Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সৌদি আরব কেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বৈঠকের আয়োজন করছে

রিয়াদে গত বছরের ২৩ অক্টোবরের এক সভায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
রিয়াদে গত বছরের ২৩ অক্টোবরের এক সভায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় কর্তকর্তাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক সংঘাত সমাধানে সফলভাবে মধ্যস্থতা করার সক্ষমতা ও কৃতিত্ব অর্জনের তাগিদেই সৌদি কর্তৃপক্ষ এই বৈঠকের আয়োজন করেছে।

অবশ্য বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ভবিষ্যতে গাজার যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় রিয়াদ নিজের শক্তি বাড়ানোর জন্যই মঙ্গলবার এই বৈঠকের আয়োজন করেছে। সৌদি আরব শুধু আয়োজকই নয়, এই বৈঠকের মধ্যস্থতাকারীও। আর এই মধ্যস্থতায় সৌদির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেবে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান।

বৈঠকের জায়গাটিকে অবশ্য ‘মোটামুটি উপযুক্ত’ বলেছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। এই বৈঠককে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবকে নতুন অর্থনৈতিক ভিত্তি দিতে চাইছেন ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে।

সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবি মনে করছেন, এই মুহূর্তে যুবরাজ সালমানের সঙ্গে ট্রাম্প ও পুতিন উভয়েরই ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরবের জন্য এই বৈঠক সম্মানজনক এবং এটি সৌদি আরবকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে শক্তিশালী করবে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরব ব্যাপক সংস্কারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই সংস্কারের মধ্যে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ‘নিরপেক্ষতার নীতি’ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, সৌদির ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এমন নীতি নেওয়া হয়েছে।

যুবরাজ চান এর মাধ্যমে সৌদি অর্থনীতি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অন্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাক। তিনি ইয়েমেনে দীর্ঘ যুদ্ধের পর হুতিদের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দিয়েছেন। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করছেন এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আর এই সবই করা হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সৌদি সম্পর্ক অটুট রেখে।

পুতিন ও ট্রাম্পের সঙ্গে সৌদি সম্পর্ক

সৌদি আরব শুধু আন্তর্জাতিক বক্সিং ম্যাচ ও সঙ্গীত উৎসব আয়োজনই করে না। বরং বিশ্ব শান্তির প্রচারক হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরতে চায়। এ কারণে দেশটি ত্রাণ সহায়তা দাতাদের সভা ও শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে।

২০২৩ সালের আগস্টে সৌদি আরব ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে এক শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে। সেখানে ৪০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। তবে রাশিয়া অংশ নেয়নি। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব ইউক্রেনকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

যুবরাজ সালমানের আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরব যখন আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ছিল, তখন ট্রাম্প তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

২০১৭ সালে ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য সৌদি আরবকে বেছে নেন, যা ছিল প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম।

২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরও সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। দেশটি ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনারের প্রতিষ্ঠানকে ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দেয় এবং সৌদি আরবে ট্রাম্প টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও ঘোষণা করে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশ ভালো। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে যুবরাজকে একঘরে করতে চেয়েছিল। তখন পুতিন তাকে ছেড়ে যাননি। ইউক্রেন অভিযানের পরও যুবরাজ পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।

তিনি বিশ্ব বাজারে তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে পুতিনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যান। এমনকি ২০২২ সালে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানালেও তিনি রাশিয়ার পক্ষ নেন এবং সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। 

২০২৩ সালে পুতিন সৌদি আরব সফর করেন। তিনি দেশটিকে ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান, যে জোট যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে।

২০১৭ সালে ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য সৌদি আরবকে বেছে নেন, যা ছিল প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম।

বিশ্ব রাজনীতির বিভক্ত পরিস্থিতিতে সৌদি আরব তার কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে লাভবান হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ বলেন, সম্প্রতি রাশিয়ার কারাগারে বন্দি থাকা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষক মার্ক ফোগেলের মুক্তিতে সৌদি যুবরাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একাধিক বন্দিবিনিময়ে মধ্যস্থতা করতে সফল হয়েছে। 

স্টিভ উইটকফ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে রিয়াদে যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর একদিন পরই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সহকারী ইউরি উশাকভ ও রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে যুবরাজের আলোচনা হওয়ার কথা ছিল।

মঙ্গলবারের আলোচনায় ইউক্রেন অংশ নিচ্ছে না। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে অবস্থান করছেন। তিনি জানিয়েছেন, সপ্তাহের শেষ দিকে তিনি সৌদি আরব সফর করবেন এবং সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন।

অন্যদিকে ইউরোপীয় নেতারা প্যারিসে বৈঠকে বসবেন। তারা সৌদি আরবে চলমান আলোচনার বিষয়ে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করবেন। ইউরোপকে এই বৈঠকে সরাসরি অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ইঙ্গিত যে, ইউরোপের নিরাপত্তা ভূমিকা হয়তো আর আগের মতো তাদের অগ্রাধিকারের বিষয় নয়।

গাজা পরিস্থিতির দিকে নজর 

সৌদি আরব দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তার ভূমিকা ব্যবহার করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশটি এক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ইস্যুটি হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই বিতর্কিত প্রস্তাব, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরামর্শ দেন এবং সেখানকার বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। 

এই মাসের শুরুতে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি প্রস্তাব দেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাকে পুনর্গঠন করে সেখানে বিলাসবহুল ‘রিভেরা’ স্টাইলের বাড়ি নির্মাণ করা হবে এবং গাজার ২০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে স্থায়ীভাবে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হবে।

আরব দেশগুলো দ্রুতই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সপ্তাহের শেষ দিকে সৌদি আরবে একটি সম্মেলন হবে। সেখানে ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিকল্প একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে এবং পরে সেটি তার সামনে উপস্থাপন করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, সৌদি আরব তা বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। এর ফলে দেশটি ওয়াশিংটনের সমানে নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারছে।

বাহরাইনের আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক হাসান আলহাসান বলেন, “সৌদি আরব শুক্রবার একটি ছোট আরব সম্মেলনের আয়োজন করবে। এতে দেশটি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ নিতে পারে এবং গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের অবস্থানের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির চেষ্টা করতে পারে।”

আগামী চার বছরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারেন। তবে তিনি নিজের আঞ্চলিক স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। কারণ ট্রাম্প সম্পর্কের বিনিময়ে নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের দাবি তুলতে পারেন। 

ট্রাম্প চান সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক। তবে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ রক্ষা করা যুবরাজ সালমানের জন্য রাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

এই মাসের শুরুতে সৌদি সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, “টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত শান্তি সম্ভব নয়, যদি ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত অধিকার না পায়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান প্রশাসনকে ইতোমধ্যে পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে।”

তথ্যসূত্র : সিএনএন

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত