খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসব মানেই লাল মখমলের স্যুট আর টুপি পরা সান্তা ক্লজ। পেছনে তার ঝোলাভর্তি উপহার। হাসিমুখে শিশুদের সেই উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অন্তত এমন চিত্রই আমরা দেখে আসছি বছরের পর বছর ধরে।
তবে এমন চেনা রূপের বাইরেও সান্তা ক্লজকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সান্তা ক্লজকে নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য সান্তা ক্লজ’ এর অভিনেতা টিম অ্যালেনের সাধারণ পোশাক বা ‘মিনস গার্লস’ সিনেমায় মিনি স্কার্টের সান্তাকেও আমরা দেখতে পেয়েছি।
সান্তার এই ঐতিহ্যবাহী রূপ আজকের সমাজের কল্পনা ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত।
সান্তা ক্লজের পোশাক সব জায়গায় এক রকম রাখা হয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শপিং মলগুলোর সান্তাদের ক্ষেত্রে। সান্তা কোনও বাস্তব চরিত্র না হলেও, তার পোশাকের নির্দিষ্ট রীতিগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
একবার নিউ ইয়র্কের ব্লুমিংডেলস শপিং মলে এক সান্তা সবুজ পোশাক পরেন। একটি বিশেষ প্রচারের অংশ হিসেবেই সেটি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া থেকে শুরু করে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। একজন মা তখন মন্তব্য করেছিলেন, “সব কিছু বদলানোর প্রয়োজন নেই। সবুজ সান্তা বোকামি। এটা আমি মেনে নিতে পারি না।”
সান্তা ক্লজ সবসময় লাল পোশাক পরত না। তার বর্তমান চেহারা, পোশাক ও উচ্চতা গড়ে উঠতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছে। তার পূর্বসূরিদের মধ্যে ছিলেন খ্রিস্টীয় বিশপ সেন্ট নিকোলাস, ডাচদের সিন্টারক্লাস, ফ্রান্সের পেরে নোয়েল এবং জার্মানির উপহার দেওয়া শিশু যিশু, ক্রিস্টকিন্ডল।
ক্রিস্টকিন্ডল থেকে আমেরিকায় ভুল উচ্চারণে ‘ক্রিস ক্রিঙ্গল’ নামে পরিচিতি পায়। তবে আমেরিকান সান্তার রূপ প্রথম গড়ে উঠতে শুরু করে ১৮২০ সালের দিকে। কবিতা, চিত্রকর্ম ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার এই চেহারা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়।
১৮২৩ সালে আমেরিকান কবি ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুর ‘এ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস’ নামে একটি কবিতা লেখেন। সেখানে সান্তাকে একজন সাদা শ্মশ্রুমন্ডিত, পশমি পোশাক পরিহিত একজন মানুষ হিসেবে দেখানো হয়। তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের হরিনচালিত স্লেজ গাড়ি। মুরের এই বর্ননা ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর আগে অজ্ঞাত এক কবির কবিতায় ‘সান্তেক্লজ’ নামটি উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এই কবিতায় তার পরনের পোশাকের বর্ননা দেওয়া হয় ভিন্ন ভাবে।
‘সান্তা ক্লজ : এ বায়োগ্রাফি’ বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ জেরি বোলার বলেন, “১৯ শতকে সান্তা ক্লজের চেহারা ও পোশাক নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। আমেরিকান শিল্পীদের সান্তার পোশাক নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রায় ৮০ বছর লেগেছিল। তখন পর্যন্ত সান্তাকে যেকোনো রঙের পোশাকে ও বিভিন্ন ধরনের পোশাকে উপস্থাপন করা হতো।”
সান্তার নানা চেহারা
মুরের কবিতায় সান্তাকে দেখানো হয়েছে চতুর ও বেঁটে এক মানুষের মতো। তিনি সহজেই চিমনির ভেতর প্রবেশ করতে পারেন। ১৮৬৪ সালের একটি চিত্রে সেন্ট নিকোলাসকে হলুদ পোশাক ও পশমের টুপি পরানো হয়েছিল। এমন পোশাক সাধারণত বিশপরা পরেন। ১৮৩৭ সালের একটি তৈলচিত্রে তাকে পশম দিয়ে সাজানো একটি লাল টুপি পরতে দেখা যায়। ১৮৫০ সালের পি টি বারনামের বিজ্ঞাপনে তাকে দাঁড়িবিহীন বিপ্লবী হিসেবে দেখানো হয়। আর ১৯০২ সালের এল. ফ্রাঙ্ক বাউমের ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার অব সান্তা ক্লজ’ বইয়ের প্রচ্ছদে তাকে কালো পোশাক, পশমের টুপি ও লাল বুট পরিহিত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
হার্পারস উইকলি পত্রিকা কার্টুনিস্ট থমাস ন্যাস্ট সান্তা ক্লজের চেহারা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৬৩ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় তিনি প্রথম সান্তাকে আঁকেন। সেখানে সান্তা স্টার্স অ্যান্ড স্ট্রাইপস পরিহিত ছিলেন এবং ইউনিয়ন সেনাদের উপহার দিচ্ছিলেন।
তবে সান্তার সবচেয়ে প্রভাবশালী চিত্রকর্মটি ১৮৮১ সালের। সেখানে সান্তাকে একটি লাল স্যুট পরিহিত দেখানো হয়, অনেকটা আজকালের মতো। পরে শিল্পী নরম্যান রকওয়েল ওি জে.সি. লেইন্ডেকার বিংশ শতকের প্রারম্ভে ‘দ্য সাটারডে ইভনিং পোস্টে’ সান্তাকে তার ঐতিহ্যবাহী স্যুটে আঁকেন।
এনিয়ে ইতিহাসবিদ বোলার বলেন, “সান্তাকে যখন লাল পোশাক ও সাদা পশমের টুপিসহ ম্যাগাজিনের কভারে দেখা যায়, তখন এটি তার চেহারা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।”
এসব শিল্পীদের প্রথম আঁকা চিত্রগুলো অনেক সময় কোকা-কোলার দীর্ঘ প্রচারের কারণে একটু কম গুরুত্ব পায়। ১৯৩১ সালে কোকা-কোলা তাদের ছুটির প্রচারের জন্য হ্যাডন সান্ডব্লমের আঁকা সান্তার চিত্র ব্যবহার করতে শুরু করে। এতে সান্তার গাল ছিল গোলাপি ও শরীর মোটা। এটি মূলত হ্যাডন তার এক বন্ধুর ওপর ভিত্তি করে একেছিলেন। এই চিত্রটি তখন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখনো পরিচিত।
বোলারের মতে, “আমার মনে হয় অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে, কোকা-কোলার কিছু সম্পর্ক ছিল সান্তার লাল ও সাদা পোশাক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। এটা ইন্টারনেটেও বেশ দেখা যায়। কিন্তু এটা সত্য নয়। সান্তার ঐতিহ্যবাহী পোশাক অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল।”
কোকা-কোলা সান্তার পোশাক প্রচারের প্রথম সফট ড্রিংক ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের সময়, প্রথম সান্তার পোশাক পরা চিত্রটি প্রচার করেছিল হোয়াইট রক বেভারেজেস। এটি ছিল কোকা-কোলার সান্ডব্লমেরও আগে।
স্মৃতি জাগানিয়া কৌশল
ইতিহাসবিদ ও লেখক স্টিফেন নিসেনবামের মতে, সান্তাকে যারা প্রথম কল্পনা করেছিলেন, তারা তার জন্য লাল স্যুট বেছে নেননি। তবে তারা তাকে একটি স্মৃতি জাগানিয়া চরিত্র হিসেবে তৈরির চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত নিসেনবামের গুরুত্বপূর্ণ ‘দ্য ব্যাটল ফর ক্রিচমাস’ বইয়ে সান্তার চরিত্রের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাস থেকে সান্তার উৎপত্তি সম্পর্কিত পুরনো ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
বইয়ে নিসেনবাম ১৮২০ এর দশকে ‘নিউ ইয়র্কের কিছু পৌরাণিক মনোভাবাপন্ন পুরুষের’ কথা উল্লেখ করেন। তাদের মধ্যে মুর, নিউ ইয়র্ক হিস্টোরিকাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জন পিনটার্ড ও লেখক ওয়াশিংটন আর্ভিং ছিলেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ডাচ চরিত্রটি নতুন করে গঠন করেন, যাতে এটি একটি পরিবারবান্ধব ছুটির প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি দারিদ্র্য ও অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে এক নতুন ধরণের উৎসবের চিত্র উপস্থাপন করে।
নিসেনবামের মতে, নিউ ইংল্যান্ডে বড়দিনের পূর্বসূরি ছিল ১৭শ ও ১৮শ শতকের শুরুতে এক মাসব্যাপী মদ্যপ, হট্টগোলপূর্ণ ও অশালীন উদযাপন। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য একটি ‘সেফটি ভালভ’। দরিদ্ররা ধনীদের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারত এবং তারা সেরা খাবার ও পানীয় পাওয়ার প্রত্যাশা করত। এটি ছিল শুভেচ্ছা প্রকাশের একটি প্রতীক।
মুরের সময় বড়দিন একভাবে উদযাপন করা হতো না। পিউরিটানরা বড়দিন উদযাপন বন্ধ করতে চেয়েছিল। আর ইভাঞ্জেলিকরা ২৫ ডিসেম্বরকে একটি পবিত্র দিন হিসেবে উদযাপন করতে চেয়েছিল। তবে অন্যরা পুরানো ঐতিহ্য অনুসারে আনন্দে মত্ত ছিল।
নিসেনবাম লেখেন, “বড়দিন উদযাপনের এসব পদ্ধতির কোনোটিই আজকের বড়দিনের সঙ্গে মেলে না। সেগুলোর কোনোটিতেই আমরা পরিচিত আড়ম্বরপূর্ণ জমায়েত বা প্রত্যাশিত শিশুদের উপহার দেওয়া দেখতে পেতাম না। কোথাও বড়দিনের গাছ, হরিণ বা সান্তা ক্লজও দেখা যেত না।”
বড়দিনের এই নতুন সংস্করণে, শিশুদের যাদের আগে বড়দের মতো দেখা হতো, তারা এখন উপহার পায়। এতে ধনী মানুষদের দরিদ্রদের সেবা করার চাপ কমে যায়। মুরের সেন্ট নিকোলাসের চিত্রকে নিসেনবাম এমন পরিবর্তন হিসেবে দেখেন, যেখানে সান্তা ঘরের ভিতরে প্রবেশকারী নয়, বরং একজন অতিথি হয়ে ওঠেন। তিনি কোনো দাবি না করে উপহার দিয়ে যান।
সান্তা ক্লজের পোশাকের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার বেটে আকৃতিও পাল্টে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন অনেক বেশি লম্বা, আনন্দিত এবং পুরোপুরি সদয় একজন অতিথি।
বোলার তার পোশাক সম্পর্কে বলেন, “এটি একটি ভয়হীন অচেনা চেহারা। তিনি একটি কল্পনার সৃষ্টি। তিনি এমন পোশাক পরেন যা অন্য কেউ পরেন না। সময়ের সঙ্গে এটি পরিচিত হয়ে ওঠে।”
বোলার মনে করেন, সান্তার যে বৈশিষ্ট্যগুলি জনপ্রিয় হয়েছে, তা ছিল কার্যকরী সিদ্ধান্ত। একবার যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে সান্তা মেরু অঞ্চল থেকে এসেছেন, তখন পশম পরা যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে। রঙের ক্ষেত্রে, লাল রঙটি উজ্জ্বল এবং এটি তার সাদা দাড়ি ও সাদা তুষারের বিপরীতে দারুণ কাজ করে।
সান্তার পোশাকের সঠিক প্রভাব চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ তার অনেক ধরনের সংস্করণ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। সেগুলো মিলিতভাবে একক পশ্চিমা চিত্রে পরিণত হয়েছে। তার টুপি একমাত্র বিভিন্ন প্রাচীন শিরস্ত্রাণ, যেমন ফ্রিজিয়ান ক্যাপ, ফেল্ট পাইলিয়াস এবং পপাল ক্যামাওরোর প্রভাবে তৈরি হয়েছে। তবে এখন এটি পুরোপুরি সান্তার নিজস্ব এবং তার পরিচয়ের অপরিহার্য অংশ।
তথ্যসূত্র : সিএনএন