গত নভেম্বরে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করার পর ক’দিন আগেই ঢাকার মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের নাম শিক্ষার্থীরা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ লিখে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এবার প্রধান ফটকে ঝুলিয়েছে ‘শাটডাউন’ আল্টিমেটাম। হুঁশিয়ার করে তারা বলেছে, কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও সেইভাবে প্রশাসনিক কাঠামো ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গঠন করতে; না হলে তারা আবারও সড়ক অবরোধে যাবে।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর কলেজের শিক্ষার্থীরা মহাখালীর আমতলীতে অবস্থান নিয়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। তারা মহাখালী লেভেল ক্রসিং অবরোধ করলে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। একটি ট্রেনে ঢিল ছুড়লে কয়েকজন যাত্রী আহতও হয়। পরের দিন আবারও তারা কর্মসূচি নিয়ে অবস্থান করে কলেজটির অভ্যন্তরে।
গত ৭ জানুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটকে নাম ফলকের স্থানে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা ব্যানার টানিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
এরপর ২৭ জানুয়ারি রাতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। এই সময়ের মধ্যে এর সুরাহা না হলে কমপ্লিট শাটডাউনের সঙ্গে ‘বারাসাত ব্যারিকেড’ কর্মসূচিতে ফেরত যাবে তারা।
তিতুমীরে এই হুঁশিয়ারি এমন সময় এল যখন আন্দোলন তুঙ্গে উঠায় সরকারি সাতটি বড় কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
এই সাত কলেজ হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ। শিক্ষক এক হাজারের বেশি।
নিয়মিত ক্লাস নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া, সময়মতো ফল প্রকাশ, সেশনজট কমানোসহ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রায় আট বছর আগে এসব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আনা হয়েছিল। কিন্তু আট বছরেও সব সমস্যার সমাধান হয়নি।
এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার জন্য শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক সংকট চরম। এছাড়াও নানা বিষয়ে অসেন্তাষ রয়েছে। এই কলেজগুলোতে দেরিতে পরীক্ষা এবং ফলও দেরিতে হয়। তাদের নেই ভালো লাইব্রেরি, নেই পরীক্ষাগারের প্রয়োজনীয় উপকরণ। পাঠ্যসূচি সম্পন্ন না করেই পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি থাকলেও অধীনস্ত সাত কলেজে বর্ষভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এসব বিষয় নিয়েই গত প্রায় আট বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে, এর সুরাহা না হয়নি। সেই কারণেই এবার আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে বলেই উল্লেখ করেছে আন্দোলনকারীরা।
তবে এই সাত কলেজের ভেতর থেকে অন্যদের পাশ কাটিয়ে কেন হঠাৎ করে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক কর্মসূচির দিকে গেল—তা জানতে কথা হয় ‘তিতুমীর ঐক্য’ প্ল্যাটফর্মের কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য আমিনুল ইসলাম।
২০২০-২১ শিক্ষা বর্ষের গণিত বিভাগের এই শিক্ষার্থী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিতুমীর কলেজকে এবারে সাত কলেজের জোট হিসেবে ধরা হচ্ছে, যেটা মূলত সত্যি নয়। তিতুমীর নিজেদের স্বার্থে অন্যদের আগেই আন্দোলন শুরু করেছে এবং তারা চলতি আন্দোলনে কখনোই এই জোটভিত্তিক ছিল না।
“গতবছর ২২ অগাস্ট থেকে আমাদের আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে, তখন অন্যরা ছিল না। বাকিদের আন্দোলন আরও পরে শুরু হয়। অন্তত ১৫ দিনের ব্যবধানে তারা আন্দোলন শুরু করে, আমাদের ডাকা হয়।”
“সেদিন ঢাকা কলেজের অডিটোরিয়ামে এ নিয়ে আলোচনা হয়। বিভিন্ন কলেজে থেকে প্রতিনিধিরা ছিলেন। কিন্তু তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, তাদের দাবি থেকে আমাদের দাবি বেশি যৌক্তিক, তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের মিল ছিল না, তাই সেখানে আমরা যাইনি।”
কোথায় মিল ছিল না—জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, “বাকি কলেজগুলোর অনেকগুলোই উচ্চ মাধ্যমিক রয়েছে, অনেকগুলোর পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, শিক্ষক নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে যেতে হলে উচ্চ মাধ্যমিক একটা বড় বাধা। আবার অনেক কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস শেষ হওয়ার পর সেখানে স্নাতকের ক্লাস শুরু হয়।
“কিন্তু সত্যি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে মিনিমাম একটা ক্রাইটেরিয়ার ভেতরে দিয়ে যেতে হবে। এক কাঠামোর ভেতর থাকতে হবে। এসব কারণে আমরা তাদের সঙ্গে যাইনি।”
“আমাদের যেহেতু পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, অলমোস্ট প্রায় সব শিক্ষক রয়েছে, তাই আমাদের দাবি যৌক্তিক মনে করে তাদের জোট থেকে আমরা সরে আসি।”
কিন্তু তাই বলে নিজেরাই নাম ফলকে বিশ্ববিদ্যালয় লেখাটা কতোটা যৌক্তিক—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিতুমীর কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সম্ভাবতা কতটুকু, সেটা দেখার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল।
“তারা এর ফিজিবিলিটি দেখবে; কিন্তু এতদিনেও সে কমিটি তাদের প্রতিবেদন দেয়নি, তারা দায়িত্ব পালন করেনি; যেখানে অন্য কলেজগুলোর জন্য গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা কমিটি কাজ করেনি মনে করে নিজেরা নাম ফলক বদলেছে।”
“এটা এক ধরনের প্রতিবাদও বলতে পারেন আপনি”, বলেন আমিনুল।
গত ৭ জানুয়ারি কলেজটির নাম ফলক বদলে দেয় শিক্ষার্থীরা। সেদিন আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী জানিয়েছিল, “তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের দাবিতে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটি আমাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে।
“তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা আমাদের কেন সাত কলেজের কমিটিতে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করল। ছয় কলেজ নিয়ে ওই কমিটি করতে পারত।”
নাম ফলক বদলালেই কি তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে—এ প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার (২৮ জানিুয়ারি) আমিনুল ইসলাম বলেন, “এজন্যই নতুন করে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম। আমরা এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। আর শাটডাউন বলে যে ব্যানার টাঙানো হয়েছে গেইটে, সেটা এই ঘোষণা না আসা পর্যন্ত থাকবে।”
এই প্রতিবাদে তিতুমীরের সাধারণ শিক্ষার্থ, শিক্ষকদের সমর্থন রয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তিতুমীর কলেজের সব ধরনের কাজ (আন্দোলনের কর্মসূচি) করার প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ‘তিতুমীর ঐক্য’। এখান থেকেই সব কিছু পরিচালিত হয় এবং আমাদের সঙ্গে শতকরা ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এবং অনেক শিক্ষক রয়েছেন।
“তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় কমপ্লিট শাটডাউনের পাশাপাশি আমরা ‘বারাসাত ব্যারিকেডে’ (সড়ক ও রেলপথ অবরোধ) ফেরত যাব।”
তিনি বলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইতোমধ্যেই ২০ ঘণ্টা চলে গিয়েছে। আরও সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার যদি এই ঘোষণাকে কনসার্নে না নেয়, তাহলে কঠোর কর্মসূচিতে যাব, বারাসাত ব্যারিকেডে যাব আমরা।”
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কলেজেরই এক সাধারণ শিক্ষার্থী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাত কলেজের সঙ্গে তারা (তিতুমীর কলেজ) থাকতে চাইছেন না, কারণ সেখানে তখন মুখ্য হয়ে যাবে ঢাকা কলেজ।
“বাকি ৬ কলেজের সাথে গেলে ঢাকা কলেজকে সেন্ট্রাল করবে, ওটা তাদের গায়ে লাগছে। এর জন্য তিতুমীর আলাদা হতে চায়। কারণ, তিতুমীরে অনেক স্টুডেন্ট।”
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, “যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই পড়াশোনা শেষ, ভিপি নির্বাচনের সুবিধার জন্য মাঝখানে আন্দোলন শুরু করে। আর তারপর ঝামেলা করে দুইভাগ হয়ে যায়।”
এদিকে মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) জানিয়েছে, সরকারি সাতটি বড় কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ জন্য ইউজিসির মাধ্যমে একটি কমিটি কাজ করছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে ইউজিসি এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকও করেছে।
ইউজিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, সাত কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়টি কেমন হবে, সেটির বিভিন্ন বিকল্প বা ‘মডেল’ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে; তবে এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি।