Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

বাজার সিন্ডিকেটের লাগাম পরাবে কে

চিররঞ্জন সরকার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন মুখ এসেছে। বিগত সরকারের সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন করে সব কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে জিনিসপত্রের দামে লাগাম টানতে সরকার এখনও কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বাজার সিন্ডিকেটও এখনও বহাল রয়েছে।

শেখ হাসিনার পতনের পর কয়েকদিন সিন্ডিকেটের প্রভাব না থাকার কারণে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন আবারও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে গেছে। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু বদলালেও বাজারের চিত্র এখনও বদলায়নি। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটে হয়েছে কেবল মুখবদল। নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য এখনও সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ নিয়ে তর্জন-গর্জন কিছু কম হয়নি। কিন্তু কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না, কেন ক্রেতার ভোগান্তি এখনও অব্যাহত আছে, এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

সদুপদেশ দিয়ে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। বাজারমূল্যের উপর নজরদারির জন্য সক্রিয় ও শক্তিশালী ‘টাস্ক ফোর্স’গঠন করতে হবে।

বাজারে চাল, ডিম, আলু, মাছ, মাংস, ব্রয়লার মুরগি, শাক-সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সিন্ডিকেটের কারণে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত দুই মাসে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম দুই টাকা থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হয় চাল কিনতে। আলু, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজের দামও ঊর্ধ্বমুখী। আর শাকসবজির দাম তো মাত্রাছাড়া। তাহলে গরিব মানুষ খাবে কি? এই সময়ে মানুষরে আয় বাড়েনি। অথচ ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। আগে যে টাকা দিয়ে যে পরিমাণ, চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু, সবজি কেনা যেত, এখন তা যাচ্ছে না। অথচ পেটের খিদে অপরিবর্তিতই আছে। এমন অবস্থায় মানুষ যাবে কোথায়? কার কাছে প্রতিকার চাইবে?

আগস্টে সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে সেইসঙ্গে চাঁদাবাজ ও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু বাজারে তার কোনও প্রতিফলন নেই। নেই কোনও মনিটরিং বা অন্য কোনও উদ্যোগ। বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেছনে বাজার সিন্ডিকেটের কথা বলা হতো। ক্ষমতার পালাবদলের পরেও সিন্ডিকেটের কারসাজি বহাল আছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, আগের মতোই পণ্যবাহী ট্রাককে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে সবাই মিলে ইচ্ছেমতো বাড়তি দাম রাখছে।

বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণার পরেও বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। একটি নতুন ধরনের অরাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা এখনও যদি সিন্ডিকেট করে মুনাফা লুটে, তাহলে এই সরকারের কার্যকারিতা কোথায়? এখন তো ব্যবসায়ীদের মদদপুষ্ট দলীয় সরকার ক্ষমতায় নেই! তাহলে এই মুনাফালোভী বাজার সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করে সেই অশুভ সন্ধি ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?

অনিয়ম, মজুতদারি, একচেটিয়া কারবারি এবং বাজারকে অস্থিতিশীল করার মতো নেপথ্য যেসব অপশক্তি সক্রিয় রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে জিনিসপত্রের দামে লাগাম পড়ানো সম্ভব হবে না। কাজটা মোটেও সহজ নয়। এ জন্য দৃঢ়তা চাই। একইসঙ্গে প্রয়োজন গভীর অনুসন্ধান। শুধু কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করলেই দায়িত্ব শেষ হবে না। প্রতিটি নিত্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে কে কোথায় কীভাবে কারসাজি করছে, গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে সেসব ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। সে অনুযায়ী একটা মেকানিজম তৈরি করতে হবে। একজন ব্যবসায়ী কোনও পণ্যের দাম ইচ্ছে করলেই যেন বাড়াতে না পারে, মজুতদারি করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক পণ্যের দাম সরকার এমনভাবে নির্ধারণ করবে তাতে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত সকলেরই লাভের অংশ নির্ধারিত থাকে। কারোরই লোকসান না হয়। সে জন্য দ্রুততম সময়ে দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে বাজার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব বিলীন ও বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম  সহনীয় ও স্থিতিশীল হতে পারে। আর নিত্যপণ্যের সহনীয় মূল্যই পারে মানুষকে স্বস্তি দিতে, অন্য কিছুতে নয়।

এটা মনে রাখতে হবে যে, সদুপদেশ দিয়ে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। বাজারমূল্যের উপর নজরদারির জন্য সক্রিয় ও শক্তিশালী ‘টাস্ক ফোর্স’গঠন করতে হবে। পাইকারি বাজারে ৪০ টাকার বেগুন যখন খুচরা বাজারে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়, তখন সেই বিক্রেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বেআইনি মজুতদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। পনের দিনের ব্যবধানে একটি ডিমের দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা বাড়ল কেন? উৎপাদনের ঘাটতি অথবা সরবরাহের শৃঙ্খলায় ছেদ কি তার প্রধান কারণ? না কি এই মূল্যবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্রের ষড়যন্ত্র? এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়া সরকারের কাজ।

এই সময়ে মানুষরে আয় বাড়েনি। অথচ ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। আগে যে টাকা দিয়ে যে পরিমাণ, চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু, সবজি কেনা যেত, এখন তা যাচ্ছে না। অথচ পেটের খিদে অপরিবর্তিতই আছে। এমন অবস্থায় মানুষ যাবে কোথায়? কার কাছে প্রতিকার চাইবে?

বাজারে হঠাৎ করে ডিমের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে বহুজাতিক কোম্পানি এবং রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতিকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। সংগঠনটির মতে, সারা দেশে ডিমের বাজারে অস্থিরতা চলছে। যার প্রেক্ষিতে ডিম-মুরগির দামও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কোনও প্রান্তিক খামারিকে ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণের ওয়ার্কিং গ্রুপ কমিটিতে রাখেনি। তারা শুধু কর্পোরেট গ্রুপদের পরামর্শে দাম নির্ধারণ করেছে। যার ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আবার এর জন্য ফিড ও মুরগির বাচ্চার উৎপাদনকারী কোম্পানি, তাদের অ্যাসোসিয়েশন এবং তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতিসহ আরও অনেকের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি উদ্যোগও সিন্ডিকেটের স্বার্থকেই রক্ষা করছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে সবগুলো পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণও জানা যাচ্ছে না। সবজির দাম বৃদ্ধির পেছনে বন্যা, বৃষ্টি, খরাকে সব সময় দায়ী করা হয়। যদিও তা সব সময় সত্য নয়। এখানেও রয়েছে কারসাজি। বাজারগুলিতে যে পরিমাণ তরিতরকারি প্রয়োজন, তার চেয়ে কত কম ছিল পাইকারি বাজার বা আড়তগুলিতে, সেই তথ্য নিতে হবে। তা হলে বোঝা সম্ভব বিক্রেতা বাধ্য হয়ে দাম বাড়িয়েছেন, না কি ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন। অতীতে আমরা দেখেছি, মানিকগঞ্জের বাজারে যে সব সবজির দাম কেজি প্রতি পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা, সেগুলোই ঢাকা শহরে বিক্রি হচ্ছে আশি থেকে একশ টাকা। জোগানে ঘাটতিই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হলে নিশ্চয় চাষিরা উপকৃত হতেন। কিন্তু চাষি কম দামে বিক্রি করেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা একটু একটু করে দাম বাড়াতে থাকেন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কোনও প্রান্তিক খামারিকে ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণের ওয়ার্কিং গ্রুপ কমিটিতে রাখেনি। তারা শুধু কর্পোরেট গ্রুপদের পরামর্শে দাম নির্ধারণ করেছে। যার ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

জেলাগুলিতে বিভিন্ন সবজি বিক্রি করে চাষি গড়ে কত দাম পেয়েছেন, সরকার তার তালিকা বের করলে স্পষ্ট হতো, শহরের বাজারের ঝটিতি মূল্যবৃদ্ধির কতখানি ঘটেছে মধ্যস্বত্বভোগীর অঙ্গুলিহেলনে।

প্রকৃত ছবি পাওয়ার আশা কম, কারণ আমাদের সমাজে মধ্যস্বত্বভোগীরাই প্রভাবশালী। ফলে একদিকে, চাষ অলাভজনক হওয়ায় বহু চাষি কাজ ছেড়ে শ্রমিক হয়ে গ্রাম ছাড়ছেন। উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় বহু চাষি সবজির আবাদ কমিয়ে দিচ্ছেন। অন্য দিকে, সবজি দুর্মূল্য হওয়ায় তা কিনছে না বহু পরিবার। তাতে ক্ষতির মুখে পড়ছে বহু খুচরো বিক্রেতাও। পাশাপাশি চলছে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়। টমেটো-সহ বহু সবজি প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হয় প্রতি বছর।

যে সুসংহত পরিকল্পনা থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় এবং অপচয় ও অপুষ্টির দুষ্টচক্র বন্ধ হয়, তা প্রণয়নের ধৈর্য বা ইচ্ছা, কোনওটাই আগের সরকারেও ছিল না। বর্তমান সরকারেরও আছে বলে মনে হয় না।   

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত