প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয় তা ঢোকে মূলত বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থলবন্দর দিনাজপুরের হিলি। গত রবিবার হঠাৎ করে এই বন্দর দিয়ে আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানির স্লট বুকিং নেওয়া বন্ধ করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
এর ফলে হিলি বন্দর দিয়ে আলু ও পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে দেশের বাজারে নতুন আলু উঠেছে; পাতাওয়ালা নতুন পেঁয়াজও বাজারে আসতে শুরু করেছে। তাই ভারত থেকে আমদানি বন্ধের কারণে দেশে আলু ও পেঁয়াজের সরবরাহে তেমন ঘাটতি পড়ার কথা নয়। তবে এ দুই পণ্যের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে দেশের কাঁচাবাজারগুলোতে নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকা কেজি। পুরান আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি। দেশি পেঁয়াজ বাজারে তেমন নেই। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পাতাওয়ালা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি।
দিনাজপুর হিলি বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার দুপুর থেকেই পেঁয়াজ ও আলুর স্লট বুকিং বন্ধ করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত আলু ও পেঁয়াজ বিদেশে রপ্তানির ফলে বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
ভারতের হিলি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অনিল সরকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে অনলাইনে ট্রাকের জন্য স্লট বুকিং নিতে হয়। এরপরই সেই পণ্যের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করা হয়।
ভারতীয় রপ্তানিকারক রাম কৃষ্ণ দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “আমি ভারত থেকে বাংলাদেশে আলু রপ্তানি করি। অন্যান্য দিনের মতো রবিবার আমি আলু রপ্তানি করেছি। কিন্তু দুপুরে শুনতে পারলাম যে আলু ও পেঁয়াজের স্লট বুকিং বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
“এতে আমরা রপ্তানিকারকরাও অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছি। ভারতের উত্তরপ্রদেশ পাঞ্জাব হরিয়ানা অঞ্চল থেকে যেসব আলু বোঝাই হয়ে আসছে, সেসব ট্রাকগুলো রাস্তায় রয়েছে। এখন এ অবস্থায় এসব আটকে গেলে আলু পচে নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়ে যাব।”
হিলি স্থলবন্দরের আলু আমদানিকারক মোস্তফা হোসেন বলেন, “বাজারে দেশি আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছেই। যার কারণে ভারত থেকে আলু আমদানি করা হচ্ছিল। এখন হঠাৎ করে যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তো আমরা ক্ষতির মুখে পড়ে যাব।”
হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল আলম জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলু ও পেঁয়াজ আমদানি যেমন অব্যাহত ছিল, তেমনি আমদানির পরিমাণ বাড়তির দিকে ছিল। রবিবার বন্দর দিয়ে ৭২টি ট্রাকে ২ হাজার ৩৯ টন আলু আমদানি হয়েছিল। সোমবার তা অনেক কমে গেছে। বিকাল ৩টা পর্যন্ত এক ট্রাক আলু আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউএনবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকাল থেকে বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি আলু ও পেঁয়াজবাহী ট্রাক। আগের অনলাইন স্লট বুকিং থাকায় সকালে আলুবাহী একটি ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,গত রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে রপ্তানির অপেক্ষায় আলু ও পেঁয়াজবাহী ৫০-৬০টি ট্রাক ভারতে আটকা পড়েছে। অনলাইন স্লট বুকিং বন্ধ থাকায় পণ্যবাহী ট্রাকগুলো বাংলাদেশে যেতে পারছে না।
ভারতের হিলির রপ্তানিকারক পাপ্পু আগরওয়াল বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবিবার সকাল থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি না করার জন্য আলু ও পেঁয়াজবাহী ট্রাকের অনলাইন স্লট বুকিং বন্ধ রাখে। সোমবার অনলাইনে এই দুটি পণ্যবাহী ট্রাকের স্লট বুকিং দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সার্ভারে ঢোকা যায়নি। আলু ও পেঁয়াজের রপ্তানি স্বাভাবিক রাখতে আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আবেদনের উদ্যোগ নিয়েছি।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে মালদা ও বালুঘাট জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মিটিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আগে যেসব আলু ও পেঁয়াজবাহী ট্রাকের স্লট বুকিং নেওয়া হয়েছিল, শুধু সেসব ট্রাক গত রবিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই মুহূর্তে আলু ও পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হলে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সহ-সভাপতি শহীদুল ইসলাম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “আজ মঙ্গলবার হিলি বন্দর দিয়ে আলু ও পেঁয়াজবাহী একটি ট্রাকও ঢোকেনি। ওপারে অনেক ট্রাক আটকা পড়েছে। অনলাইনে স্লট বুকিং না পেলেও আগামীকাল বুধবার সেগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।”
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের এই সহ-সভাপতি জানান, তারা জানতে পেরেছেন পশ্চিমবঙ্গে আলু ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এ কারণে রাজ্য সরকার সরবারহ ও দাম ঠিক রাখতে এ দুটি পণ্য রপ্তানি সঙ্কুচিত করে থাকতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরকে না জানিয়ে সেখান থেকে অন্য রাজ্যে এবং বাংলাদেশে আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানি করা হচ্ছিল। ফলে সেখানে আলুসহ পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়ছে। এমন অভিযোগ তুলে ধরে গত বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই বার্তার পরই শুক্রবার (২২ নভেম্বর) নবান্নে বৈঠকে বসে টাস্কফোর্স কমিটি। মুখ্য সচিবের সঙ্গে টাস্কফোর্সের এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় মুখ্যমন্ত্রীর পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত ভিন্ন রাজ্যসহ বাংলাদেশে আপাতত আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ থাকবে।
বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা গেছে, হিলি ছাড়াও চারটি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে যেকোনও পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন দপ্তর থেকে পণ্যবাহী ট্রাকের জন্য অনলাইনে স্লট বুকিং দিয়ে সিরিয়াল নিতে হয়। সে অনুযায়ী পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে।