Beta
শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫

পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের মধুর সম্পর্ক কেন তিক্ত হচ্ছে

২-২১ সালে কাবুলে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি।
২-২১ সালে কাবুলে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি।
[publishpress_authors_box]

তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় ২০২১ সালের আগস্টে। সেই বিজয় উদযাপন করতে পরদিনই আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ।

আফগানিস্তানের তোরখাম সীমান্তে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, তালেবান দ্রুতই ‘নতুন জোট’ গঠন করবে এবং অঞ্চলটি বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ওই সংবাদ সম্মেলনের পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা আফগানদের জন্য ‘দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি’।

তালেবান ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায়। এসময় তাদের মোকাবেলা করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৪০টির বেশি দেশের জোট দেশটিতে সক্রিয় ছিল। তখন তালেবান নেতারা ও যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর কোয়েটা, পেশোয়ার ও করাচিতেও তালেবান নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা ও দপ্তর খোলে।

তালেবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরসহ অনেক তালেবান নেতা ও যোদ্ধা পাকিস্তানের ইসলামি ধর্মীয় বিদ্যালয়, বিশেষত দারুল উলুম হাক্কানিয়া থেকে শিক্ষালাভ করেন।

পাকিস্তানে তারা এমন একটি পরিবেশ পায়, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে তালেবান পুনর্গঠন ও ২০০৩ সালের দিকে শুরু হওয়া ভয়াবহ বিদ্রোহ পরিচালনা সহজ হয়। পাকিস্তানের সমর্থন ও আশ্রয় ছাড়া তালেবানের সফল বিদ্রোহ কার্যত অসম্ভব ছিল।

অথচ তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন ভালো না। এ সপ্তাহে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, মিত্র থেকে কীভাবে তারা শত্রুতে পরিণত হল।

ঐতিহাসিক ও বর্তমান কারণ

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাস বেশ জটিল। কাবুলে তালেবান সরকারকে পাকিস্তান তাদের প্রাকৃতিক মিত্র হিসেবে স্বাগত জানালেও, প্রত্যাশার তুলনায় তারা কম সহযোগিতা করছে। তালেবান সরকার জাতীয়তাবাদী বক্তব্য ব্যবহার করে বৃহত্তর আফগান সমাজের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি তারা একটি যোদ্ধা গোষ্ঠী থেকে কার্যকর সরকারে পরিণত হতে এবং পাকিস্তানের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমিয়ে বহুমুখী সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী।

আফগানিস্তান ও বর্তমানে পাকিস্তানের মধ্যে অঞ্চলের ও সম্প্রদায়ের বিভাজক হলে উপনিবেশিক যুগের সীমানা ‘ডুরান্ড লাইন’। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর কোনো আফগান রাষ্ট্রই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। ডুরান্ড লাইন আন্তর্জাতিকভাবে দুই দেশের সীমানা হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান প্রায় পুরোপুরি এটি ঘিরে রেখেছে। তবে আফগানিস্তানে ডুরান্ড লাইন একটি আবেগের বিষয়। কারণ এটি পাখতুনদের দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।

নব্বইয়ের দশকের তালেবান সরকার ডুরান্ড লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি। বর্তমান তালেবান শাসনও তার পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করছে। আর পাকিস্তানের জন্য এটি একটি সমস্যা। কারণ এই সীমানাকে তালেবান স্বীকৃতি না দিলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর সংঘাত মেটানো সহজ হবে না।

আফগানিস্তানে তালেবানের সফলতার পর সশস্ত্র বিদ্রোহের ক্ষেত্র পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও পুলিশ বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশের অবস্থা বেশি খারাপ।

অধিকাংশ হামলার দায়িত্ব নিয়েছে পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। বহু বছর ধরেই টিটিপি ও আফগান তালেবান পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তারা একে অপরকে আশ্রয়, কৌশল ও অর্থ ভাগাভাগি করত। বিশেষত ওয়াজিরিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে।

২০০১ সালের পর পাকিস্তান আফগান তালেবানকে ‘মিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তবর্তী পাখতুন জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা এবং আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান মাইকেল মুলেন বলেন, আফগান তালেবানের একটি প্রধান অংশ হাক্কানি নেটওয়ার্ক হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ‘অস্ত্র’।

বিশ্লেষকরা তখন বলেছিলেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে তালেবানকে পাকিস্তানের সহায়তা দেওয়া ‘পিরিক বিজয়’ তৈরি করবে। এর ফলে পাকিস্তানি যোদ্ধা গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সহিংস গেরিলা দলগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, দুর্বল হবে না।

পিরিক শব্দটি মূলত প্রাচীন গ্রিক রাজা পিরাস থেকে এসেছে। তিনি কিছু যুদ্ধ জিতলেও তার বাহিনীর এত বেশি ক্ষতি হয়েছিল যে, তিনি কোনো লাভবান হতে পারেননি। এখানে পিরিক বিজয় বলতে এমন একটি বিজয়কে বোঝানো হয় যা অনেক বড় মূল্য পরিশোধের পর অর্জিত হয়। এর ফলে বিজয়ী পক্ষের ক্ষতি এতটাই বেশি হয় যে, তারা মূল লক্ষ্য অর্জন করেও তার সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করতে পারে না।

উত্তেজনার তাৎপর্য ও প্রভাব

পাকিস্তান চাইছে আফগানিস্তান যেন সীমান্তবর্তী এলাকায় টিটিপি নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তালেবান সম্ভবত পাকিস্তানের কোনো দাবিই মানবে না। কারণ এমন পদক্ষেপ নিলে টিটিপির সঙ্গে আফগান তালেবানের সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হবে। একই সঙ্গে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশের (আইএসকেপি) মতো আরো চরমপন্থী গোষ্ঠীর সৃষ্টি করবে।

পাকিস্তান গত দুই দশক ধরে যে যুক্তি ব্যবহার করছে, আফগান তালেবান নেতারাও সেই একই যুক্তি দিচ্ছেন। তখন পাকিস্তান যেমন বলেছিল, তেমনি তালেবান এখন বলছে, টিটিপি পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং ইসলামাবাদকেই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত আফগানিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালিয়ে যাবে। সমস্যা হলো, এমন আক্রমণের আন্তর্জাতিক নজিরও বাড়ছে। ইসরায়েল যেমন নিরাপত্তার হুমকির কথা বলে সীমান্ত পেরিয়ে বিমান হামলা চালায়।

এদিকে বেলুচিস্তানে চীনা বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রকল্প রক্ষা করতে ব্যাপক চাপের মধ্যে আছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আফগান অঞ্চলে আক্রমণ করে পাকিস্তানের সরকার নিজের জনগণের কাছে ‘বিদেশি সমর্থিত শত্রু’ সম্পর্কে রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে।

এদিকে আফগান তালেবান সরকারের কাছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সম্পদ, সংগঠিত সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেই। গত মার্চে তালেবানের এক সামরিক নেতা জানান, যুক্তরাষ্ট্র আফগান আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। অর্থাৎ নিজেদের আকাশসীমাও তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

অবশ্য প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তালেবান নেতারা। তবে তারা কীভাবে পাকিস্তানের মতো সামরিক শক্তিধর প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন তা স্পষ্ট নয়। পাকিস্তান তালেবানের বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রভাবকেও বজায় রাখে। আফগানিস্তানে আসা অধিকাংশ বাণিজ্য পাকিস্তান হয়ে যায়। আর পাকিস্তান দশক ধরে কয়েক লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।

তবে পাকিস্তানের আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান আফগান জনগণের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব বাড়াবে এবং পাকিস্তানি পাখতুনদের আরও বিচ্ছিন্ন করবে বলে মনে করেন অনেকে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সমাজের ক্ষোভ, দারিদ্র্য ও যুবকদের হতাশার উপর ভিত্তি করে শক্তি পায়।

দীর্ঘমেয়াদি অসন্তোষ মোকাবেলায় উভয় দেশের নেতাদের সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। শক্তি প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হয়তো কিছু মুহূর্তের জন্য খবরের শিরোনাম হতে পারে, কিন্তু শান্তি অর্জন বুদ্ধি ও ধৈর্যের কাজ।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান অঞ্চলের অর্থনৈতিক একত্রীকরণ মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সংযোগ ঘটাতে পারে। যদিও এনিয়ে আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও দৃষ্টি নেই। এজন্য দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ৩০ কোটি মানুষের উন্নতি বাধাগ্রস্ত করছে।

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত