“আমরা তিনভাই একই বিছানায় ঘুমাইতাম। আমি থাকতাম মাঝখানে আর একপাশে রাখতাম বিজয়রে, আরেক পাশে থাকতো মুসা। আমারে রাইখা ওরা দুইজন এখন কবরে ঘুমাইতেছে।”
নিজের ছোট দুই ভাইকে নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিল ১৭ বছরের কিশোর আসাদুজ্জামান জয়। গত ১৬ নভেম্বর শনিবার ঢাকার পল্লবীর বাইগারটেক এলাকায় বাবার হাতে নিহত দুই শিশু বিজয় (৭) ও মুসার (৪) বড় ভাই সে।
পুলিশের ধারণা, পারিবারিক অশান্তি ও অভাব-অনটনের কারণে শিশু দুটিকে হত্যার পর তাদের বাবা মো. আহাদ (৫০) আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গুরুতর আহত আহাদ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ জানিয়েছে, মানিকদির একটি ভবনে নৈশপ্রহরীর চাকরি করেন আহাদ। এখন পর্যন্ত তার তিনটি বিয়ের খবর পাওয়া গেছে। বিজয় ও মুসা তার ছোট স্ত্রী রোজিনা ইসলামের সন্তান। রোজিনার দ্বিতীয় বিয়ে এটা। তার প্রথম পক্ষের সন্তান আসাদুজ্জামান জয়। রোজিনা একটি মেসে রান্নার কাজ করেন।
বুধবার দুপুরে বাইগারটেক এলাকায় তাদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, যে ঘরে বিজয় ও মুসাকে হত্যা করা হয়েছে সেই ঘরে বসেই তসবি গুনছে কিশোর আসাদুজ্জামান। পাশের ঘরে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন বিজয় ও মুসার মা রোজিনা বেগম, নানা জোবেদ আলীআর নানী আয়েশা বেগম। ঘরের কোণায় টেবিলে রাখা ব্যাগভর্তি জিলাপি। স্থানীয় মসজিদে আসরের নামাজের পর মিলাদ উপলক্ষে কেনা হয়েছে সেগুলো।
মিলাদের সেই জিলাপি দেখিয়ে আসাদুজ্জামান জয় বলে, “মুসা মিষ্টি খুব পছন্দ করতো। আমার কাছে প্রায়ই চকলেট-মিষ্টির আবদার করতো। এত জিলাপি একসঙ্গে দেখলে খুব খুশি হতো মুসা।”
গত ১৬ নভেম্বর শনিবার সকালে বিজয় ও মুসা যখন বাবার হাতে হত্যার শিকার হয় তখন বাসায়ই ছিলেন তাদের নানা ৭৫ বছর বয়সী জোবেদ আলী। ১২ বছর আগে কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যাওয়ায় বিছানাতেই জীবন কাটছে তার। ঘটনার তিনদিন আগে স্ত্রী আয়েশাকে নিয়ে নেত্রকোণার পূর্বধলা থেকে ঢাকায় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি।
জোবেদ আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাপে গরুর মাথা কিনছে দেখে বড় নাতি (বিজয়) আমারে ফোন দিয়ে কইলো ‘নানা বেড়াইতে আস, তোমারে গরুর মাথা খাওয়ামু।’ সেই নাতিডা আমার আর নাই।”
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জোবেদ আলী বলেন, “নাইট ডিউটি শেষে শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিক বাসায় আসছিল আহাদ। সে সময় সবাই আমরা শুয়া ছিলাম। আইসা রোজিনারে ডাইকা জিগাইলো ‘কামে যাইবা না? শরীর খারাপ থাকায় রোজিনা কামে যাইতে চায়নি।
“হেই সময় আহাদই কইলো ‘তুমি কামে না গেলে এতগুলা লোক কী খাইবো? পরে শাশুড়িরে কইলো, ‘আম্মা আপনে রোজিনার লগে যান, হেরে একটু কোটা-বাছা করে আগায়া দেন।’ আহাদের এই কথা শুইনা আমার মেয়ে আর স্ত্রী কামে গেল।”
তিনি বলেন, “এরপর সকাল ৯টার দিকে দুই পোলারে সঙ্গে নিয়া ঘর থাইক্যা বাহির হয় সে। কিছুক্ষণ পর পাউরুটি আর চিপস নিয়া ঘরে ঢুকলো। একটু পর আমার ঘরে আইসা কইলো ‘আব্বা আপনার নাতিরাতো রুটি খাইয়া ফেলছে, আপনে চিপস খান।’ হের কথা শুইনা আমি হাসতে হাসতে কইলাম ‘দুরু বেটা- আমার কী চিপস খাওয়ার বয়স আছে’।
“এরপর আবারও পোলাপানগো রুমে গেল সে। একটু পর আবার এই রুমে আইয়া আমার সামনে সিগারেট টানলো। আমার মেয়ের সঙ্গে ৮ বছর বিয়া হইছে, কিন্তু কোনোদিনও আমার সামনে সিগারেট টানেনি’। হেইদিন সিগারেট টানা দেইখ্যা আমি মনে মনে ভাবলাম আহাদ কী বেয়াদপ হইয়া গেল? সিগারেট টানা শেষ কইরা আবারও পোলাপানের ঘরে ঢুকে সে।”
জোবেদ আলী বলেন, “একটু পর বড় নাতির চিৎকার শুনলাম। এক চিৎকারের পর আর কোনও শব্দ পাই না। এর লাইগ্যা কী হইলো দেখতে আমি ছেঁচড়ায়া বিছনা থাইক্যা নাইম্যা ঘরের দরজায় ঠেলা দিয়া দেখি কাটা গলায় নিয়ে বিছনায় দুই নাতি পইড়া রইছে। আর আহাদ ছুরি দিয়া নিজের গলায় পোচ দিতাছে।
“এই অবস্থা দেইখ্যা আমি ছ্যাঁচড়ায়া বাসার বাইরে গিয়া চিৎকার শুরু করি। আমার চিৎকার শুইনা সামনের বাড়ির দুই মহিলা দৌড়ায়া আসে। হেরা আসার পর ঘরে ঢুইক্যা দেখি আহাদও বিছানায় পইড়া আছে। এই অবস্থা দেইখ্যা ওই মহিলারাও চিৎকার শুরু করে। হেরপর মেলা মানুষ জড়ো হয়।”
বিজয় ও মুসার নানা বলেন, “কিন্তু মানুষজন আইয়া কেউ আমার নাতি আর জামাইয়ের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। হেরা পুলিশরে খবর দেয়। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ আইসা আহাদের গায়ে হাত দিয়ে কয় ‘এইডা তো ব্যাঁইচ্যা আছে।’ হেরপর আহাদরে হাসপাতালে নিয়া যায় পুলিশ।”
বাইগারটেক এলাকায় হক সাহেব হিসেবে পরিচিত একজনের অফিসের পেছনে তিনতলা একটি বাড়ির নিচতলায় সাত বছর ধরে ভাড়া আছেন আহাদ। পাশাপাশি ছোট্ট দুই কক্ষের এই বাসার ভাড়া মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
বিজয় ও মুসাকে যে ঘরে হত্যা করা হয় সেই ঘরে একটি খাট ও বাক্স রাখার পর আর জায়গা নেই। আরেক ঘরের এক পাশে গাদাগাদি করে রান্নাঘর ও টয়লেট।
দুই ছেলেকে হারিয়ে যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেছেন রোজিনা ইসলাম।
ক্ষীণ কণ্ঠে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আহাদের আগের বিয়ার খবর আমি জানি। এমনকি আগের ঘরে দুই ছেলে ও এক মেয়ে আমার কাছে থাইক্যাই বড় হয়েছে। তারা বিয়ে করে এখন অন্য খানে থাকে।
পারিবারিক অশান্তি ও অভাব-অনটনের কারণে শিশু দুটিকে হত্যার পর তাদের বাবা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোজিনা ইসলাম বলেন, “আমার ঘরে কোনও অশান্তি আছিল না। তয় ৩ লাখ টাকার মতো ঋণ আছিল আহাদের। এর মধ্যে কিছু আছিল দোকান বাকি, কারও কাছ থেকে সুদে ধার নিছিল। ধারের টাকার জন্য প্রায় প্রতিদিনই বাড়িত মানুষ আসতো।
“কেউ আইসা বলতো মাছে টাকা পায়, কেউ কয় চালের টাকা পায়। ঘটনার আগে মঙ্গলবারও ৬-৭ জন মানুষ আসছিল টাকা নেওয়ার জন্য। আমার দুই পোলার জীবন যাওয়ার পর আর কেউ আসে না টাকার জন্য।”
প্রতি কোরবানির ঈদে আহাদ মৌসুমি কসাই হিসেবে কাজ করতে জানিয়ে রোজিনা বলেন, “কোরবানির গরু জবাইয়ের চাকু আছিল আমার ঘরে। সেই চাকু দিয়াই পোলা দুইটারে জবাই করছে, হেরপর নিজেরও গলা কাটছে। ঘটনার পর পুলিশ সেই চাকু, আমার মোবাইল নিয়া গেছে।”
রোজিনার সঙ্গে কথা বলার সময়ই তাদের ঘরে আসে প্রতিবেশী শিশু মোহাম্মদ আলী। বিজয় আর মুসার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, “মুসা তো ছোট ছিল। তাই ঘরেই থাকতো বেশি। কিন্তু বিজয়রে সবাই চেনে এই এলাকার। আমরা সারাদিন পুরা এলাকায় একসঙ্গে ঘুরা বেড়াইতাম।”
বিজয় ও মুসাকে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে স্থানীয় হক সাহেবের কবরস্থানে। দুই ভাইয়ের সেই কবর দেখাতে এই প্রতিবেদককে কবরস্থানে নিয়ে যায় কিশোর আসাদুজ্জামান জয়। পরে দুই ভাইয়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করে সে।
দুই ছেলেকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যার ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আদিল হোসেন জানান, এই ঘটনায় আহাদকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেছেন তার স্ত্রী রোজিনা। আহাদ গ্রেপ্তার অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
আহাদ একাধিক বিয়ে করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা তার তিনটি বিয়ের সংবাদ জানতে পেরেছি। নিম্নআয়ের মানুষ হওয়ায় বাসার আশপাশের দোকানগুলোতে বেশ কিছু টাকা বাকি পড়েছিল তার। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও আহাদের কাছে টাকা পাওনা ছিল।”
পরিদর্শক আদিল বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, পারিবারিক অশান্তি ও অভাব-অনটনের কারণে নির্মম এই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।”