ভারতের মুম্বাই ও হায়দরাবাদে আফগান সরকারের কনসাল ছিলেন জাকিয়া ওয়ারদাক ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম খেল। তারা গতকাল বৃহস্পতিবার তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দিল্লিতে আফগান দূতাবাসের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এই ঘটনা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ দিল্লির দূতাবাস চালু নিয়ে দুটি বিপরীতমুখী সরকারি বিবৃতি সামনে এসেছে। একটি দিয়েছেন সাবেক কনসালরা। অন্যটি দিয়েছে তালেবান সরকার।
আরও যে বিষয়টি বেশি নজর কেড়েছে, তা হলো একজন নারী কূটনীতিক হিসেবে জাকিয়া ওয়ারদাকের নিয়োগ। বলা হচ্ছে, তালেবান সরকারই তাকে ভারতে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠিয়েছেন।
তালেবানপন্থী এই নারী কূটনীতিককে এমন সময় নিয়োগ দেওয়া হলো, যখন তালেবান সরকার আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির পর শিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষা ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছে তালেবান। এজন্য লাখ লাখ আফগান নারীকে এখন বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে থাকতে হচ্ছে।
অনেকের মতে, জাকিয়া ওয়ারদাকের তালেবানকে সমর্থন করা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
একই পরিস্থিতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আফগান দূতাবাসে। তখন তালেবান কাবুলে বুরহানউদ্দিন রব্বানির মুজাহিদিন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানের ২৩টি প্রদেশ দখল করেছিল। সেসময় ওয়াশিংটনে অবস্থানরত দুই সিনিয়র আফগান কূটনীতিক আফগান প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ওয়াশিংটনে আফগান দূতাবাসের সাবেক চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ মোহাব্বত। তিনি বুরহানউদ্দিন রব্বানির সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন। এই সরকার তখনও আফগানিস্তানের বৈধ ও জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার ছিল। তবে তার ডেপুটি সিরাজউদ্দিন ওয়ারদাক তালেবান প্রশাসনের হয়ে ওয়াশিংটনে কূটনীতিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ মেটানো সম্ভব হয়নি। এতে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নজরে আসে।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন মুখপাত্র জেমস রুবিন ঘোষণা করেন যে, দুই কূটনীতিক দেশের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ওয়াশিংটনে আফগান দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ করবে।
তালেবান সরকার উৎখাত না হওয়া এবং হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাস বন্ধ ছিল।
আফগান কূটনীতিকদের মধ্যে প্রধান বিরোধ ছিল পতাকা নিয়ে। রব্বানির সরকারের পতাকা দূতাবাসে রাখতে চেয়েছিলেন মোহাব্বত। তবে সিরাজউদ্দিন ওয়ারদাক তালেবানের সাদা পতাকা ওয়াশিংটনে উত্তোলন করতে চেয়েছিলেন।
পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সিরাজউদ্দিন ওয়ারদাককে গ্রেপ্তার করে এবং কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী তাকে অত্যাচার করা হয়। ২০১১ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মুত্যু হয়।
সিরাজউদ্দিন ওয়ারদাক হলেন জাকিয়া ওয়ারদাকের স্বামী। আর জাকিয়া বর্তমানে তালেবানের সঙ্গে কাজ করা প্রথম নারী কূটনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জাকিয়া ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে ফিরে যান। তিনি এমন একটি পরিবারের সদস্য, যার পূর্বপুরুষরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তার বাবা জেনারেল আবদুল আলী খান ওয়ারদাকও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
জাকিয়া পড়ালেখা করেছেন কাবুল পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি আর্কিটেকচারে মাস্টার্স ডিগ্রি করেন। কাবুলে ফেরার পর তিনি স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ শুরু করেন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে সুবিধা নেন।
এছাড়া জাকিয়া নিজে একটি নির্মাণ কোম্পানি খুলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রকল্পগুলোর কাজ করতে থাকেন। আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর পর তিনি রাজনীতিতে নামেন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
তবে নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে না পারলেও আফগানিস্তানের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। তার এক মেয়ে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হানিফ আতমারের সহকর্মী হন। পরবর্তীতে আতমার জাকিয়াকে ভারতের মুম্বাইয়ে আফগান কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে সহায়তা করেন।
এখন আশরাফ ঘানি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হানিফ আতমারের অনেক সহযোগীও তালেবান সরকারের পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তাদের সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করেছেন।
আতমার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) থাকার সময় এনএসএর মুখপাত্র ছিলেন কাদের শাহ।
জাকিয়া ওয়ারদাকের আগে কাদের শাহও ভারতের সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত ফারিদ মামুন্দজয়ের সঙ্গে একই ধরনের বিরোধে জড়িয়েছিলেন। তবে তিনি দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি।
নেদারল্যান্ডসে আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের রাষ্ট্রদূত ছিলেন আসিফ রহিমি। তিনি প্রকাশ্যেই তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি খোলাসা করেন। আতমারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন রাষ্ট্রদূতও তালেবানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
তবে জাকিয়া ওয়ারদাক হচ্ছেন প্রথম নারী, যিনি প্রকাশ্যে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
জাকিয়া ওয়ারদাক শুধু তালেবানের নয়, আফগানিস্তানেরও প্রথম নারী কূটনীতিক। ভারতে কনসাল হিসেবে কাজ করা জাকিয়াকে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ নিয়ে ২০২৪ সালের ৫ মে ভারত ছাড়তে হয়েছিল।
ওই বছরের এপ্রিলে দুবাই থেকে ফেরার সময় মুম্বাই বিমানবন্দরে তাকে থামানো হয়েছিল। কারণ তার সঙ্গে তখন ৫৫ পাউন্ড স্বর্ণ পাওয়া গিয়েছিল, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। তবে কূটনীতিক হওয়ায় তাকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়নি।
যারা রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে, সেই তালেবান কীভাবে জাকিয়া ওয়ারদাককে তাদের প্রতিনিধি করে ভারতে পাঠিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। ভারত সরকারও স্পষ্ট করেনি, কীভাবে তারা তালেবানের প্রতিনিধিদের গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত ফারিদ মামুন্দজয়ের পদত্যাগের পরেই জাকিয়াকে দৃশ্যপটে দেখা যায়। এখন পর্যন্ত তালেবান প্রশাসন আগের সরকারের অনেক কর্মকর্তাকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছে। এদের মধ্যে এমন লোকজনও আছেন, যারা আগে তালেবানের বিরোধিতা করেছিলেন।
মামুন্দজয় তালেবানের কাছে আফগান দূতাবাস হস্তান্তর করতে চাননি। উল্টো তিনি বলেছেন, ভারত ধারাবাহিকভাবে সাবেক সরকারের কূটনীতিকদের তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে উৎসাহিত করেছে।
তিনি বলেছেন, দিল্লি তাদেরই সমর্থন করে যারা তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে এবং ওয়ারদাক তাদের মধ্যে একজন। আগের সরকারের অনেক কূটনীতিক ভারত ছেড়ে গেছে। যারা দেশটিতে রয়েছেন, তারা তালেবানকে সমর্থন করেন এবং তালেবানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামুন্দজয়ের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত করার পেছনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। তবে মনে হচ্ছে দিল্লি আফগানিস্তানে তার বিনিয়োগ রক্ষা এবং দেশটিতে প্রভাব বজায় রাখতে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খুঁজছে।
ভারত গত বছর কাবুলে তার দূতাবাস পুনরায় চালু করেছে মানবিক সাহায্য যেমন খাদ্য ও ওষুধ দেওয়ার জন্য। তবে কনসুলার সেবা, যেমন আফগান নাগরিকদের জন্য ভিসা ইস্যু পুনরায় শুরু হয়নি।
তথ্যসূত্র : সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স, সিবিএস, হিন্দুস্তান টাইমস।