বন্ধু, স্বজন এবং প্রিয়জন সঙ্গে না নিয়েই কোথাও ঘুরতে চলে গেছেন? আপনার এমন ঘোরাঘুরি দেখে কেউ কেউ এতে ভ্রুকুটি করতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পর্ক মজবুত রাখতে এবং নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে মাঝে মাঝে এমন ‘একলা চলো রে’ ভ্রমণ খুব কাজে দেয়।
আপনি বিবাহিত জীবনে সুখী। দুই সন্তানও আছে আপনার। ছুটি মানে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন পরিবার নিয়ে। এমন গল্প কম-বেশি সবারই।
নিশ্চয়ই আপনি কাউকে কাউকে বলতে শুনেছেন, যখন বিয়ে করিনি, একা ছিলাম তখনই আসলে আনন্দে কাটিয়েছি। এখন তো সব কিছু বদলে গেছে। এখন আমি বিবাহিত। আমার বাচ্চা আছে।
তাদের জন্যই ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন বলছে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হওয়া অথবা পরিবার বড় হতে থাকার অর্থ হলো নিজের দিকে মনোযোগ কমে আসে ক্রমশ। পরিবারের আরেকজনের চাহিদা এবং খুশির খেয়াল রাখাটাই মূল কথা হয়ে ওঠে; এমনকি নিজের ভালো লাগার কাজ ও সময়ে ছাড় দিয়ে হলেও। এই বাদ পড়ে যাওয়ার তালিকায় শুরুতেই থাকে কখনও নিজের মতো কোথাও ঘুরে আসার ভাবনা।
যদি ভেবেও থাকেন তা সমাজ তা আরও জটিল করে তোলে। বিয়ে এবং সন্তান হওয়ার পর একা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতে গেলেই অনেকে চোখ কপালে তুলে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করে বসবে। আপনি কীভাবে একা একা এভাবে আনন্দ করার কথা ভাবতে পারলেন? সন্তানদের রেখে ঘুরতে যেতে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে না? — আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সমাজ ও পরিবার থেকে এমন আরও অসংখ্য প্রশ্ন তোলা হবে আপনার উদ্দেশ্যে।
যেন চারিদিকে সব স্থবির হয়ে গেছে ধরে নিয়ে এবার মনোযোগ দিয়ে ভাবুন, সমাজের চোখে আদর্শ হতে গিয়ে আপনি কি নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশে পিছপা হচ্ছেন? অথবা আপনি না থাকলে পরিবার কীভাবে চলবে সেসব ভেবে ভয় পাচ্ছেন?
যদি এসব অস্বস্তি আপনাকে ঘিরে ধরে, তাহলে এখনই সময় এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার।
নিজের ভালো লাগাকে দাবিয়ে রাখা কোনোভাবেই ভালো উদাহরণ হয়ে দেখা দেবে না আপনার জন্য। যদি জীবনসঙ্গীর মন রক্ষা করতে প্রতিবার নিজের একা ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছেকে চেপে যান তবে এসব ঘটনা একদিন না একদিন দাম্পত্য সম্পর্কে নেতিবাচক ছাপ ফেলবে।
একা ঘুরতে যাওয়ার ভালো দিক
মেয়ে সন্তানের কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ভাবনায় ভারতীয় পরিবারের প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ টেনেছে ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন।
ধরা যাক, মেয়েটি তার বাবা-মাকে বলছে, আমি কি কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গোয়া যেতে পারি? অথবা মেয়েটি বাবা-মায়ের কাছে হয়ত এভাবেও বলতে পারে, আমি একা ঘুরতে যাচ্ছি; তোমরা কি কিছু টাকা দেবে আমাকে?
মেয়ে সন্তানের এসব প্রশ্নের একটিই ‘ক্লিশে’ উত্তর দিয়ে আসছে বাবা-মায়েরা–বিয়ের পর যেখানে খুশি ঘুরতে যাও, এর আগে না।
এক সময় সেই মেয়েটি বিয়ে করে। এবার তার জীবনে একজন চিরস্থায়ী ভ্রমণসঙ্গী আছে। তাহলে এই মেয়েটির কি একা একা অর্থাৎ নিজের মতো করে পৃথিবী ঘুরে দেখার সময় আসবে না কখনও?
পুরুষের চেয়ে নারীদেরই বেশি নিজের আকাঙ্ক্ষা এবং শখের গলা টিপে ধরতে হয়। কিন্তু নারী হোক অথবা পুরুষ, বিবাহিত বা অবিবাহিত, পেশা যাই হোক না কেন — প্রত্যেকেরই নিজের মতো করে একা ভ্রমণে বেরিয়ে দেখা দরকার।
মুম্বাই-ভিত্তিক কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট অ্যাবসি স্যাম মতে, একা ঘুরতে গেলে নিজের পছন্দের প্রতি নিজের খেয়াল করে দেখার সুযোগ হয়। যেমন, কোথাও গিয়ে নিজের কোনটা ভালো লাগছে, কোনটা তেমন টানছে না, কোথায় যেতে চান? এতে আত্মনির্ভরতা এবং স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব মজবুত হয়।
“ভারতীয় প্রেক্ষাপটে, সামাজিক চিন্তাধারায় আমরা ভাবতে জোর দেয়া হয়। বিয়ে ও সম্পর্ক রক্ষার বড় দায়িত্ব পালনে চাপ দেয়া হয়। এ কারণেই জীবনসঙ্গী থাকার পরও নিজের যত্নে, নিজেকে খুঁজে পেতে একা একা বেরিয়ে পড়ার বিকল্প নেই,” ইন্ডিয়া টুডেকে বলেন স্যাম।
দিল্লি-ভিত্তিক রিলেশনশিপ কাউন্সিলর রুচি রুহ মনে করেন, “স্বাস্থ্যকর সম্পর্কে দুজন ভিন্ন মানুষ যার যার ব্যক্তিত্বকে সাদরে স্বাগত জানিয়েই একত্রে থাকবে।”
মানসিক স্বাস্থ্যে একা একা ভ্রমণের দারুণ উপকারিতা আছে। অ্যাবসি স্যামের দৃষ্টিতে, ভারতীয় নারীরা নিজের মতো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
“এখানে স্বাধীনতা এবং নিজের প্রতি আস্থা গড়ে ওঠাই হলো আসল কথা।”
তাছাড়া একা ঘুরতে বার হলেই যে সঙ্গীর সঙ্গে দূরত্ব দেখা দিচ্ছে তা সত্যি নয়। বরং উল্টোটাই হবে; বিশ্বাস দৃঢ় হবে।
“সলো ট্র্যাভেলিংয়ের কারণে দুজনের মধ্যে একে অপরের পছন্দের প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা শুরু হবে; যা সম্পর্কের জন্য স্বাস্থ্যকর”, বললেন রুহ।
স্যাম বললেন, এতে করে ‘মি টাইম’ অর্থাৎ নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একে অন্যের কাছে জায়গা পাওয়া যায়। আর এই বোঝাপড়াই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।
অনেক সঙ্গীই যদিও এসবে ছাড় দিতে নারাজ থাকেন; ফলে একা ভ্রমণে যাওয়ার বাধা আসে।
এজন্য স্যামের পরামর্শ হচ্ছে, একেবারে মন খুলে আলাপ করতে হবে একে অন্যের সঙ্গে।
“অনেকে মনে করে একা যেতে দিলে সঙ্গী হয়তো এভাবে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে। যদি এমন ভয় থাকে তবে তাও খোলাখুলি বলা ভালো।”
সন্তান থাকলে কি একা ঘোরা মানা
ঘরে সন্তান থাকা মানেই নিজের মতো ঘোরার শখ বাদ দেয়া ঠিক হবে না। বরং কয়েকদিন আপনার অনুপস্থিতিতে সন্তানরা নিজেকে গুছিয়ে রাখতে বাকিদের সহায়তা নিতে অভ্যস্ত হতে শিখবে। তাছাড়া আপনাকে একা ঘুরতে দেখে ওরাও এই উদাহরণ বড় হয়ে নিজের বেলাতেও চর্চা করতে পারবে।
রুহ বলেন, “অভিভাবক হিসাবে নিজের মতো ঘুরেফিরে সতেজ হয়ে ফিরে আসার পর আপনি আরও ভালো ভাবে পরিবারকে সঙ্গ দিতে পারবেন।”
একা এবং পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়া
ঘুরতে যাওয়া নিয়ে চমৎকার পরিকল্পনা করে নিলে অনেক প্রশ্নের জট খুলে যাবে। নিজে যেমন একা ঘুরতে যাবেন কখনও, তেমনি পরিবার নিয়েও ঘুরতে যাবেন মাঝে মাঝে; অর্থাৎ একটি ভারসাম্য ধরে রাখতে হবে।
রুহ এবং স্যাম দুজনেরই পরামর্শ হচ্ছে, একবার একা ঘুরতে গেলে পরের বার পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। যদি একা যান, তবে গন্তব্য, কবে যাবেন. কেন যাবেন এসব নিয়ে আগে পরিবার ও প্রিয়জনের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে রাখুন।
এসব ভ্রমণের খরচ আপনার পকেটের সঙ্গে মানানসই কি না তা অবশ্যই হিসাব করে নিতে হবে আগে থেকে।
যদি একা ঘুরতে বেরিয়েই পড়েন, তবে সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগে থাকুন ফোন করে, ছবি পাঠিয়ে। আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন এসব ছোটখাটো খবর জানিয়ে রাখুন সঙ্গীকে।