মশা কামড়ালে চুলকে স্বস্তি পাওয়ার সমাধানটাই অনেকের কাছে শেষ সমাধান। তবে কেউ কেউ সত্যিকার অর্থেই অন্য উপায় খোঁজেন। মশার কামড়ে সৃষ্টি লাল গোটায় হালকা চুলকানো অনেকের হয়তো ভালোও লাগে। কেউ কেউ আবার একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। বিশেষ করে শিশুরা।
ফুলে ওঠা জায়গায় অ্যাভোকাডো এবং বরফের মতো ঘরোয়া প্রতিকার সাময়িক স্বস্তি দেয়। তবে উপশমের জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে। সেই ব্যাপারে জানার আগে মশা কামড় দিলে কেন চুলকায়- সেটি জেনে নেওয়া ভালো।
মশার কামড়ে কেন চুলকায়
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. ক্যামেরন ওয়েব মশার কামড়ে চুলকানোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “স্ত্রী মশা তার শুঁড়ের মতো লম্বা নল দিয়ে আমাদের ত্বকে প্রোটিনের ককটেলযুক্ত লালা ঢুকিয়ে দেয়। এই প্রোটিনগুলোর মধ্যে রয়েছে- অ্যানাস্থেটিক, বা হালকা চেতনানাশক। ফলে কামড়ের বিষয়ে আমরা বেখবর থাকি। এছাড়াও মশা শরীরে অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ঢুকিয়ে দেয়- যা নির্দিষ্টস্থানের রক্ত পাতলা করে। এতে মশা অবাধে রক্ত চুষতে পারে। বাজে ব্যাপার হলো, আমাদের রক্ত তাকে লার্ভা তৈরিতে সাহায্য করে যাতে সে আরও বেশি মশা উৎপাদন করতে পারে।”
মশার লালা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহের ইমিউন সিস্টেম বহিরাগত শত্রুর অনুপ্রবেশ চিনতে পরে যুদ্ধ করার জন্য হিস্টামিন নির্গমন করে। সেটি মূলত চুলকানির কারণ।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট ডাঃ ক্যাট্রিওনা নগুয়েন-রবার্টসন বলছেন, এটি প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট পরে প্রদাহ বা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা দুই বা তিন দিন চলতে পারে। এই প্রতিক্রিয়া একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকম। ফুলের রেণু কিংবা চীনা বাদামের খোসার কারণে যেমন মানুষের অ্যালার্জির ভিন্নতা থাকে- অনেকটা সেইরকম।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মশা কোনও কোনও মানুষের ঠিক একই জায়গায় কামড়াচ্ছে। এটার সঠিক কারণ না জানা গেলেও, গবেষকরা মনে করেন ত্বকের রসায়ন এবং শরীরের গন্ধ এর পেছনে দায়ী।
মশা আমাদের শ্বাসের সঙ্গে ছাড়া তাপ এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডেও আকৃষ্ট হয়।
নুগুয়েন-রবার্টসন বলেছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হতে পারে। কেননা বারবার কামড়ের পরে মানুষের সংবেদনহীন হতে পারে। “বেশ অনেকক্ষণ কামড় খাওয়ার পর শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) সেটির প্রতি কম জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখায়”, বলেন নুগুয়েন-রবার্টসন।
যদি কেউ ঘোরাফেরার মধ্যে থাকে এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মশার কামড় খান তাহলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রফেসর ক্রেইগ উইলিয়ামস বলেন, “মশা কামড় দেওয়ার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় চুলকানো খুব স্বাভাবিক। এতে সাময়িক স্বস্তি এলেও এটি সমাধান নয়।”
চুলকানি কমাতে যা যা ব্যবহার হয়
অনলাইনে মশার কামড় থেকে উপশম পাওয়ার উপকরণ হিসেবে ‘ব্লু লাইট টেকনোলজি’ নামের একটি ডিভাইস বেশ পরিচিতি পেয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, কলমের মতো এই ডিভাইসের নীল আলো ও তাপ মশার কামডানোর পর চুলকানি থেকে রক্ষা করে। এছাড়া অ্যান্টি মশকিওটো বাইটিং টুল, অ্যান্টি ইচ জিপার এবং মশার লালা অপসারণের জন্য সাকশন টুলের প্রচারণাও কম নয়।
মশার চুলকানি কমাতে স্টিংগোজ স্প্রে এবং ক্যালামাইন লোশন বেশ জনপ্রিয়। জিঙ্ক অক্সাইডেও কেউ কেউ কাজ চালান। অন্যান্য বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিম এবং কুলিং মেন্থল সম্বলিত স্টপ ইচ।
ওয়েব বলেন, “যদিও জীবনযাত্রার এই ব্যয়-সংকটের সাথে, আমি জানি না মশার কামড়ের চিকিৎসার জন্য অ্যাভোকাডো ব্যবহার করা সর্বোত্তম উপায় কিনা।”
কীটতত্ত্ববিদ ওয়েব বলছেন, মেয়োনিজ এবং এসেনশিয়াল তেল থেকে শুরু করে কলা এবং অ্যাভোকাডোর নাম পর্যন্ত মশার কামড়ের চুলকানির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবহারের কথা শুনেছেন। এ সম্পর্কে তার মন্তব্যটি মজার, “পণ্য মূল্যস্ফীতির এই সময়ে, মশার কামড়ের চুলকানি উপশমে অ্যাভোকাডোর মতো দামি জিনিস ব্যবহার কতোটা ভালো উপায় তা সম্পর্কে আমি সন্দিহান।”
চুলকানি উপশমের উপায় হিসেবে লোকেরা মধু, ওটমিলের পেস্ট, বেকিং সোডা, তুলসি, থাইম, ভিনেগার, পেপারমিন্ট তেল, অ্যালোভেরা, পেঁয়াজ, রসুন, লেমন বাম এবং ক্যামোমাইল চা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন।
কোনও কোনও সময় তাদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রভাবের কারণে স্বস্তিও মিলতে পারে। ঠাণ্ডার কারণে ব্যবহার করা ভিক্স, শরীরে র্যাশ দূর করতে ব্যবহার হয়ে আসা ‘উইচ হ্যাজেল’ এবং টুথপেস্টও চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ওয়েব বলেছেন, “যদি এগুলো আপনার জন্য কাজ করে এবং ত্বকের জ্বালা সৃষ্টি না করে, তাহলে সম্ভবত এইগুলো ব্যববহার করে যাওয়াতে কোনও ক্ষতি নেই।”
তিনি বলেন, তাপ থেরাপি এবং বরফের কুচি ফুলে যাওয়া এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে চুলকানিও কিছুটা কমতে পারে। মশার কামড়ের ফলে যন্ত্রণা কমাতে গরম বা ঠান্ডা সেঁক, ধাতব চামচ (কুসুম গরম বা ঠান্ডা করে), কোল্ড প্যাক এবং সুগন্ধবিহীন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। যাদের খুব যন্ত্রণা পান তাদেরকে অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
যদি পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়
কামড়ের জায়গায় আঁচড় কাটলে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে এবং সংক্রমণ হতে পারে, যাকে সেলুলাইটিস বলা হয়। এর লক্ষণ হলো লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া এবং জ্বরের পাশাপাশি লালচে ভাব, কামড়ের জায়গায় উষ্ণ হয়ে ওঠা এবং পুঁজ জমা। যদি এমন হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কিছু লোকের মারাত্মক অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়াও হতে পারে – মুখ বা গলা ফুলে যাওয়া এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা – যার জন্য অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন।
চিকিৎসক উইলিয়ামস পরামর্শ দেন, মশার কামড়ের পর অন্যান্য উপসর্গ যেমন জয়েন্টে ব্যথা, ফুসকুড়ি, তীব্র মাথাব্যথা এবং অলসতার সঙ্গে জ্বর দেখা দিলে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা এগুলো উপসর্গ অন্য ব্যাধি- যেমন রস রিভার বা বারমাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ হতে পারে। এমনকি আরও ভয়াবহ ব্যাধি জাপানি বা মারে ভ্যালি এনসেফালাইটিসের ইঙ্গিত দিতে পারে।
প্রতিকার
নিরাপদ থাকতে, সর্বোত্তম পদক্ষেপ হলো প্রথমে কামড় এড়ানো।
মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ কেউ কীটতত্ত্ববিদ ওয়েবকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে- পোকামাকড় তাড়ানোর জন্য তারা কিছু খেতে বা পান করতে পারে কিনা। পানীয় পানে রক্ষা পাওয়ার কোন প্রমাণও নেই। বরং উল্টোটা আছে। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মদ খেলে বরং আপনি ‘ছোট ভ্যাম্পায়ার’দের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেন।
কীটতত্ত্ববিদ ওয়েব অবশ্য মজা করে বলছেন, “আপনি যত বেশি অ্যালকোহল পান করছেন, মশা তাড়ানোর স্প্রে লাগানোর কথা মনে রাখার সম্ভাবনা তত কম।”
(গার্ডিয়ান অবলম্বনে)