরএন সরকার গঠন করতে পারবে এবং জর্দান বারদেলাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করতে পারবে।

তবে, যদি কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট দেখতে হবে ফরাসিদের।

জর্দান বারদেলা ‘ফ্রান্স এবং এর মহত্ত্বে বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত সপ্তাহের সোমবার প্রকাশিত ইশতেহারে তিনি তার পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন।

ইশতেহারের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো হলো বেআইনি অভিবাসন রোধ, জ্বালানি কর কমিয়ে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্কুলগুলোর ওপর সরকারের কর্তৃত্ব বাড়ানো।

তিনি ভোটারদের এ বলেও আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে, তার দল ইউক্রেনকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখবে, যদিও দলটিকে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয়। তবে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র সরবরাহের বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে।

ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বের প্রতি সাত বছরের অসন্তোষের ‘একমাত্র বিকল্প’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা বারদেলা ফ্রান্সকে শাসন করার এই সুযোগটির সবচেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন।

তিনি তার সমর্থকদের বলেছেন, “তিনটি শব্দ: আমরা প্রস্তুত আছি।”

উল্কার গতিতে উত্থান

প্যারিসের একটি শহরতলী এলাকা সেইন-সেন্ট-ডেনিসে বড় হওয়ায় বারদেলার দাবি, অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ফ্রান্সে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে সেই অভিজ্ঞতা তিনি পেয়েছেন।

কট্টর ডানপন্থীরা প্যারিসের আশপাশের শহরতলীগুলোতে শ্রমজীবী শ্রেণির যে আবাসিক এলাকাগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করে, সেখানে প্রধানত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিকদের বসবাস।

২০২২ সালের এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, “আমি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের এই হারানো অঞ্চলগুলোকে ইসলামপন্থীদের আধিপত্য দেখেছি।

“আমিও আপনাদের মতো এবং লাখ লাখ ফরাসি নাগরিকের মতো, নিজের দেশে বিদেশি হওয়ার বেদনা অনুভব করেছি।”

ইতালীয় বংশোদ্ভূত পিতামাতার সন্তান বারদেলা একটি আধা-বেসরকারি ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা করেন। ফরাসি দৈনিক লা মদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার স্কুল সম্পর্কে বলেন, “সেন্ট-ডেনিসের একমাত্র বিদ্যালয় যেখানে কোনও শিক্ষক তাদের মাথায় চেয়ার ছুড়ে মারার ঝুঁকিতে ছিলেন না।”

তার বাবা অলিভিয়ার, যার মা ছিলেন আলজেরিয়ান। অলিভিয়ার একটি পানীয়র ব্যবসা করতেন। বারদেলা যখন শৈশবে, তখনই তার বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান।

তার জীবন নিয়ে সাংবাদিক পিয়েরে-স্টিফেন ফোর্টের একটি বই আছে। ওই বই অনুযায়ী, বারদেলা ২০১২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আরএন-এ যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি ভূগোলে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্স করছিলেন। তবে রাজনীতিতে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সে পড়া ছেড়ে দেন। ২০১৪ সালে তিনি দলের সেইন-সেন্ট-ডেনিস প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।

বারদেলা প্রথমে আলোচনায় আসেন তার দলের কমরেড এবং প্রাক্তন বন্ধুস্থানীয় কাউন্সিলর ম্যাক্সেন্স বাট্টিকে বরখাস্ত করে। বাট্টি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ঘোষণা দেওয়ায় বারদেলা তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত করেন।

বারদেলা পরবর্তী সময়ে ফ্রেডেরিক চ্যাটিলনের মেয়ে কেরিডওয়েন চ্যাটিলনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। ফ্রেডেরিক চ্যাটিলন দলের প্রধান লো পেনের বন্ধু এবং আস্থাভাজন ব্যক্তি। তিনিই বারদেলাকে দলের নেতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

বারদেলাও অল্পদিনের মধ্যে লো পেনের মন জয় করে নেন এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে দলের মুখপাত্র নিযুক্ত হন।

২০১৯ সালে লো পেন তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দেন। ওই নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন নীতির সমালোচক হিসেবে পরিচিত আরএন ব্রাসেলসে ইইউ পার্লামেন্টে একটি আসন পায়।

২০২২ সালে বারদেলার উল্কার গতিতে উত্থান ঘটতে থাকে। লো পেন ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভে মনোযোগ দিয়ে কাজ শুরু করার জন্য দলের দায়িত্ব বারদেলার হাতে ছেড়ে দেন। এর ফলে বারদেলা আরএন সভাপতির দায়িত্ব পান।

দলের সভাপতি হওয়ার পর বারদেলা ঘোষণা করেন, “আমরা দেশ শাসনের দায়িত্ব পেলে মানব পাচারকারী মাফিয়াদের পরিচালিত অভিবাসী জাহাজগুলোকে ফরাসি বন্দরে ভেড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। আমরা আমাদের দেশকে বিশ্বের হোটেল হতে দেব না।”

বিনয়ী আচরণ, কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি

সামাজিক-মিডিয়া-সচেতন বারদেলা তখন থেকেই দলটির নতুন ব্র্যান্ডের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি দলের পূর্বসূরি জাতীয় ফ্রন্টের বর্ণবাদী গাফিলতি এবং ইহুদিবিরোধী সুর থেকে দূরে সরে গিয়ে মধ্যপন্থী ভোটারদের কাছে আরও নমনীয় চেহারা উপস্থাপন করেন।

বারদেলা তার ক্লিন-শেভ করা চেহারা এবং নম্র আচরণ দিয়েও ফরাসি ভোটারদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।

তিনি তার ইশতেহার তৈরির সময় বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বাসযোগ্য, দায়িত্বশীল এবং ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মান করি।”

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার মধ্য দিয়ে তিনি ব্যাপক সমর্থন অর্জন করেন। বিশেষ করে এমন ভোটারদের মধ্যে যারা ঐতিহ্যগতভাবে ৫৫ বছর বয়সী লো পেন এবং তার বাবা জিন লুই মেরির প্রতি অসহানুভূতিশীল, যিনি ১৯৭০ এর দশকে দলটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

লো পেন সিনিয়র নাৎসি গ্যাস চেম্বারকে ‘ইতিহাসের বিশদ বিবরণ’ বলার জন্য ঘৃণাত্মক বক্তব্যের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি আরও বেশ কয়েকটি আক্রমণাত্মক বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন।

চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো সেবাস্তিয়ান মেলার্ড আল জাজিরাকে বলেন, “বারদেলাকে দায়িত্ব দেওয়া দলটির স্বাভাবিকীকরণ কৌশলের অংশ। তার নাম লো পেন নয়, তিনি কখনোই কোনও বিতর্কে পড়েননি এবং তিনি যা বলছেন সে সম্পর্কে খুব সতর্ক ছিলেন।”

তবে দলটির কট্টর ডানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি অক্ষত রয়েছে।

বারদেলা বলেন, “এখন সময় এসেছে অভিবাসনের বিষয়টিকে সামাজিক ক্লিশে থেকে মুক্ত করার। বামপন্থীরা চায় সীমান্ত উঠিয়ে দিতে, যা আমাদের দেশকে নিরাপত্তাহীন করে তুলবে। এতে আমাদের সামাজিক পরিষেবাগুলোর অবনমন ঘটবে এবং আমাদের ফরাসি পরিচয়কে মন্দার দিকে নিয়ে যাবে।”

অপরাধ করেছে এমন বিদেশিদের ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা করছে বারদেলার দল আরএন। এ ছাড়া ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী বিদেশিদের ফরাসি নাগরিকত্ব বাতিল, নাগরিকদের জন্য সামাজিক ব্যয় সীমিত করে কল্যাণ বাজেট কমানো এবং দ্বৈত নাগরিকদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার মতো ‘সংবেদনশীল’ খাতে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনাও করছে।

‘ইসলামী মতাদর্শের বিরুদ্ধে’ও একটি আইন প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি। তবে কী ধরনের আইন করা হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানায়নি।

‘ফরাসিদের জেগে ওঠার ডাক’

বারদেলা ভিনদেশিদের জন্মগতভাবে ফরাসি নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রথাও শেষ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই পদক্ষেপ গণভোটে পাস না হলে সাংবিধানিক পর্যালোচনায়ও পাস করবে না।

তিনি স্কুলগুলোতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব’ পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অসদাচরণের জন্য কঠোর শাস্তি, উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া এবং নতুন তৈরি বিশেষ কেন্দ্রে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া তিনি স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করতে চান। শিক্ষককে সম্বোধনের ক্ষেত্রে তুমির সম্মানজনক রূপ ‘আপনি’ পুনরায় চালুর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

জীবনযাত্রার সংকট মোকাবেলা করার এবং জ্বালানি কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বারদেলা। তবে এজন্য তহবিল কোথায় পাবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি।

বারদেলার দলটি তার কিছু পুরনো, বেশি বিতর্কিত অবস্থান থেকেও সরে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে ফ্রেক্সিট তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ফ্রান্সের বের হয়ে যাওয়া এবং ন্যাটো জোট ত্যাগ করা। তবে তিনি অভিবাসীদের প্রতি ভয় এবং ম্যাক্রোঁর প্রতি ভোটারদের অসন্তোষকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছেন।

চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো সেবাস্তিয়ান মেলার্ড বলেন, এসব বিষয় পার্লামেন্টে উত্থাপনের ইঙ্গিত দিয়ে আরএন নতুন ভোটারদের মন জয় করেছে।

মেলার্ডের মতে, ম্যাক্রোঁর আগাম নির্বাচন দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সরকারের প্রতি অসন্তোষের ওপর ভিত্তি না করে আরএনকে একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে বাধ্য করা।

তিনি বলেন, “ম্যাক্রোঁ চান যে, আরএন প্রমাণ করুক, তারা সত্যিই [শাসন করতে] প্রস্তুত কিনা।

“এবং এটি ফরাসিদের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যও একটি আহ্বান: আপনারা কি সত্যিই তাদের শাসন চান?”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত