যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই অতীত অপরাধের রেকর্ড থেকে আমেরিকানদের মুক্ত করতে চেষ্টা করছেন। তারা নাগরিকদের পুরনো মামলার তথ্য মুছে ফেলার এবং চাকরি বা বাসস্থানের জন্য আবেদনের সময় গ্রেপ্তারের তথ্য গোপন রাখার পক্ষে প্রচার চালিয়ে আসছেন।
অধিকারকর্মীদের এই চেষ্টাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটিতে ৭ কোটিরও বেশি মানুষের অতীতে করা কোনো অপরাধ বা গ্রেপ্তারের রেকর্ড রয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের আছে অপরাধের রেকর্ড।
এত বড় একটি সমস্যা এখনও নীতিমালা করে সমাধান করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো খবরের কাগজ বা অনলাইনে ছাপা অপরাধের খবর অনেক সময় মানুষের জীবনকে কঠিন করে তোলে। পুলিশের সঙ্গে পুরোনো কোনো ঝামেলা থাকলে সেসব খবর তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে সমস্যা তৈরি করে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংবাদমাধ্যম এই সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি দেশটির কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকা তাদের আর্কাইভ পর্যালোচনা শুরু করেছে। তারা ছোটখাটো অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য নাম মুছে ফেলা বা পুরোনো খবর সরানোর অনুরোধ বিবেচনা করছে।
ক্লিভল্যান্ড ডটকম ও প্লেইন ডিলার পত্রিকার সম্পাদক ক্রিস কুইন বলেন, “আগে একটি খবর পত্রিকায় ছাপানো হলে, তা দ্রুত বা সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি থেকে মুছে যেত। কিন্তু বর্তমান সার্চ ইঞ্জিন প্রযুক্তির কারণে, এখন যেকোনো বিষয়ে লেখা সব সময় সামনে থাকে।”
ক্রিস কুইন ২০১৮ সালে ‘ভুলে যাওয়ার অধিকার’ বিষয়ক একটি প্রকল্প চালু করেন। এটি শুরুর প্রেরণা ছিল অতীত অপরাধ সংক্রান্ত খবরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া অনুরোধ। তারা তাকে বলতেন, “আপনার খবর আমার জীবন নষ্ট করছে। আমি ভুল করেছিলাম, কিন্তু এখন আমি বদলে গেছি।”
মিডিয়াতে পুরোনো খবর মুছে ফেলা বা বদলানো অনেক দিন ধরে খারাপ কাজ মনে করা হতো। তবে কুইন বলছেন, তিনি এই নিয়মগুলোর নৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আরও ভাবনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “একটা পর্যায়ে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না… ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম মানুষকে ‘না’ বলতে বলতে। ঐতিহ্য মেনে চলার বদলে ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে।”
কুইন একটি পুরোনো ঘটনা মনে করেন, যেখানে এক মদ্যপ কিশোর একটি কবরস্থানে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙেছিল এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেক বছর পরে, সে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চান এবং চাকরির জন্য আবেদন করছিল।
কুইন ওই কিশোর সম্পর্কে বলেন, “সে ছোটবেলায় ভুল করেছিল। আমাকে সে বলেছিল, ‘এখন আমি এগিয়ে যেতে পারছি না’।” এরপর পত্রিকার সম্পাদক তার নাম মুছে ফেলেন এবং একে অন্যদের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে দেখান।
শুরুতে এনিয়ে কিছু অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল। তবে শেষে কুইন ও তার দল কিছু সাধারণ নিয়ম তৈরি করেন: তারা সহিংসতা, যৌন অপরাধ, শিশুদের প্রতি অপরাধ বা দুর্নীতির ক্ষেত্রে নাম মুছবে না। পুলিশ কর্মকর্তাদের জনগণের কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হবে, তাই তাদের অন্যায়ের খবর মোছা হবে না। ঘটনা সাধারণত কমপক্ষে চার বছর পুরোনো হতে হবে, তবে সবক্ষেত্রে নয়।
কুইন কঠোর নিয়ম রাখতে চাননি, কারণ প্রতিটি ঘটনা আলাদা। তিনি বলেন, “প্রধান প্রশ্ন ছিল: কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ—রেকর্ডটি জনগণের কাছে থাকা, না এই ব্যক্তির সামনে এগিয়ে যাওয়া?”
এই ধারণাটি পরে বোস্টন গ্লোব, আটলান্টা জার্নাল-কনস্টিটিউশন, ব্যাঙ্গর ডেইলি নিউজ, দ্য অরেগনিয়ান ও এনজে ডটকমে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদের পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের পক্ষপাতমূলক ও ক্ষতিকর সংবাদ পরিবেশন নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন শুরু করে।
গুগলের তহবিল পেয়ে কুইন তার কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে এমন একটি টুল তৈরি করে দেন যা মুছে ফেলা দরকার এমন খবর খুঁজে বের করতে পারে। কাজটি কঠিন ছিল। তবে এর মাধ্যমে হাজার হাজার পুরোনো খবর মুছে ফেলা সম্ভব হয়।
পোর্টল্যান্ডভিত্তিক অরেগনিয়ান পত্রিকার সম্পাদক থেরেসে বটমলি বলেন, আগে পত্রিকাটির বিশেষ রিপোর্টাররা শহরের আশপাশের উপকণ্ঠে ছোটখাটো অপরাধসহ স্থানীয় খবর সংগ্রহ করতেন।
তিনি প্রশ্ন করেন, “এটি কি সত্যিই এমন কিছু, যা বছরের পর বছর দরে কারো পেছনে তাড়া করবে?” এই অপরাধগুলো ছোট ছিল এবং অন্য পত্রিকাগুলো সেগুলো প্রকাশ করত না। তাই ২০২১ সালে থেরেসে একটি ক্লিন স্লেট প্রোগ্রাম চালু করেন এবং সংবাদ মুছে ফেলার অনুরোধ পর্যালোচনার জন্য একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করেন।
অরেগনিয়ান পত্রিকা তখন বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাব সামনে আনে। তারা ‘মাগশট’ (গ্রেপ্তারের সময় তোলা অপরাধীর ছবি) মুছে ফেলার কথা বলে। এছাড়া পত্রিকার পক্ষ থেকে একজন ব্যক্তির নাম মুছে ফেলতে, পুরো সংবাদটি মুছে দিতে বা গুগলকে সেই খবরটি সার্চে সহজে না পাওয়ার অনুরোধ করতে পারে। অর্থাৎ সংবাদটি অরেগনলাইভ ডটকমে থাকবে, তবে ওয়েব সার্চে সহজে পাওয়া যাবে না। পত্রিকার কমিটি আবেদনকারীর দাবির সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত করে যে, তারা (যাদের নামে সংবাদটি প্রকাশ হয়েছিল) আদালতের শর্ত পূরণ করেছে এবং অপরাধমুক্ত হয়েছে।
প্রত্যেকটি আবেদন মনোযোগ সহকারে পর্যালোচনা করা হয়। এক শিক্ষক তার করা ছোট অপরাধের রেকর্ড মুছে ফেলতে আবেদন করেছিলেন। তবে অরেগনিয়ান পত্রিকা ওই শিক্ষকের সংবাদটি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তদন্তে জানা গিয়েছিল, ওই শিক্ষক বছরের পর বছর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
অবশ্য অরেগনিয়ান পত্রিকার কমিটি গাড়ি চুরির জন্য কারাবন্দী পুরুষ ও অবৈধ মাদক রাখায় ধরা পড়া এক নারীর প্রতিবেদন মুছে ফেলেছে।
গত নভেম্বরে সম্পাদক থেরেসে বটমলি এক ব্যক্তির হৃদয়স্পর্শী আবেদন থেকে কিছু অংশ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি একটি অ-সহিংস অপরাধের খবর মুছে ফেলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, তিনি এক সময় আসক্তির কারণে অনেক নিচে নেমেছিলেন। তিনি তার পুনর্বাসনের দীর্ঘ যাত্রা এবং এখন যে পরিবারটি তিনি লালন করছেন, তা নিয়ে কথা বলেন।
আবেদনে ওই ব্যক্তি লিখেছিলেন, “আমি এখন গর্বিত। কারণ আমার জীবন এখন আগের চেয়ে আলাদা। তবে আমি ভয় পাই যে, গুগলে আমার নাম খুঁজলেই, আমি কঠোর পরিশ্রমে যা তৈরি করেছি তা নষ্ট হয়ে যাবে।” তার প্রায় ১০ বছরের পুরোনো প্রতিবেদনটি মুছে ফেলা হয়।
বটমলি উল্লেখ করেন, রাজ্যের কারাগারে থাকা বেশিরভাগ মানুষ এক দিন মুক্তি পাবে। তারা আমাদের প্রতিবেশী, সহকর্মী এবং আশা করি একদিন সমাজে অবদান রাখবে। আমরা কি এমন উপায় বের করতে পারি যাতে অতীতের কারণে ফের সমাজে প্রবেশ করার পথে কারো বাধা না তৈরি হয়।
পত্রিকাগুলোর সম্পাদকেরা মনে করেন, এসব প্রোগ্রাম সাংবাদমাধ্যমগুলোকে তাদের বর্তমান প্রতিবেদন তৈরিতে আরও সচেতন করবে।
ক্যালিফোর্নিয়ানস ফর সেফটি অ্যান্ড জাস্টিসের পার্টনারশিপ ডিরেক্টর সন হফ বলেন, রিপোর্টাররা প্রায়ই গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা পরবর্তীতে আর অনুসন্ধান করেন না। প্রাথমিক গ্রেপ্তারের উপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদন সেই ব্যক্তির জীবনব্যাপী প্রভাব ফেলে।
হফ বলেন, “এটি একটি অবিরাম উদ্বেগের অনুভূতি সৃষ্টি করে, যা অনেক মানুষ বয়ে বেড়ান। অপরাধের খবর সাধারণত একজন ব্যক্তির দুঃখ বা সংগ্রাম সম্পর্কে কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই পরিবেশন করা হয়। অথচ তার করা ঘটনার পেছনে কারণ ছিল। মানুষ প্রতিদিন ওঠে এবং প্রার্থনা করে যে, তার গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে যেন তাকে কথা বলতে না হয়।”
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান