জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা যে ভয়াবহ সহিংসতা-সংঘর্ষ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ আর অগুনতি হতাহতের ঘটনা দেখেছি, এমনটা নিকট অতীত তো বটেই সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্য কোনও গণ-আন্দোলনে দেখা যায়নি। আর শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে রাজপথে এসব নৃশংসতার সবচেয়ে বড় শিকার ছিল আমাদের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীরা। ওইসব দিনগুলোতে কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা সংবাদমাধ্যমে ভয়ঙ্কর ওই সংঘাত-সহিংসতার ছবি-ভিডিও দেখেই কত শত মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এবার একবার ভাবুন তো, যে ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুণীরা সরাসরি এমন নৃশংসতার শিকার হয়েছে— যারা চোখের সামনে বন্ধু-সহযোদ্ধাকে নিহত হতে দেখেছে, আর আহতদের অসহায়ত্ব দেখেছে, তারা কতটা ভয়ঙ্কর মানসিক পরিস্থিতি পাড়ি দিয়েছে কিংবা এখনও দিচ্ছে?
যে কোনও ট্রমাটিক কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি ব্যক্তি যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনুভব করে; তখন তার আবেগ ও ভাবনায় সৃষ্টি হয় এক নেতিবাচক অবস্থান। সেই অবস্থায় তার স্মৃতিতে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া সেই নেতিবাচক মুহুর্তগুলো। ফলে সে পড়ে যায় মানসিক চাপে বা অস্বস্তিতে। যা তার দৈনন্দিন জীবন ও জীবনাচারকে করে বাধাগ্রস্ত।
ফলে ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠে নানান ধরনের আশঙ্কামূলক আচরণ। বিঘ্নিত হয় তার দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্ম ও স্বাভাবিক জীবন। যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়ে থাকে দুর্ঘটনাজনিত করণে সৃষ্ট আঘাত পরবর্তী মানসিক সমস্যা— ‘পিটিএসডি’ বা ‘পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজওর্ডার’ (Post Traumatic Stress Disorder/PTSD)।
এই সময়কালে ব্যক্তির মধ্যে দেখা দেয় শারীরিক ও মানসিক নানান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। যেমন রাগ, উদ্বেগ, অপরাধবোধে ভোগার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হয়ে পড়ে মুহ্যমান। এতে করে তার মধ্যে দেখা দেয় নানান উপসর্গ। সেই উপসর্গগুলো হলো:
ক) আবেগ ও অনুভূতি নেতিবাচক হয়ে পড়া। খ) প্রাত্যহিক কাজে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়া। গ) ঘটে যাওয়া নেতিবাচক অভিজ্ঞতার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা। ঘ) ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে অভিযুক্ত করা এবং তার সাথে মেজাজ দেখানো। ঙ) ব্যক্তিগতভাবে নির্লিপ্ত ও নির্জীব হয়ে পড়া। চ) ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস প্রশ্বাস ও নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়া। হাইপার একটিভ আচরণ করা। ছ) বেদনাদায়ক সেই স্মৃতি বার বার মনে পড়া এবং ঘটনা নিয়ে বেদনাদায়ক দুঃস্বপ্ন দেখা ও অসহিষ্ণু আচরণ করা। জ) পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া ইত্যাদি।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যাজনিত কারণে সৃষ্ট উদ্বেগ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে জন্ম দিয়েছে তেমনি মানসিক সংকট তথা ‘পিটিএসডি’।
ফলে উল্লেখিত উপসর্গগুলো অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠা এবং নানা ধরনের অসংলগ্ন আচরণ দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই এমনকি পঠন-পাঠনেও হয়ে পড়তে পারে অমনোযোগী। নিজেদের স্বাভাবিক করতে অনেকেই ঝুঁকে পড়তে পারে নানান ধরনের আসক্তিতে। এছাড়াও তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন ধরনের পীড়নমূলক মনোবিকৃতি তথা মনোবৈকল্য।
এক্ষেত্রে অনুরূপ উপসর্গে ভোগা শিক্ষার্থীদের দ্রুত মনোবৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবার আওতায় আনা অতীব জরুরি। তাই কাল বিলম্ব না করে ‘পিটিএসডি’-তে ভোগা এইসব শিক্ষার্থীদের যথাযথ মনোবৈজ্ঞানিক সেবার আওতায় আনা আবশ্যক। অন্যথায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীগণ স্থায়ী মানসিক রোগীতে পরিণত হতে পারে। তাই সহপাঠী ও পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি দেশব্যাপী শুরু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ। তাই উপরে বর্ণিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর আগেই প্রতিটি ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয়ভাবে না হলেও ন্যূনতমপক্ষে অনুষদভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সাথে সাথেই অনুরূপ ভোগান্তিতে থাকা শিক্ষার্থীগণ মনোবৈজ্ঞানিক সেবার আওতায় আসতে পারে।
কারণ শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রশান্ত রাখতে না পারলে তারা গুণগতমানের শিক্ষা গ্রহণ থেকে যেমন বঞ্চিত হবে তেমনি আত্ম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নেতিবাচক আচরণে মুখর হয়ে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে করে তুলতে পারে সহিংস ও অশান্ত।
সামগ্রিক অবস্থা ও আসন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। আর তা পরিচালনার জন্য ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ প্রক্রিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি গ্রুপ সাইকোথেরাপি পদ্ধতি অনুসরণ করে আয়োজনের ব্যাবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে সল্প সময়ে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যাবে। আর এই ক্ষেত্রে এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি সেশন আয়োজন করতে পারলে তা হবে উদ্দীপক ও কার্যকর একটি ব্যাবস্থাপনা।
এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি সেশন যেহেতু সৃজনশীল বিভিন্ন কলা মাধ্যম ব্যাবহার করে পরিচালিত হয়ে থাকে সেহেতু এই ধারার মনোস্বাস্থ্যসেবা প্রদান প্রক্রিয়া উন্মেষ ঘটাবে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মান। আর এই প্রক্রিয়ায় যদি শিক্ষার্থীদের ব্যাক্তিগত যত্ন তথা সেলফ কেয়ারের কৌশলগুলোর সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়া যায় তবে তা হবে কার্যকর মহৌষধ।
প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে যদি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা যায় তবে শিক্ষার্থীর মন ও মননে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা মানসিক বিপর্যস্ততা মোকাবেলা এবং তা থেকে সৃষ্ট নানান ধরনের মানসিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
অন্যথায় সৃষ্ট নতুন পরিবেশ ও অস্থির পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন পঠন-পাঠন ও শিখন প্রক্রিয়াকে করবে ব্যাহত। ফলে গুণগত মানের শিক্ষা গ্রহণ থেকে শিক্ষার্থীগণ হবেন বঞ্চিত।
কারণ ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’র মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হতে না হতেই; দেশের পূর্বাঞ্চলজুড়ে চলে আসে ভয়াবহ বন্যা। একদিকে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ অন্যদিকে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত বাসা-বাড়ি। ঘুমহীন দিনাতিপাত, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধমুখিতা, শিক্ষার্থীদের প্রাত্যহিক জীবন ও জীবনাচারে নামিয়ে এনেছিল বহুমাত্রিক অস্বস্তি ও বিক্ষিপ্ততা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থীর পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে খেয়ে-পরে জীবনাতিপাত করা যেখানে ছিল তাদের জন্য কষ্টসাধ্য; সেখানে একজন শিক্ষার্থী পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কী করে শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে তার পাঠে মনোযোগী হবে বা হতে পারবে?
এমন প্রশ্নের সমাধান না করে অর্থাৎ উপযোগী পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিশ্চিত না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পক্ষে কতটা প্রশান্ত মন ও মননকে সচল রাখা সম্ভব হবে?
শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যায়তনিক পাঠে একাগ্রতা নিয়ে আত্মনিয়োগ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত বিষয়ে শিক্ষালয় ও শিক্ষাঙ্গন ব্যাবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টজনদের ভেবেচিন্তে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ হবে বলে মনে করি। নীতি নির্ধারকগণ এক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন এটাই প্রত্যাশা।
আমাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর পুনরায় খুলে দিলে— আবাসিক হলগুলোতে সিট বরাদ্দ, রাজনৈতিক বিশ্বাসগত ভিন্নতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সহ-অবসন্থান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষক ও কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্টি এবং ইতোপূর্বে বিদ্যমান অধিকারহীনতার সংস্কৃতি প্রসঙ্গগুলোও নতুন পরিস্থিতিতে যে অশান্ত অবস্থান সৃষ্টি করবে তা ভয়ানক হতে পারে।
ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে যে বৈপরীত্যমূলক পরিস্থিতি জন্ম হবে তা মোকাবেলার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবনিযুক্ত ব্যাবস্থাপকগণ কতটা প্রস্তুত হয়ে দায়িত্ব নিচ্ছেন তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই পর্যালোচনা করা আবশ্যক বলে মনে হয়।
এক্ষেত্রে অবশ্যই আসন্ন পরিস্থিতি ও উদ্ভূত পরিবেশ বিবেচনায় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দিকে মনযোগ দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ‘মনোস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দ্বন্দ নিরসন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে সবচেয়ে বেশি সহায়ক।
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে— শিক্ষাঙ্গন খোলার আগেই যাতে শিক্ষার্থীর জন্য গুণগত মানের শিক্ষার পরিবেশ ও প্রতিবেশ প্রস্তুত রাখা যায় সেই দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় উদ্ভূত মনোস্বাস্থ্য বিপর্যয় ও সংঘাতমূলক পরিস্থিতি এবং তার ফলে শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক বিশৃঙ্খল অবস্থা গড়ে ওঠা মোকাবেলা করা হয়ত অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
কারণ শিক্ষার্থীরা আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাহীন অবস্থায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই পারস্পরিক সহনশীলতা প্রদর্শন করতে সমর্থ নাও হতে পারে। এতে করে এমন সব ঝুঁকিপূর্ণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি জন্ম হবে যা কারুর জন্যই প্রত্যাশিত নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের সহনশীল মন ও মনন নিশ্চিত করতে হলে— তাদের মনোপীড়া ও মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক ব্যাবস্থাপনা গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ‘মনোস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দ্বন্দ নিরসন কেন্দ্র’ অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সেই সেবার আওতায় এসে নিজেদের মানসিক ভঙ্গুর অবস্থা মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়।
এমতাবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিয়ে তারা যাতে পাঠ্যক্রমে মনোযোগী মনোভাব নিয়ে যেন আত্মনিয়োগ করতে পারে সেই ব্যবস্থাপনা তথা কাঠামো ও অবকাঠামো গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করছি। যা অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসাবে নিযুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মাহফুজ আলমও সম্প্রতি এক বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান করতে গিয়ে তরুণ সমাজ নানামুখী ট্রমার শিকার হয়েছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে সৃষ্ট এই ট্রমা মোকাবেলায় বা ব্যবস্থাপনায় যে কোনও মনোবৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নেই তাও ব্যক্ত করেছেন তিনি।
মো. মাহফুজ আলমের এই বক্তব্য থেকে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারছি— চলমান আন্দোলনে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মনো-সামাজিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ যে কতটা প্রয়োজন সেটা বোঝা যায়। যৌক্তিক এই প্রত্যাশার প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন এমন একটি মানসিক স্বস্থ্যবান্ধব শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলবে; যেখানে শিক্ষার্থীগণ তাদের মন ও মনন প্রশান্ত রেখে দৈনন্দিন পাঠ পরিক্রমা গুনগতমান রক্ষা করে সু-সম্পন্ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক মনোস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নীতি নির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
স্মরণ রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ আবহাওয়ার দেশ এবং বরাবরই নানান চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী পরও এই দেশে নেই গুণগতমানের কোনও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা। তার উপর পরিসংখ্যানগত দিক থেকে আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় সংকট রয়েছে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরও। তাই সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ ধারণায় প্রদত্ত মনোস্বাস্থ্য সেবার কর্ম-কৌশলের বিদ্যায়তনিক পাঠের পাশাপাশি ‘গ্রুপ সাইকোথেরাপি’র সর্বাধুনিক বিভিন্ন প্রয়োগশৈলীর বিদ্যায়তনিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা অতীব প্রয়োজন ও সময়ের দাবি।
আশাব্যাঞ্জক বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একজন বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক অন্তর্ভুক্ত আছেন। তিনি চাইলে অপরাপর উপদেষ্টাদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব ও প্রয়োজন তুলে ধরতে পারেন। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ‘পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজওর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ মোকাবেলা করার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা ও সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
পরিশেষে, অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মহোদয়ের কাছে বিনীত নিবেদন— দেশের বর্তমান সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং গুণগত মানের শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তুলতে একটি কার্যকর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। যাতে দেশে মনোস্বাস্থ্য সেবা প্রদায়ক পেশাজীবী গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উৎস (ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশ্যাল একশন)।
ইমেইল: [email protected]