Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

সুইডেনে চাকরি ছেড়ে কেন ‘সফট গার্ল’ হতে চায় মেয়েরা

চাকরি ছেড়ে ‘সফট গার্ল’ জীবনে সুখী ভিলমা লারসন। ছবি: বিবিসি
চাকরি ছেড়ে ‘সফট গার্ল’ জীবনে সুখী ভিলমা লারসন। ছবি: বিবিসি
[publishpress_authors_box]

নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিতে সুইডেন বলা চলে আদর্শ একটি দেশ। তাহলে এখানে হঠাৎ করে তরুণীদের মধ্যে চাকরি ছাড়ার হিড়িক পড়েছে কেন?

২৫ বছরের ভিলমা লারসন আগে কাঁচাবাজারের দোকান, কেয়ার হোম এবং কারখানায় কাজ করতেন। তিনি বছর খানেক আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে ঘরোয়া জীবন কাটাচ্ছেন।

নিজেকে নিয়ে এখন সুখী বোধ করা ভিলমা লারসন বলছেন, “আমার জীবন এখন অনেক নির্ভার। আমাকে প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে না। এখন আমি কোনো চাপে ভুগছি না।”   

ভিলমা লারসনের প্রেমিক একটি ফাইনান্স প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দিনে যখন তিনি ল্যাপটপে বসে কাজ করেন তখন তার প্রেমিকা হয়ত জিমে, নয়তো কফি খেতে বাইরে অথবা রান্না করছে। এই যুগল মধ্য সুইডেনের ছোট একটি শহরে বেড়ে উঠেছে। দুজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করে এবং এই শীতে তারা সাইপ্রাসে সময় কাটাচ্ছে।  

“কাজ করে যে আয় হয় তা থেকে প্রতি মাসে সে আমাকে বেতন দেয়। যদি আমার বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি তাকে জানিয়ে রাখি। আর যদি কম প্রয়োজন হয়, তাহলে কিছুই বলিনা; জমিয়ে রাখি বাকিটা”, বললেন লারসন।

নিজের রোজকার জীবন ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এবং টিকটকে তুলে ধরেন এই তরুণী। সোশাল মিডিয়াতে তার ১১ হাজার অনুসারী আছে। অনেক পোস্টে চার লাখ লাইক পেয়ে গেছেন এরমধ্যে। যদিও এসব কনটেন্ট থেকে এখনও কোনো আয় হাতে আসেনি বলে বিবিসিকে জানালেন লারসান।

লারসন নিজেকে ‘সফট গার্ল’ বলে পরিচিত করান। নিজের কনটেন্টে বিশেষ দুটো হ্যাশট্যাগ দিচ্ছেন তিনি।

‘hemmaflickvän’ এবং ‘hemmafru’ হ্যাশট্যাগ দুটো সুইডেনে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে; যার অর্থ সুইডিশ প্রেমিকা এবং স্ত্রীরা বাড়িতেই থাকবে। তরুণীদের অনেকে মনে করছেন, কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে ওঠার চেয়ে নির্ভার জীবন কাটানো অনেক বেশি নারীসুলভ আচরণ।

বিবিসি বলছে, ২০১০ সালের দশক থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে এই ‘সফট গার্ল’ চর্চা চলছে। যদিও সংসারে দুজনেরই উপার্জন করাকে উৎসাহ দিয়েই গত ৫০ বছর ধরে সুইডেনের রাষ্ট্রনীতি সাজানো হয়েছে। কিন্তু হুট করে তরুণীদের চাকরি ও উপার্জনের সুযোগ ছেড়ে দেয়ার হুজুগ অনেককে অবাক করেছে; এ নিয়ে মতভেদও দেখা দিয়েছে।   

সুইডেনের তরুণদের নিয়ে প্রতি বছর উংডমসবারোমিটারেন পরিচালিত এক জরিপ হয়। আর এতে বছর খানেক আগে জাতীয় পর্যায়ে মেয়েদের ‘সফট গার্ল’ চর্চা সবার নজরে আসে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের নিয়ে জরিপটি করা হয়। 

গত অগাস্টে উংডমসবারোমিটারেন আরও একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, স্কুলে পড়া মেয়েরাও এতে প্রভাবিত হয়েছে; সাত থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৪ শতাংশই ’সফট গার্ল’ হতে চায়।

তবে লারসনের মতো কত সংখ্যক তরুণী ‘সফট গার্ল’ জীবন বেছে নিয়ে তা নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই।

উংডমসবারোমিটারেনের একজন গবেষক গেয়ারানসন মনে করছেন, হাতে গোনা কয়েকজনই হয়তো এমন জীবন কাটাচ্ছেন।

এরপরও সুইডেনে বিষয়টি অনেকের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। সংবাদপত্র, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান আলমেদালেন এবং টেলিভিশনেও এই আলোচনা  পৌঁছে গেছে।

সুইডেনের নারীবাদী দল ফেমিনিস্টিস্ক ইনিশিয়াটিভের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক নেতা গুডরুন শিম্যান এই আলোচনায় নিজের মতামত দিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, “সঙ্গীর উপার্জন দিয়ে নারী নিজের জীবন যাপন ব্যয় মেটাচ্ছে এমন চর্চা খুবই ক্ষতিকর। এমন উদাহরণ লৈঙ্গিক ন্যায্যতাকে এক ধাপ পিছিয়ে দিল।”    

শিম্যানের অভিযোগ, সুইডেন ডেমোক্রেটস দল এবং ডানপন্থীদের জোট সরকার দ্বারা এখানকার তরুণরা প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজমের ব্যাপক প্রসার থেকেও তাদের জীবনচর্চায় এমন মোড় এসেছে।      

সুইডেনে লিঙ্গ সমতা বাড়াতে নীতিমালা চালু করার আগে জীবন নিয়ে সচেতনতার অভাব ছিল বলেও মনে করেন গুডরুন শিম্যান। এই দেশে সন্তানের পরিচর্যার জন্য সরকারি সহায়তা বা ভর্তুকি দেয়া হয়। আবার বাবা-মা কর্মক্ষেত্রে ছুটি ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।

“এখানে নারী যেভাবে তাদের কাজ করার ও বেতনের অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল আজকের তরুণীরা সেই ইতিহাসের মর্ম বুঝতে পারছে না।”

সফট গার্ল ট্রেন্ডের প্রতি পুরো সমর্থন দেখাচ্ছে সুইডেন ডেমোক্রেটস দল।

এই দলের যুব শাখার জাতীয় মুখপাত্র ডেনিস ওয়েস্টারবের্গ বলেন, “যদি আপনার কাছে একজন  সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করার মতো সেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তো আপনার জন্য এটা ভালো।

“আমরা এখনও এমন একটি দেশে বাস করছি যেখানে ক্যারিয়ার গড়ার সবরকম সুযোগ আছে। আমাদের সব অধিকারও এখনও  আছে। কিন্তু প্রথাগতভাবে জীবনযাপন বেছে নেওয়ার অধিকারও আছে আমাদের।”

রাজনৈতিক মতাদর্শের বিতর্কের বাইরে গিয়ে অনেকের আলোচনা তরুণীদের কর্মজীবন ছেড়ে  ‘সফট গার্ল’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পেছনে কোনো  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব আছে কি না তা খতিয়ে দেখায় জোর দিচ্ছে।

কর্মজীবন ও ব্যক্তি জীবনের মাঝে ভারসাম্য নিশ্চিতে সুইডেনের সুনাম আছে। বেশিরভাগ চাকরিজীবী এখনে বছরে ছয় সপ্তাহ ছুটি পায়। এক শতাংশেরও কম কর্মী সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন।  

উংডমসবারোমিটারেনের গবেষণা বলছে, সুইডেনে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ছে।

এরমধ্যে ‘কোয়ায়েট কুইটিং’ ট্রেন্ড ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক দেশে। এতে চাকরিজীবীরা কর্মক্ষেত্রে বাড়তি কাজের উৎসাহ দেখানো এড়িয়ে চলেন; চাকরি ছেড়ে না দিলেও কাজের প্রতি মনোযোগ কম দেখান।

গুডরুন শিম্যানের ধারণা, এই ট্রেন্ডের ধারাবাহিকতাতেই তরুণীরা হয়তো চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছে।

বিশেষ করে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া জেন-জি প্রজন্মকে কর্মজীবন নিয়ে না ভেবে অবসর সময় উদযাপনের কনটেন্ট বানাতে ও এসবে মেতে থাকতে দেখা যাচ্ছে।  

গেয়ারানসন বলেন, “সোশাল মিডিয়াতে কাজ বা কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুব একটা কনটেন্ট চোখে পড়ে না আজকাল। এখানে বেশিরভাগ কনটেন্ট শরীরচর্চা এবং ভালো থাকা নিয়ে।

“আর তরুণরা যখন ভাবে স্বাভাবিক জীবন এমনই হয়, তারা এরপর কোনোভাবেই আট ঘণ্টা অফিসে কাটাতে চাইবে না।”

সুইডেনের লৈঙ্গিক ন্যায্যতার নীতিমালার সীমাবদ্ধতার বিপরীতে এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছে কি না এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।

ইউরোপে স্লোভেনিয়ার পাশাপাশি সুইডেনে কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সুইডেনের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এরপরও পুরুষের চেয়ে নারীই ঘর এবং সন্তান সামলানোর কাজে বেশি সময় দিচ্ছেন।

তারা রাষ্ট্রের অর্থায়নে পিতৃত্ব-মাতৃত্বকালীন ছুটির ৭০ শতাংশ নিয়ে থাকে। এছাড়া মানসিক চাপের জন্য অসুস্থতাজনিত ছুটি নেয়। ইউরোপে পুরুষ এবং নারীর বেতন বৈষম্য গড়ে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ; সুইডেনে এর চেয়ে কম। ২০১৯ সালে সুইডেনে পুরুষ-নারীর বেতন বৈষম্য  ১০ শতাংশে স্থির ছিল।  

লারসন সামনের দিনে সন্তান নিতে আগ্রহী। বয়স্ক নারীদের কর্মজীবন এবং সংসার জীবন নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছেন তিনি। চাকরির বদলে ঘরে সময় দেয়া বেছে নেয়ার পেছনে যা একটি কারণ বলে জানালেন লারসন।  

“আমার মনে হয় কাজের চাপে অনেক মেয়ে ক্লান্ত বোধ করে। আমি আমার মা, আমার গ্র্যান্ডমা, আমার বোন, সবাইকে নিয়ে ভেবে দেখেছি। এরা সবাই ভীষণ চাপের মধ্যে দিন কাটায়।”

একই কথা বললেন সুইডেনের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত জেন্ডার ইক্যুইটি এজেন্সির পলিসি বিশ্লেষণ ও মনিটরিং বিভাগের প্রধান পিটার উইকস্ট্রম।

তিনি মনে করেন, নারীর উপর এসব  চাপ বেড়ে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই ‘সফট গার্ল’ ট্রেন্ড।

সুইডেনের পেনশন ফান্ড এসপিপি -এর অর্থনীতিবিদ শোকা আর্হম্যান অবশ্য মনে করেন, যথেষ্ট সংখ্যক সুইডিশ প্রেমিকা ও নারীরা কাজ ছাড়বে না; ফলে দেশের অর্থনীতিতেও কোনো প্রভাব পড়বে না।

এরপরও তিনি সুইডেনে নারীদের সচেতন করে চলেছেন। চাকরি ছেড়ে দিলে বা পার্ট টাইম কাজ শুরু করলে নারীর ব্যক্তিগত আর্থিক সামর্থ কমে আসবে। আরও কমে যাবে সঞ্চয়, পেনশন।

এই ‘সফট গার্ল’ বিতর্ক রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বিশেষ বার্তা দিচ্ছে, বললেন আর্হম্যান।

অর্থাৎ সুইডেনে এখনও অসমতা আছে, যা নিয়ে কাজ করতে হবে।

“আমি এর গোড়ায় যেতে চাই; আর তা হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ক্লান্তি এসব কিছুই উদ্বেগের বিষয়। শুধু কিছু তরুণীই চাকরি ছেড়ে নির্ভার জীবন বেছে নিতে চাইছে এমন নয়, এর প্রভাব আরও বিস্তৃত।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত