Beta
বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

বাংলাদেশ জলসীমায় ‘দস্যুতা’ বাড়ছে কেন

SS-Piracy-incidents-on-the-rise-in-Bangladesh-261124
[publishpress_authors_box]

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় বিদেশি জাহাজে দস্যুতার ঘটনা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

তবে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবহারকারীরা।  

আর বন্দর ব্যবহারকারী অনেকের অভিযোগ, জলসীমা বাড়ার পর তদারকির জন্য বাড়তি জনবল নেই, যা এ ধরনের ঘটনার বড় কারণ। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করা চট্টগ্রাম বন্দর, নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ড দলের মধ্যে সমন্বহীনতার বিষয়টি নিয়েও অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনা ছোট হলেও এ ধরনের ঘটনায় বিপাকে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন শিপিং ব্যবসায়ীরা।   

রিক্যাপের প্রতিবেদন বাড়িয়েছে উদ্বেগ

এশিয়ায় জাহাজে চুরি-ডাকাতি ও দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা রিক্যাপ তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশের জলসীমায় দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১১টি। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

সম্মিলিত উদ্যোগে বিশেষ কিছু কৌশল নেওয়ায় ২০১৯ সাল থেকেই বাংলাদেশ জলসীমায় ধাপে ধাপে দস্যুতার ঘটনা কমে আসছিল। আর ২০২৩ সালে একবছরে মাত্র একটি ঘটনা রেকর্ড করেছিল রিক্যাপ। এতে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই সুনাম বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ।

২০২৪ সালের শুরু থেকেই সেই সুনামে ছেদ পড়ে। জানুয়ারি থেকে একটি একটি করে বাড়ছিল দস্যুতার ঘটনা। আর জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিক্যাপের হিসাবে দস্যুতার ঘটনা হয়েছে ১০টি। অক্টোবরে যোগ হয়েছে আরও একটি। নভেম্বরের হিসাব এখনও দেয়নি সংস্থাটি। তাদের হিসাবেই ১০ মাসে ১১টি ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ মাসে একটির বেশি ঘটনা ঘটেছে।

রিক্যাপের হিসাবে, ২০১০ সালেই বাংলাদেশের জলসীমায় সবচেয়ে বেশি ২৪টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিল। কমতে কমতে ২০১৩ সালে সেটি ৬টিতে নেমেছিল। ২০১৪ সালে আবারও বেড়ে ১৬টিতে উঠেছিল। ২০১৮ সালে সেটি ১১টিতে নামে। ২০১৯ সালে সেটি শূন্যের কোটায় নামায় সাফল্য দেখিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। এরপর ২০২১ সাল ঘটনাশূন্য ছিল। মাঝখানে ২০২০ সালে ৫টি, ২০২২ সালে ৫টি ঘটনা রেকর্ড করেছিল রিক্যাপ। এরপর ২০২৩ সালে মাত্র একটি ঘটনা তালিকাভুক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ইন্দোনেশিয়া কিংবা সোমালিয়া উপকূলে যেভাবে দস্যুতার ঘটনা ঘটে, বাংলাদেশ জলসীমায় কিন্তু সেই ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। জাহাজে থাকা নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল বা প্রয়োগ এখানে হয়নি।

বঙ্গোপসাগরে বিদেশি জাহাজ থেকে মূলত মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে দস্যুরা। সোমালিয়ার তুলনায় এই ঘটনা খুবই ছোট। কিন্তু এই ছোট ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য একাধিকবার বড় বিপদ হয়ে এসেছিল।

দস্যুতা বাড়ার মাশুল বাংলাদেশকে গুনতে হয়েছিল ২০১০ সালে; বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের। বিদেশে সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের। ২০২৪ সালে দস্যুতার ঘটনা বাড়ায় নতুন করেই সেই উদ্বেগ বাড়ছে।  

প্রতিবেদনে কী বলা আছে

গত সপ্তাহে রিক্যাপ প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে শুধু বাংলাদেশ জলসীমায় মোট ১১টি দস্যুতার ঘটনার খবর মিলেছে। এরমধ্যে সাতটি ঘটনা ঘটেছে; তিনটি ঘটনা দস্যুতার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আর ১১টির মধ্যে একটি ঘটেছে মোংলার হিরণ পয়েন্টে। বাকি ১০টির মধ্যে চারটি ঘটেছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে, ছয়টি ঘটেছে কুতুবদিয়া এলাকার গভীর সাগরে।

ঘটনার সময় বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯০ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে রাতের বেলায়। ১০ শতাংশ দিনের বেলায়। আর রাতের বেলায় যে সময়ে চাঁদের আলো থাকে, সেই সময়কেই উপযুক্ত সময় বলে বেছে নিয়েছে দস্যুরা।

প্রতিবেদন মতে, চারটি ট্যাংকার, তিনটি কন্টেইনার জাহাজ, দুটি খোলা পণ্যবাহী জাহাজ এবং একটি সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। তবে একটিও ক্যাটাগরি-১ এর মতো বিপদজ্জনক ঘটনা নেই; যেটাকে মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনার সাথে তুলনা করা হয়। ক্যাটাগরি-১ এ জাহাজে থাকা নাবিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। কিন্তু ক্যাটাগরি-২ এ চুরির উদ্দেশ্যেই এই দস্যুতার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ জলসীমায় দস্যুতার ঘটনাগুলো ২,৩,৪ ক্যাটাগরির।

রিক্যাপ রিপোর্টে, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৪টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে শীর্ষে ছিল স্ট্রেইট অফ মালাক্কা এবং সিঙ্গাপুর প্রণালীতে, যেখানে ৩৪টি ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয়স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়াতে ১৬টি আর বাংলাদেশে ঘটেছে ১০টি। ভারতে ঘটেচে দুটি। ফিলিপাইনসে দুটি, মালয়েশিয়াতে একটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে।

দস্যুতা বাড়লে কী ক্ষতি

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, দেশের বহির্নোঙর ও জলসীমায় আসা জাহাজে চুরি-দস্যুতা-ডাকাতির ঘটনা বাড়লে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্য পরিবহনে বাড়তি জাহাজ ভাড়া আরোপ করে বিদেশি জাহাজ মালিক ও শিপিং লাইনগুলো। বাংলাদেশগামী জাহাজ ভাড়া নিতে গেলে বাড়তি ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম দিতে হয়। এতে বিপাকে পড়তে হয় আমদানিকারকদের। আর বাংলাদেশগামী রুটে জাহাজ ভাড়া দিতে অনীহা দেখায় বিদেশি জাহাজ মালিকরা।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশ্ব প্রেক্ষিত চিন্তা করলে বাংলাদেশ জলসীমায় জাহাজে যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো একেবারেই ছোট। সেগুলোকে আমরা মোটাদাগে পাইরেসি বা দস্যুতা বলতে পারি না, বড়জোর চুরি বলতে পারি।

“কিন্তু এমন ছোট্ট ঘটনায়ও আমাদের বিপাকে পড়তে হয়েছিল। কারণ, পণ্য আনতে আমাদের জাহাজ ভাড়া করতে হয় বিদেশি কোম্পানি থেকে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ থাকলে এর নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই দেশে পড়ে। জাহাজ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়, ইনস্যুরেন্সে বাড়তি প্রিমিয়াম দিতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জাহাজ মালিকরা এই রুটে ভাড়া দিতে আগ্রহ দেখায় না। ২০১০ সালে এমন বিপদে আমরা পড়েছিলাম।”

বাড়তি জলসীমার নিরাপত্তাই বড় চ্যালেঞ্জ

বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমা এখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কক্সবাজারের সোনাদিয়া পর্যন্ত ৫০ নটিক্যাল মাইল; সেই বিশাল সীমানার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে চট্টগ্রাম বন্দর, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড দল। বন্দরে এখন পণ্য নিয়ে বছরে জাহাজ আসে চার হাজারের বেশি। সে হিসাবে এতগুলো জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় খুবই জরুরি।

দেশের জলসীমার উপকূল থেকে সাগরের দিকে ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকা পর্যন্ত নজরদারি করে কোস্টগার্ড। আর ১২ নটিক্যাল মাইলের পর থেকে দেশের সমুদ্রসীমানা পর্যন্ত নজরদারি করে নৌবাহিনী।

আর চট্টগ্রাম বন্দরের মূল ভবনে থাকা ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা ভিটিএমআইএসের মাধ্যমে জলসীমায় থাকা জাহাজগুলোর সরাসরি তদারক করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

কোনও জাহাজ দস্যুতার কবলে পড়লে সেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষেই অবহিত করেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড নিজেদের দ্রুতগতির জাহাজ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে। অবশ্য বন্দর নিজেও তদারকি করে অনেক সময়।

কিন্তু দস্যুতা বাড়লে দায়টা সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর বর্তায়। ফলে সমন্বয় ও তদারকির কাজটি বন্দরকেই বেশি সজাগের সঙ্গে করতে হয়। জলসীমার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এখন বন্দর বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে।

রিক্যাপ রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত যে ১১টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে; তার মধ্যে চারটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে, আর পাঁচটি ঘটেছে কুতুবদিয়া এলাকার গভীর সাগরে। অর্থাৎ কুতুবদিয়া এলাকার সাগরে দস্যুতার ঘটনা বাড়ছে।

২০২২ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা সাড়ে সাত নটিক্যাল মাইল থেকে বেড়ে ৫০ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত হয়েছে। বহির্নোঙরে সাগরের সীমানা সীতাকুণ্ড থেকে বেড়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়া হয়ে সোনাদিয়া পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে পুরো জলসীমা চুরি-দস্যুতামুক্ত রাখা বন্দরের জন্য এখন নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুফল ধরে রাখা যাচ্ছে না কেন

আগে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলেও ২০২২ সালে একটি কৌশল নেওয়ায় দস্যুতা প্রতিরোধে সফলতা এসেছিল।

বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশ করেই বন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবহিত করলেই আগে সেটি তালিকাভুক্ত হতো। বিষয়গুলো যাচাই করতে গিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ দেখল অন্যদেশে ঘটা পাইরেসি বাংলাদেশে এসে রেকর্ড হচ্ছে। ফলে দোষটা বাংলাদেশের ওপর পড়ত।

নতুন নিয়মে যেকোনো বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজে চুরির ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও ফুটেজ প্রমাণসহ তা বন্দরকে অবহিত করতে হচ্ছে। এরপর কোস্ট গার্ড তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়ার পরই সেই অভিযোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট অ্যান্ড শিপিং ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি বা আইএসপিএসের কমপ্লায়েন্স অনুযায়ী এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেউ মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে না। সেই কৌশলের সাফল্য বেশ কয়েক বছর থাকলেও সেটি ধরে রাখা যাচ্ছে না।

তাহলে কী সমন্বয়ের অভাব আছে—এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “না, সমন্বয়ের অভাব নেই। আমরা তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়েই সাগরে দস্যুতা প্রতিরোধে কাজ করছি। আর যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো খুবই ছোট। এরপরও যাতে নতুন ঘটনা না ঘটে, তাতে আমরা নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছি।”

তবে বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক শিপিং ব্যবসায়ী বলেন, যে কৌশল প্রয়োগ হয়েছে, সেটি থাকলে কোনোভাবেই দস্যুতা ঘটে না। মূলত তিন সংস্থার মধ্যে এখন সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকট। এর ফলেই দস্যুতার ঘটনাগুলো সামলানো যাচ্ছে না। আর জলসীমা বাড়ার পর তদারকির জন্য বাড়তি জনবল নেই।

“ধরুন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকায় দস্যুতা ঘটছে; চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-আনোয়ারা থেকে সেখানে পৌঁছতেই তো অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে ঘটনা বাড়ছে। বড় কোনও জটিলতা তৈরির আগেই জরুরি বৈঠকে বসে গাফিলতি কার, তা পর্যালোচনা করা উচিত” বলেন এক ব্যবসায়ী।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত