হ্যারি লি কখনো ভাবেননি, মজার ছলে করা তার অনলাইন নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন এতটা জনপ্রিয় হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নববর্ষকে উদযাপনে নানা আনন্দ আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এশিয়ার দেশ তাইওয়ানের বহু মানুষ নববর্ষ উদযাপনে ‘কান্না’র জন্য অপেক্ষা করছেন। এভাবেই তারা হ্যারি লির দেখানো পথে স্বাগত জানাবেন ২০২৫ সালকে।
ঘটনার শুরু মূলত ২০২৩ সাল থেকে। ফেইসবুকে এক পোস্ট দিয়ে হ্যারি লি মানুষকে তাইপের দা’আন ফরেস্ট পার্কে নববর্ষের আগের রাতে জড়ো হয়ে আধা ঘণ্টার জন্য কান্নার আহ্বান জানান। তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত তাইওয়ানের বিখ্যাত সিনেমা ‘ভিভ ল’অমুর’ এর একটি দৃশ্যকে স্মরণ করানো।
ওই সিনেমাটি নির্মাণ করেন মালয়েশিয়ায় জন্ম নেওয়া ও তাইওয়ানে বসবাসরত চলচ্চিত্র পরিচালক সাই মিং লিয়াং। ১৯৯৪ সালে এটি ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শীর্ষ পুরস্কার অর্জন করে। সিনেমাটি শহুরে তিন তরুণের একঘেয়েমি, নিঃসঙ্গতা ও হতাশার গল্প নিয়ে। ১৯৯০ এর দশকে তাইপের দ্রুত আধুনিকায়ন ও পরিবর্তনের সময়কার শহুরে জীবনের বাস্তবতার চিত্র ওই সিনেমায় জায়গা পায়।
সিনেমার যে দৃশ্যটি হ্যারিকে এই অনুষ্ঠানটি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে, সেখানে নারী চরিত্রটি দা’আন ফরেস্ট পার্কের একটি বেঞ্চে বসে সাত মিনিট ধরে অবিরাম কাঁদে। এরপর সে একটি সিগারেট জ্বালিয়ে নিস্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মজার ছলে শুরু হওয়া ওই অনুষ্ঠান দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। প্রায় ১৬ হাজার মানুষ হ্যারির নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনেকেই পার্কে এসে কান্না, হাসি, পানীয়, গান, নাচ, কথা বলা ও মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর ফলে ফ্ল্যাশমব স্টাইলের এই সমাবেশ ২০২৪ সালকে স্বাগত জানাতে একটি জাকালো প্রদর্শনীতে পরিণত হয়।
সিএনএনকে এবিষয়ে হ্যারি বলেন, “কখনো ভাবিনি এত মানুষ জড়ো হবে। এটি যে ভাইরাল হবে তাও কখনো ভাবিনি।”
হ্যারি এ বছরও অনুষ্ঠানটি আয়োজন করছেন। সেখানে এরই মধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাইওয়ান ফিল্ম অ্যান্ড অডিওভিজ্যুয়াল ইনস্টিটিউটও। তারা পার্কে ‘ভিভ ল’অমুর’ সিনেমার একটি উন্মুক্ত প্রদর্শনী আয়োজন করেছে। সেখানে সিনেমার মূল শিল্পীরা উপস্থিত হয়ে ২০২৪ সালকে বিদায় জানাবেন।
“আমি এক প্যাকেট টিসু শেষ করে ফেলেছি।”
২০২৪ সালকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিল সিএনএন।
তাদের বয়ানে, সেদিন অংশগ্রহণকারীরা খাবার ও পানীয় শেয়ার করে। কেউ সঙ্গীত বাজিয়ে, ড্রামের তালে নাচছিল। অন্যরা কান্নাকাটির সেলফি তুলছিল। কিছু মানুষ বেঞ্চে বসে মুহূর্ত উদযাপন করছিল।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অ্যাস্টার চ্যাং ফেসবুকে লেখেন, “আমি সত্যিই কাঁদলাম! এই বছর যে সব খারাপ ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটেছে, সেগুলো মন থেকে বের করতে গিয়ে এক প্যাকেট টিসু শেষ করে ফেলেছি।”
২৬ বছর বয়সী চেন চু ইউয়ান সেবছর প্রয়াত বন্ধুর স্মরণে পার্কে বসে ক’ফোটা অশ্রু ফেলেন। কেঁদে তার ভালো লেগেছিল, কারণ তার কান্না দেখে অন্যরা তাকে সেদিন সান্তনা জানিয়েছিল। তাই এবারও তিনি কাঁদতে ওই পার্কে যাবেন।
চেনের মনে হয়েছে, বহু মানুষ মিলিত হয়ে যখন গল্প করে তখন এর গভীর প্রভাব সবার উপরেই পরে।
কিছুই যায় আসে না
তাইপের লোকজন মনে করেন, হ্যারির অনুষ্ঠানের গভীর প্রভাব রয়েছে মানুষের জীবনে। নববর্ষের অনূষ্ঠানে সবাইকে যে হাসি মুখেই থাকতে হবে, এমন ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে হ্যারির অনুষ্ঠান।
নববর্ষের অনুষ্ঠানে যে সবাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোর করেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন না। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, বহু মানুষ এমন উৎসবমুখর দিনগুলোতে একাকী অনুভব করেন। বিশেষত সোশাল মিডিয়ার প্রভাবের কারণে এমনটা হয়। এসব মানুষের জন্য হ্যারির অনুষ্ঠানটিকে অনেকেই ব্যতিক্রমী বলেও মনে করেন।
তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির জেন্ডার ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাং টিং-ইউর মতে, “অবিরত সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে অন্যদের সঙ্গে ঈর্ষা ও তুলনার মতো নেতিবাচক আবেগের প্রভাব পড়ে।” তিনি মনে করেন এই কারণেই হ্যারির অনুষ্ঠানটি সাড়া তুলেছে। কান্নাও যে মানুষের আবেগ প্রকাশের একটি মাধ্যম, তা আবার সামনে এসেছে অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
বিশ্বব্যাপী এখন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তাইওয়ানে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রতি চারজনের একজন দুঃখ বা উদ্বেগের লক্ষণ প্রকাশ করেছেন। এমনটা অন্যান্য বয়সীদের তুলনায় সর্বোচ্চ।
ওই গবেষণার পর তাইওয়ান ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের জন্য একটি বিনামূল্যের কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম চালু করে। পরে এটি ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্যও সম্প্রসারিত হয়।
নভেম্বরের শেষ দিকে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি কমিটির বৈঠকে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে বলেন, “একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল ও দ্রুত গতির সমাজে, সরকারের মানসিক স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি সম্পদ বিনিয়োগ করা উচিত, যাতে জনগণের সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।”
ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য গবেষক অধ্যাপক চাং শু-সেনের মতে, “হ্যারির অনুষ্ঠানটি তাইওয়ানের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বাড়তি মনোযোগের প্রতিফলন। এটি একটি ইতিবাচক উন্নয়ন।
“মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, মানুষের জন্য সহায়তা চাওয়ার এবং অন্যদের সাহায্য করার উপায়ও প্রয়োজন।”
আর এনিয়ে হ্যারিও খুশি। কারণ তার অনুষ্ঠান বহু মানুষকে চাপমুক্ত হতে সহায়তা করছে।
তাইতো নববর্ষের বার্তা হিসেবে হ্যারি বলেন, “যারা পার্কে এসে সত্যিই কাঁদলেন, আমি আশা করি তারা আগামী বছর আর কাঁদবেন না। একটি সুখী নববর্ষের রাত উপভোগ করবেন।”