Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর

যে কারণে চার্জশিট পর্যন্ত জামিন পেল ৬৩ আইনজীবী

SS-ctg-court-130125
[publishpress_authors_box]

জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর হওয়াকে কেন্দ্র করে গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে সংঘর্ষ, ভাঙচুরের ঘটনায় একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন ৬৩ আইনজীবী। এর মধ্যে চিন্ময়ের প্রধান আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা আছেন।

ভাঙচুর ও বিস্ফোরক আইনের এই মামলাটি করেন নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের ছোট ভাই। মামলায় সোমবার শুনানির সময় ৬৩ আইনজীবীর সবাই আদালতে আত্নসমর্পন করে জামিন আবেদন করেন।

চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সরকার হাসান শাহরিয়ার শুনানি শেষে এই জামিন মঞ্জুর করেন। আদালত তাদের কাছ থেকে এক হাজার টাকার বন্ডে স্বাক্ষর নিয়ে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) না হওয়া পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেছেন।

চিন্ময়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে শুরু করে তার জামিন আবেদন ঘিরে সংঘর্ষ, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলাসহ যতগুলো মামলা হয়েছে, তাদের মধ্যে এই প্রথম কারও জামিন হলো। তবে একটি মামলায় জামিন হলেও চিন্ময়ের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার শুনানিতে তারা অংশ নিতে পারবেন কি না—তা এখনও নিশ্চিত নয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে তার প্রতিবাদে গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে সমাবেশ করে সনাতন জাগরণ মঞ্চ। ওই সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।

গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ ঘোষণা করেন চিন্ময়। এরপর তিনি এই জোটের মুখপাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। 

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচি নিয়ে নামা চিন্ময়কে গত বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে জানান সনাতনী বিদ্যার্থী সংসদের প্রতিষ্ঠাতা কুশল বরণ চক্রবর্তী।

পরের দিন ২৬ নভেম্বর চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুর হলে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে ব্যাপক ভাঙচুর, সংঘর্ষ হয়। পুলিশ, আইনজীবী ও চিন্ময়ের অনুসারীরা ত্রিমুখী সংঘর্ষে জড়ালে বেশ কয়েক ঘণ্টা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা, সংঘর্ষ ও ভাঙচুর ঘিরে একাধিক মামলা হয়।

সাইফুলের বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩০ নভেম্বর ১১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও অজ্ঞাত অনেককে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ জনকে। আর আদালত চত্বরে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় সাইফুলের ছোট ভাই খান এ আলম বাদী হয়ে ১১৬ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন। দুটি মামলাতেই হিন্দু অনেক আইনজীবীর বিরুদ্ধে আসামি করা হয়।

সোমবার আসামি পক্ষের আইনজীবী শুভ্রজিৎ চৌধুরী বলেন, “শুরু থেকেই আমরা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। আজকের মামলাটি মূলত তার ছোট ভাইয়ের করা ভাঙচুর ও বিস্ফোরক আইনের মামলা। এখানে ৬৩ জন আইনজীবীকে সম্পৃক্ত করা হলেও তারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না, সেটি আমারা আদালতে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

“আর যিনি মামলা করেছেন, বাদী নিজেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। এছাড়া যে আলামত দেওয়ার কথা ছিল, সেই আলামত কিছুই দিতে পারেনি। বিজ্ঞ আদালত আমাদের শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে এই মামলার চার্জশিট না হওয়া পর্যন্ত ৬৩ জন আইনজীবীকে জামিন দিয়েছেন।”

এদিন আদেশের আগে থেকেই আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালত ভবনের তৃতীয় তলায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যও মোতায়েন ছিল।

এর পরপরই আইনজীবীদের একাংশ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে এসে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’, ‘ইসকনের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘আলিফ ভাই কবরে খুনি কেন বাইরে’—এসব স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় তারা আসামি হওয়া আইনজীবীদের জামিন দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং বিক্ষোভ করতে থাকেন।

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মফিজুল হক ভূঁইয়া বলেন, “মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় পুলিশ প্রতিবেদন (চার্জশিট) না আসা পর্যন্ত আইনজীবীদের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে।”

যে কারণে আইনজীবীদের জামিন

সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা করেছে তার পরিবার। একটি মামলার বাদী তার বাবা জামাল উদ্দিন; সেটি ছিল হত্যা মামলা। আরেকটি করেন সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই খান এ আলম।

দুটি মামলাতেই ৬৩ আইনজীবী আসামি ছিলেন। ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তাদের সবাই চট্টগ্রাম আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন, কিন্তু শুনানি হয়নি। ফলে জামিন মেলেনি।

২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি আইনজীবী সমিতি বসে সিদ্ধান্ত নেয় দুটি মামলায় আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে আইনজীবী সমিতির কোনও আপত্তি থাকবে না। মামলার শুনানিতে আইনজীবী সমিতি সহযোগিতা করবেন। সেই সিদ্ধান্ত রেজুলেশন হিসেবে প্রকাশ পায়। আর সোমবার (১৩ জানুয়ারি) শুনানির দিনই তারা জামিন আবেদন করেছেন এবং জামিনও পেলেন।

লিখিত বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বলেন, “সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সভাপতিত্বে ৬ জানুয়ারি আইনজীবী সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। ৩ নম্বর সিদ্ধান্তে ২৪ ডিসেম্বর সেই আইনজীবীরা জামিন পেতে আইনজীবী সমিতির সহায়তা চেয়েছিলেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র আইনজীবী, সনাতনী আইনজীবীদের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করা হয়।

“একইসাথে এই বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করা হয়। সব আলোচনার প্রেক্ষিতে সেই আইনজীবীদের জামিন পেতে আইনজীবী সমিতি সহায়তা দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”

“সেই আইনজীবীরা চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য। ফলে তারা যদি নিজেরা কালতনামা দিয়ে জামিনের আবেদন করেন, তাহলে আইনজীবী সমিতির তাতে কোনও আপত্তি থাকবে না। জামিন পেতে সমিতির সহযোগিতা থাকবে।”

কিন্তু সাধারণ আইনজীবীরা প্রশ্ন করেছেন, ২৪ ডিসেম্বরের আবেদনের সুরাহা করতে এতদিন লাগল কেন। আইনজীবী সমিতি চাইলে পরদিনই সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, কিন্তু সেটি না করে বাহানা করেছেন। ফলে আইনজীবী হিসেবে জামিনের আবেদন থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে। এতে শেষপর্যন্ত কারা লাভবান হলেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

চিন্ময়ের পক্ষে হাই কোর্টে জামিনের ফাইল

গত বছরের ২৫ অক্টোবর সনাতন জাগরণ মঞ্চের চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের সমাবেশের দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপর ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা স্থাপন করা হয়। এ ঘটনায় গত ৩০ অক্টোবর রাতে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন মো. ফিরোজ খান নামে বিএনপি থেকে বহিস্কৃত নেতা।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল। পরে গত ২৫ অক্টোবর সনাতন জাগরণ মঞ্চের লালদীঘি মাঠের সমাবেশের দিন সেই পতাকার উপর ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা স্থাপন করা হয়। এটি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে অবমাননার শামিল।

সেই মামলায় চিন্ময়ের পক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন শুভাশীষ শর্মা। কিন্তু সাইফুল হত্যায় আসামি হওয়ায় শুভাশীষসহ তাদের কেউই আদালতে শুনানিতে অংশ নিতে পারেননি। পরে সুপ্রীম কোর্ট থেকে সিনিয়র আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ চট্টগ্রাম এসে সেই মামলার শুনানিতে অংশ নিতে গেলে কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি শুনানিতে অংশ নিতে পারেননি।

পরে ২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে একদল আইনজীবী এসে চিন্ময়ের পক্ষে শুনানিতে দাঁড়ান, কিন্তু আদালত তখন তাদের জামিন দেননি। পরে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে এ বিষয়ে প্রতিকার চাওয়ার কথা বলেন অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে আইনজীবীরা।

এমন প্রেক্ষাপটে চিন্ময়ের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিরুদ্ধে একটি মামলা আবেদন তৈরি করে হাই কোর্টে জমা দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের সেই আইনজীবীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ জোটের সংগঠক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রবিবার (১২ জানুয়ারি) মামলার আবেদন হাইকোর্টে ফাইল করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহে এর শুনানি হতে পারে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত