Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে কেন শুধু দুই দল

USA
[publishpress_authors_box]

আসছে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশটির ভোটারদের এসময় স্বাভাবিকভাবেই ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান পার্টি থেকে একজন প্রার্থীকে বাছাই করতে হবে। দেশটির দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণে অন্য কোনও দলের প্রার্থীদের সামনে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে।

বিশ্লেষকদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যবস্থাকে দেশটির ভোটারদের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। এনিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কও হয়েছে সেখানে।

১৮৫২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট দলের একজন প্রার্থী প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। ব্যতিক্রম ঘটে শুধু একবার। ১৯১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনপ্রিয় সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ‘থার্ড পার্টি’ বা তৃতীয় কোনও দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছান। তবে উড্রো উইলসনের কাছে হেরে যান তিনি।

রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টি দুটিই প্রধান রাজনৈতিক দল হওয়ার আগে দেশটিতে ছিল ডেমোক্র্যাট ও উইগ নামে দুই দল। এরও আগে প্রধান দুই দল ছিল ডেমোক্র্যাট ও ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টি। আর তারও আগে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান এবং ফেডারালিস্ট দলগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল দেশটির রাজনীতিতে।

এখন পর্যন্ত থার্ড পার্টিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রাজনীতিতে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। ভোটের ময়দানে এসব দলগুলোর দেখা মিললেও, কখনো প্রেসিডেন্ট পদ জয়ের আসল সুযোগ পায়নি।

দলগুলো সাধারণত কংগ্রেসের আসনের জন্যও প্রতিযোগিতা করে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কংগ্রেসের ৫৩৫ জন সদস্যের মধ্যে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটের বাইরে অন্য কোনো সদস্য খুব কমই নির্বাচিত হয়েছে।

তবে ব্যতিক্রমও আছে। ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থীর জন্য নির্বাচন করেন।

কিন্তু এমনটা কেন হয়েছে?

এর উত্তর হল, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুটি প্রধান দলের জন্য তৈরি। এখানে কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হওয়া প্রার্থীরাই আসন পায়। কংগ্রেসে প্রার্থী হতে হলে শুধু ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই নির্বাচিত হওয়া যায়। ৫০টির মধ্যে ৪৮টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হলে সেই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পান। এভাবেই প্রতিটি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। শর্ত শুধু একটাই, সেই রাজ্যে প্রার্থীকে ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী মরিস ডুভারজে ১৯৫০-এর দশকে তত্ত্ব দেন যে, এই ধরনের ব্যবস্থা কার্যত দ্বিদলীয় ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করে। ‘ডুভারজের আইন’ অনুযায়ী, থার্ড পার্টিগুলো প্রতিযোগিতা করতে পারে না। কারণ ১৫ বা ২৫ শতাংশ ভোট পেলেও কোনো ফল তারা পায় না।

এর ফলে ভোটাররা এমন প্রার্থীকে বেছে নেয়, যার জয়ের সম্ভাবনা বেশি। আর দলগুলোও তাদের সমর্থন বাড়াতে ভোটারদের অন্তত অর্ধেককে এবং সম্ভব হলে তার চেয়েও বেশি ভোটারকে আকর্ষণের চেষ্টা করে।

ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা দলগুলো থার্ড পার্টির প্রার্থীদের এড়াতে সবকিছু করতে চেষ্টা করে। একটি রাজনৈতিক দলের ভোটারদের ওই দলের দুইজন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হলে, সেই দল নির্বাচনে হেরে যায়। কারণ, প্রার্থীরা ভোট ভাগাভাগি করে নেবে। এতে অন্য দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই জয়ী হবে।

কদাচিৎ থার্ড কোনো পার্টি থেকে কোনো গভর্নর বা সেনেটর নির্বাচিত হন। তবে এসব দল সাধারণত সীমিত প্রভাব রাখে এবং জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলন হয়ে উঠতে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য নির্ধারণ করে দেয় কীভাবে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ব্যালটে স্থান পাবে। এর মানে হলো, থার্ড পার্টির প্রার্থীদের সম্পদশালী হতে হয়, যাতে তারা নিজেদের প্রচার চালাতে এবং ৫০টি রাজ্যের ব্যালটের জন্য ব্যয়বহুল শর্ত পূরণ করতে পারে।

অতীতে থার্ড পার্টি ও স্বতন্ত্র অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনই জনসমর্থন পেয়েছেন। থার্ড পার্টির অল্প কয়েকজনই অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা রস পেরো ১৯ শতাংশ ভোট পেলেও একটিও ইলেকটোরাল ভোটও জিততে পারেননি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থার্ড পার্টির প্রার্থীরা ইলেকটোরাল ভোট পেলে জাতিগত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে ৪৬টি ইলেকটোরাল ভোট পাওয়া জর্জ ওয়ালেস এবং ১৯৪৮ সালে ৩৯টি ভোট পাওয়া স্ট্রোম থারমন্ড ছিলেন দক্ষিণের প্রার্থী। তারা কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের সংহতির কঠোর বিরোধী ছিলেন। তারা ছিলেন শেষ দুই নেতা, যারা রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট না হয়েও ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়ও একই ধরনের আঞ্চলিক থার্ড পার্টির প্রার্থীরা কিছু সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু তারা কখনো প্রকৃতপক্ষে জয়ের কাছাকাছি যেতে পারেনি।

এর বাইরে দুই প্রধান দলের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সাধারণ নির্বাচনে জয়ের প্রকৃত সম্ভাবনা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া একমাত্র প্রার্থী ছিলেন রুজভেল্ট। তিনি ছিলেন এক বিশেষ প্রার্থী। তবুও তখন সাবেক ওই প্রেসিডেন্ট নিজের পুরনো দল রিপাবলিকানদের সঙ্গে ভোট ভাগাভাগি করে নেন।

রুজভেল্ট ও তার রিপাবলিকান উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট ১৯১২ সালে পপুলার ভোটের অধিকাংশ পেলেও, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী উড্রো উইলসন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ৪২ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিলেন।

এটি আরও জোরালোভাবে প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই দলীয় ব্যবস্থা বজায় রাখার আগ্রহ আছে।

তবে ২০২১ সালে গ্যালাপের করা জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিদলীয় রাজনীতির প্রতি অসন্তোষের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬২ শতাংশ আমেরিকান বলছেন, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টি তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে একটি তৃতীয় দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে শূন্য-যোগফল ও বিজয়ী-গ্রহণের প্রক্রিয়া থার্ড পার্টিগুলোর জন্য নির্বাচনে স্থান পাওয়া প্রায় অসম্ভব করে তোলে। যদিও জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকার অর্ধেক জনগণ কোনো দলের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে বলতে ভালোবাসেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কনজারভেটিভ পলিটিকাল অ্যাকশন কনফারেন্সে এটি আরও স্পষ্ট হয়। সেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জাতীয়তাবাদী রক্ষনশীলতা প্রচারের জন্য তৃতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।

পরিবর্তনের আহ্বান জানানোর ক্ষেত্রে, অনেক পণ্ডিত ও কয়েকজন আইনপ্রণেতার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ব্যবস্থার মূল সমস্যা হলো, এটি রাজনৈতিক মতামতের পুরো পরিসরকে দুইটি দলে সীমাবদ্ধ করে দেয়।

তাদের মতে, দেশের স্বৈরশাসনে ফেরার প্রবণতা বাড়ছে। এটি প্রধানত রিপাবলিকান পার্টির গণতান্ত্রিক নীতির বাইরে সরে যাওয়ার কারণে ঘটছে। তারা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে কিছু রূঢ় পরিবর্তন দরকার। এর মধ্যে একটি হলো, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলগুলোকে ভাঙা প্রয়োজন।

দুই পার্টির ফাঁদ

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক ধরনের ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফল বলে মনে করেন নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী লি ড্রাটম্যান। তিনি তার ‘ব্রেকিং দ্য টু-পার্টি ডুম লুপ’ বইয়ে বলেন, “এই ব্যবস্থায়, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের কারণে থার্ড কোনো পার্টির জন্য দেওয়া ভোটগুলি কার্যত ‘ব্যর্থ’ হয়ে যায়।”

ড্রাটম্যান লেখেন, “দুইটি কার্যকর বিকল্পের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে, সব ভোটারকে একটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে হয়। ফলে তাদের দ্বিধা বা অস্পষ্টতা বোঝানো কঠিন হয়ে যায়।”

পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত নয়টি আলাদা রাজনৈতিক ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। আর গ্যালাপের জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশের কম মানুষ মনে করেন যে, প্রধান দুটি দল ‘আমেরিকান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যথেষ্ট ভালো কাজ করছে’।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট ডেভিসের অবসরপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ম্যাথিউ শুগার্টের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে মূলত তিনটি বড় রাজনৈতিক বিভাজন কার্যকর আছে।

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট/রিপাবলিকান বিভাজন প্রায় ৫০/৫০। দ্বিতীয়ত, ক্যাপিটালিস্ট/সোশ্যালিস্ট বিভাজন রয়েছে। সেখানে বামপন্থীদের মধ্যে সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স (আই-ভি.টি.), যিনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলেছেন। এর বিপরীতে অনেকে বাম বা ডান শিবিরে দাঁড়িয়ে আছেন।

তবে ট্রাম্প পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন হলো ডেমোক্র্যাটিক/স্বৈরশাসক বিভাজন, যা ডানে হেলে আছে। শুগার্ট লিখেছেন, “এক্ষেত্রে গণতন্ত্রপন্থী অংশটি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সবচেয়ে বামপন্থী বড় অংশ থেকে শুরু করে রিপাবলিকান পার্টির মধ্যভাগের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত।”

অন্যদিকে, রিপাবলিকান পার্টিতে ট্রাম্পপন্থী অংশ রয়েছে। অংশটি তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা এগিয়ে নিতে ‘গণতন্ত্রকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে এবং রাজনৈতিক হিংসাকে প্রচার বা সহ্য করতে প্রস্তুত’।

রিপাবলিকান পার্টির গণতন্ত্রবিরোধী অংশ দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে খুবই ছোট হলেও এটি দলের মধ্যে অনেক শক্তিশালী।

এক সাক্ষাৎকারে ড্রাটম্যান বলেছেন “এখন আমেরিকান গণতন্ত্রের মূল বিপদ হলো রিপাবলিকান পার্টি একটি চরম অ্যান্টি-সিস্টেম গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রভাবিত। দলে কিছু সদস্য আছে যারা এখনও মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু তারা পার্টির মধ্যে বিজয়ী অবস্থানে নেই।”

অন্যান্য গণতন্ত্রেও চরম ডানপন্থী, অ্যান্টি-ডেমোক্র্যাটিক গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু প্রায় সব গণতন্ত্রে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে একটি দলের জন্য আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া অনেক কঠিন। যেমন আয়ারল্যান্ড, জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে, মধ্যপন্থী ডান ও গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো সাধারণত চরম ডানপন্থীদের তুলনায় মধ্যপন্থী বামের সঙ্গে সহযোগিতার প্রশ্নে বেশি আগ্রহী।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত