বিশ্বে মুটিয়ে যাওয়া মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেশভিত্তিক তালিকা প্রকাশ পেয়েছে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস সংস্থার ওয়েবসাইটে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় টোঙ্গা দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকরা স্থূলতার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। একই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ১৮২ নম্বরে। অর্থাৎ দেশে স্থূল মানুষের সংখ্যা কম।
আলাদা করে কম স্থূল ৪০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে ১০ নম্বরে।
বিএমআই বা বডি ম্যাস ইনডেক্স পরিমাপ করে ১৯৫টি দেশ নিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে ।
বেলজিয়ান গণিতবিদ অ্যাডলফ কুয়েটেলেট উদ্ভাবিত এই বিএমআই হলো কারও উচ্চতা এবং ওজনের ভিত্তিতে শরীরের চর্বি মাপার ক্যালকুলেটর। যদি বিএমআই ১৮ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম/বর্গ মিটারের কম হয়, তাহলে আদর্শ মানের থেকে ব্যক্তির ওজন কম; যাকে বলে আন্ডারওয়েট। আবার যদি বিএমআই ৩০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯ কিলোগ্রাম/বর্গ মিটারের মধ্যে হয় তবে ওই ব্যক্তি স্থূলতায় ভুগছেন।
দেখা যাচ্ছে, টোঙ্গা দ্বীপের ৭০ দশমিক ৫৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় এই সমস্যা অনেক কম দেখা যাচ্ছে; মোটে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভুগছেন।
দ্বীপাঞ্চলের মানুষের মুটিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এসব এলাকায় ‘প্রসেসড ফুড’ আমদানি অনেক বেড়ে যায়। ৫০ থেকে ৬০– এর দশকে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জীবনধারা রপ্ত করতে শুরু করে। এতে করে দ্বীপাঞ্চলের মাছ, সবজি, ফল খাদ্যাভাস বদলে গিয়ে আসে উচ্চ ক্যালরির সাদা চাল, কোমল পানীয়, ক্যানড ফুড, প্রসেসড মিট।
এ ধরনের খাবার মানেই ক্যালরি, লবণ এবং প্রসেসড চিনি। এসব খাবার এক সময় নেশার মতো অভ্যাসে পরিণত হয়।
দ্বীপাঞ্চলে কৃষিকাজের জীবনধারাও বদলে গিয়ে অফিসের কাজের চর্চা শুরু হয়। এতে করে কায়িক শ্রমের অভ্যাসও সীমিত হয়ে আসে। সড়কের উন্নয়ন হওয়াতে মানুষ গাড়ি কিনে যাতায়াত শুরু করে; তাতে করে হাঁটার অভ্যাসও হারাতে শুরু করে।
২০২৪ সালের স্থূলতার তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ১৩ নম্বরে থাকা যুক্তরাষ্টে ৪২ দশমিক ৮৭ শতাংশ মানুষ অতিরিক্ত ওজনের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষ কি তাহলে স্থূলতা মুক্ত?
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণায় ১৯৫টি দেশ ও অঞ্চলে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ২০১৫ সাল পর্যন্ত দৈহিক স্থূলতায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা দুশো ২০ কোটি।
ওই জরিপের ফলাফলে এক নম্বরে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর মোটে ১ শতাংশ স্থূলতা নিয়ে তালিকার একেবারে তলে ছিল বাংলাদেশ।
২০২১ সালে শীর্ণ স্বাস্থ্যের ২০ দেশের তালিকায় ভিয়েতনামের মোটে ২ দশমিক ১ শতাংশ স্থূল মানুষ দেখা যায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ভিয়েতনামের ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী দরিদ্র। ভালো খেতে না পারা কারণে ভিয়েতনামের একাংশ জনগোষ্ঠী রোগা। তবে এর বাইরে সেখানে খাদ্যাভাসে ভারসাম্য রয়েছে। ফলে বাড়তি ওজনে ভোগা মানুষ দেখা যায় না ভিয়েতনামে।
২০২১ সালে শীর্ণ স্বাস্থ্যের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল দ্বিতীয় সারিতে। সেবার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ স্থূল পাওয়া গিয়েছিল জরিপে।
ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের ব্যাখ্যা বলছে, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অপুষ্টিতে ভোগে।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) বলছে, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
জাপান যখন ব্যতিক্রম
২০২১ সালে জাপানে মোটে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভুগছিল। ২০২৪ সালে স্থূলতার তালিকায় জাপান আছে ঠিক বাংলাদেশের নিচে; ১৮৩ নম্বরে। জাপানে এবার ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ স্থূল মানুষ মিলেছে।
উন্নত দেশ হওয়ার পরও জাপানের স্থূল মানুষের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ আসলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস।
উচ্চমানের শর্করা জাতীয় খাবার ভাত ও নুডলসের পাশাপাশি জাপানিরা প্রোটিন, ফাইবার এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রাখে সবসময়। ‘জাপানিজ ডায়েট’ পালন করার কারণে দেশটিতে মানুষের গড় আয়ুও অনেক বেশি।
মুটিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের গবেষণা জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বয়স্কদের মধ্যে ১৭ শতাংশ স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের শিকার৷ শিশুদের মধ্যে এই হার সাড়ে ৪ শতাংশ দেখা গিয়েছিল৷
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বলেছিল, দেশে প্রতি পাঁচজন বিবাহিত নারীর মধ্যে একজন স্থূল বা অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী।
বিএমসি ওবেসিটি জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় ১৬ হাজার ৪৯৩ জন নারীর উপর জরিপ করা হয়। দেখা গিয়েছিল, ১৮ শতাংশই অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা সমস্যায় ভুগছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতি আট জনের মধ্যে একজনের স্থূলতা রয়েছে। ৯০ দশক থেকে এই পরিসংখ্যান দ্বিগুণ হতে শুরু করে।
ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস বলছে, তিন দশকে শিশুদের স্থূলতা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে অন্তত ২৫ কোটি শিশু স্থূলতায় আক্রান্ত হবে। নগরায়ন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চার অভাবে মানুষের স্থূলতা দেখা দেয়। আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো যতবেশি শিল্পখাতে উন্নতি করবে, স্থূলতাও বাড়বে পাল্লা দিয়ে।