Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সিরিয়ায় কি বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য

asad-Regim-change
[publishpress_authors_box]

মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা এখনও অমীমাংসিত।

ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যে ইসরায়েলে হামলা করবে, তা টের পেতে ব্যর্থ হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এই ব্যর্থতার কারণে ইসরায়েল হামাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি। কেন মোসাদ তার নাকের ডগায় হওয়া আক্রমণ পরিকল্পনা আগেই টের পায়নি, এনিয়ে তখন বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিল।

তবে মস্কোর এইচএসই ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুরাদ সাদিকজাদের মতে, ৭ অক্টোবরের ঘটনার পেছনে একটি গভীর প্রক্রিয়া রয়েছে, যা ধীরে ধীরে অঞ্চলটিকে একটি পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আগে যে বিষয়গুলো লুকানো ছিল, এখন তা স্পষ্ট হচ্ছে। এটি একটি পরিকল্পনা দেখাচ্ছে, যার লক্ষ্য সেই সব দেশকে নতুনভাবে গঠন করা, যেগুলো অনেক দিন ধরে পশ্চিমা দেশের প্রভাব ও বিস্তার প্রতিরোধ করে আসছে।

গোটা মধ্যপ্রাচ্যে গত ৮ ডিসেম্বর সকালে একটি বিস্ময়কর খবর ছড়িয়ে পড়ে, দামেস্কের পতন হয়েছে বিরোধীদের হাতে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টির শাসন কার্যত শেষ হয়ে গেছে।

লম্বা সময় ধরে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রায় সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের মনোযোগ সিরিয়ার দিকে সরিয়ে নেয়।

সিরিয়া ছিল ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। দীর্ঘদিন ধরে ইরানের আঞ্চলিক নীতি অনুসরণকারী সিরিয়া এখন এক বিপদগ্রস্ত দেশ। দেশটি অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চাপের সামনে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাগুলো একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তন করা। ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ প্রধান সদস্যরা – ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী, সিরিয়া ও লেবানন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে: এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিকল্পনার পরবর্তী লক্ষ্য কে হবে? অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এবং বাইরের শক্তিগুলোর ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার: মধ্যপ্রাচ্য আর আগের মতো থাকবে না।

কী হয়েছে সিরিয়ায় এবং কেন

সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে ১১ দিন আগে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল, তা দ্রুত একটি সিরিজ ঘটনার রূপ নেয়। এতে সিরিয়ার পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। গত ৭ ডিসেম্বর সশস্ত্র বিরোধী বাহিনী এবং হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ঘিরে ফেলে। এক রাতেই তারা হোমস শহরের দখল নেয়। এসময় খুব বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি তাদের।

প্রায় বিনা বাধায় তারা দামেস্কে প্রবেশ করে। পথে তারা সিরিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার সাইদানিয়াসহ বেশ কয়েকটি কারাগার থেকে কয়েদিদের মুক্তি দেয়। সিরিয়ার শাসনব্যবস্থা যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল, তা এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।

দামেস্কের অলিগলিতে ৭ ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ার সেনারা তাদের ইউনিফর্ম ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে দ্রুত রাজধানী থেকে পালায়। এসময় শহর প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার মধ্যে দামেস্কের রাস্তাগুলো সেনা সদস্যহীন হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত নাগরিকরা খাবার সংগ্রহ করতে ও তাদের বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে।

এর প্রভাব শহরের ধনী এলাকাগুলোতে ছিল স্পষ্ট। সেখানকার মানুষ দলবদ্ধ হয়ে পালিয়ে যায় বিশৃঙ্খলার ভয়ে। এর বিপরীতে শহরের দক্ষিণ অংশের দৃশ্য ছিল একেবারে আলাদা। সেখানে বিরোধীরা মুক্তিদাতা হিসেবে অভ্যর্থনা পায়। জনতা সমবেত হয় উদযাপন করতে। প্রতিবাদ হিসেবে আধুনিক সিরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আসাদের মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়।

এই নাটকীয় ঘটনাগুলোর মধ্যেই সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালি এক জরুরি ঘোষণা দেন। আল-আরাবিয়া চ্যানেলে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি সরকারের আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন এবং দেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সহযোগিতার প্রস্তুতির কথা জানান।

আল-জালালি উল্লেখ করেন, অধিকাংশ মন্ত্রী দামেস্কে ছিলেন, যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চালু থাকে এবং পরিবর্তনকালীন সময়ে বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায়। তিনি আরও জানান, এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির অধীনে দামেস্কের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করা হয়।

সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনের প্রধান হাদি আল-বাহরা তার বক্তব্যে দেশের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায়ের আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি এখন নিরাপদ। সিরিয়ায় অন্ধকার সময় শেষ হয়েছে। নতুন সিরিয়ায় প্রতিশোধের কোনও স্থান নেই।”

এই ঘোষণাটি জনগণকে আশ্বস্ত করার এবং বিরোধীদের প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত করার চেষ্টা হিসেবে করা হয়েছিল। তবে এসব বক্তব্যের পেছনে সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে একটি অনস্বীকার্য উদ্বেগ রয়েছে। দেশটিতে বর্তমান পরিস্থিতি শান্তি নিয়ে আসবে কি না, তা এখনও অজানা।

সিরিয়ার ঘটনাগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর পেছনে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও পরিশ্রম ছিল। এই পরিস্থিতি একটি সিরিজ অভ্যন্তরীণ সংকট, বিদেশি চাপ ও ঐতিহাসিক ভুলের কারণে হয়েছে। ফলে এমন একটি ঝড় তৈরি হয়েছে, যাতে শক্তিশালী শাসনব্যবস্থারও পতন হয়।

সিরিয়ার সংকট শুরু হয়েছিল সরকার ও কয়েকটি বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে। পরে তা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়। এতে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের জটিল মিশ্রণ যুক্ত হয়েছে।

বছরব্যাপী কঠোর যুদ্ধ এবং সমঝোতা না হওয়ায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে। দক্ষ শ্রমিকরা দেশ ছেড়ে চলে যায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো ধ্বংস এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে ভাঙন ও দুর্নীতি সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতের আশা হারিয়ে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতাকে ত্বরান্বিত করে।

সিরিয়ার আজকের পরিণতির জন্য শুধু অভ্যন্তরীণ কারণই দায়ী নয়। সিরিয়া হলো আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র। সেখানে বাইরের দেশগুলো তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য অর্জন করতে সংকটকে কাজে লাগায়।

পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো বিরোধীদের সমর্থন করেছিল। বিদেশি শক্তিগুলো সিরিয়ার মাটিতে সরাসরি জড়িত হয়েছিল। প্রতিটি পক্ষই নিজেদের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছিল। এতে সংঘর্ষ আরও গভীর হয়ে ওঠে।

আঞ্চলিক শক্তিগুলো, যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইসরায়েল, সিরিয়ার দুর্বলতা দেখেছিল তাদের নিজস্ব প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে। তবে বছর খানেক ধরে, রাশিয়া ও ইরান থেকে সিরিয়া যে দৃঢ় সমর্থন পেয়েছিল, এর কারণে এই পরিকল্পনাগুলো সফল হয়নি। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হস্তক্ষেপ আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।

গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি আসে যখন আসাদ তার পুরোনো মিত্রদের হারান। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, নিষেধাজ্ঞা ও হতাশার অনুভূতি অনেককে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, পরিবর্তন আসবেই, যদিও সেটি ধ্বংসের মূল্য দিয়ে আসবে।

সিরিয়ার শাসক গোষ্ঠীর একটি বড় ভুল ছিল – তারা রাজনৈতিক আলোচনার প্রতি নজর না দিয়ে শুধু সামরিক সমাধানের ওপর ভরসা করেছিল। এটা আসাদকে অসহায় করে তোলে দৃঢ় ও সুশৃঙ্খল বিরোধীদের কাছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আসাদ নিজে। ১৯৬৫ সালে সিরিয়ার দীর্ঘদিনের নেতা হাফেজ আসাদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করা বাশার আল আসাদ প্রথম জীবনে রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা করেন। দামেস্কে চোখের চিকিৎসক হিসেবে পড়াশোনা শেষ করে পরে লন্ডনে বিশেষজ্ঞ হন। তাকে একটি সেক্যুলার ও শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হতো। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চরিত্র থেকে তিনি ছিলেন ভিন্ন।

পরিবারের এক ট্র্যাজেডিতে আসাদের সবকিছু পাল্টে যায়। বড় ভাই বাসিলের মৃত্যুতে বদলে যায় তার ভবিষ্যৎ। সিরিয়ায় ফিরিয়ে এনে তাকে তার পিতার উত্তরসূরি হতে বাধ্য করা হয়। ২০০০ সালে হাফেজ আসাদের মৃত্যুর পর, বাশার রাষ্ট্রপতির পদে বসেন। এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন, যা ততদিনে অভ্যন্তরীণ সংকটে পরিপূর্ণ ছিল।

বছরের পর বছর, বাশার আল আসাদকে বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। তার ঘনিষ্ঠ মহলে দুর্নীতি, আন্তর্জাতিক চাপ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সিরিয়া ও আসাদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আসাদ আরেকটি আঘাত পান তার স্ত্রী আসমার ক্যানসারের সংবাদে। অনেকেই মনে করেন, এসব বিভিন্ন কারণেই আসাদকে পরিবর্তনের দিকে মনোযোগী করে তোলে।

মিডিয়ার প্রতিবেদন বলছে, আসাদ বিরোধীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত ছিলেন। যদিও এমন দাবির পক্ষে কোনও শক্ত প্রমাণ নেই। হয়ত যুদ্ধের ক্লান্তি, ব্যক্তিগত দুঃখ ও অনিবার্য পরিবর্তনের উপলব্ধি তাকে সমঝোতার রাস্তায় ঠেলে দিয়েছিল।

সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে, সিরিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার পর আসাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ, দেশ ছাড়তে ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিতে সম্মত হন।

সম্প্রতি হোমস ও দামেস্কের পতন এই দুঃখজনক ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল। সিরিয়া নিজেই তার ভুল ও বাইরের শক্তির উদ্দেশ্যের ফাঁদে আটকা পড়েছিল। দেশটির জনগণ একটি খেলনার মতো ব্যবহার হচ্ছিল, যেখানে শান্তি নয়, বরং ক্ষমতা ও সম্পদই ছিল মূল লক্ষ্য।

এই সংকট শুধু সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, বরং এটি একটি স্পষ্ট সতর্কতা যে, কোনও রাষ্ট্র যদি তার সমাজের সংকেত উপেক্ষা করে এবং বাইরের শক্তিগুলোর হাতে তার ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা কতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

লাভ কার, এরপর কী

দামেস্কের পতন হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি শুধু আসাদ শাসনের পতন নয়, ইরানেরও বড় দুর্বলতা প্রকাশ করে। ইরান বহু বছর ধরে সিরিয়ার সঙ্গে তার জোটের মাধ্যমে নিজের প্রভাব তৈরি করেছিল। তেহরান সিরিয়াকে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখত। এতে লেবানন, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সিরিয়া ছিল হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তবে দামেস্কের পতন এবং তার পরবর্তী বিশৃঙ্খলা এই সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে, ইসরায়েল গোলান উচ্চভূমিতে সেনা মোতায়েন করে তার দখলকৃত এলাকা বাড়িয়ে নিয়েছে। এই পদক্ষেপটি ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করে এবং ইরানকে সিরিয়ায় তার কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে।

হিজবুল্লাহর ক্ষতি ইরানের জন্য আরেকটি বড় আঘাত। হিজবুল্লাহ অনেক বছর ধরে ইরানের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ ও অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে হিজবুল্লাহর অবস্থা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। গোষ্ঠটির সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে।

ইরানের জন্য, এটি শুধু লেবাননে তার প্রভাব হারানোর বিষয় নয়, বরং তার বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য কৌশলের একটি বড় ভিত্তি দুর্বল হওয়ারও বিষয়। এই পরিস্থিতিতে তেহরানকে তার পররাষ্ট্র নীতি নতুন করে সাজানোর বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর এতে দেশটির অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

ইরানি সংবাদমাধ্যম ও দেশটির কর্মকর্তারা এখন সব দায় দিচ্ছেন আসাদকে।

পার্স টুডে তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে আসাদের উপর দোষ চাপিয়ে জানিয়েছে, “বাশার শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বীকার করেছেন। ইরানের সরাসরি আবেদনও তার উপর কোনও প্রভাব ফেলেনি। কারণ তিনি জানতেন যে, সেনাবাহিনী ও সমাজ তাকে সমর্থন করবে না। পাঁচ দিন আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল যে প্রতিরোধ হবে না; শুধু ঘটনাগুলোর গতি ছিল চমকপ্রদ। বাশার ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মতো আদর্শগত নেতা নয় যে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে পারে। তার জন্য দামেস্ক ছাড়াই নিরাপদ ছিল। তবে সম্ভবত তিনি মনে রাখবেন, গত ১৩ বছর ধরে তেহরানই ছিল তার একমাত্র সত্যিকারের সহযোগী।”

সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু ইরানের পররাষ্ট্র নীতির জন্য বিপর্যয় নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ইরানের সমাজের বিভাজন আরও গভীর করছে। পশ্চিমের সঙ্গে সংলাপের পক্ষে সমর্থক সংস্কারপন্থীদের এবং কঠোর অবস্থান ধরে রাখার পক্ষে থাকা রক্ষণশীলদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এই বিভাজন আরও তীব্র হচ্ছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ছেলে মুজতবা খামেনি ২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষমতায় বসতে পারেন। এই ক্ষমতা পরিবর্তন নতুন রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূচনা করতে পারে। এমন আশঙ্কা বাড়ছে যে, ইসলামিক রিপাবলিক অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে খোলাখুলি সংঘর্ষের রূপ নিতে পারে।

ইরানের জন্য আরও বড় বিপদ হলো ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা। কারণ ইসরায়েল তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে। ইরানের দুর্বলতা ও তার সহযোগীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত বাকি অবকাঠামো লক্ষ্য করে আক্রমণ করতে পারে।

এজন্য দামেস্কের পতন শুধু একটি স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং এটি ইরানের পদ্ধতিগত সংকটের প্রতীক। এই সংকট মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যকে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে এবং এটি ইরান ও গোটা অঞ্চলে গভীর পরিবর্তন আনতে পারে।

সিরিয়ার সংকট শুধু একটি স্থানীয় সংঘর্ষ নয়; এটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সংঘর্ষের আরেকটি উপাদান। এটি স্পষ্ট যে, পশ্চিমা দেশগুলি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মধ্যপ্রাচ্যের সহযোগীরা বিদ্রোহী, বিরোধী দল এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে। এর একটি পরিষ্কার উদাহরণ হল, এইচটিএস নেতা আল-জুলানি সম্প্রতি আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্র এইচটিএসকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তবে এই আক্রমণ সিরিয়া বা ইরান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে স্বার্থকেও লক্ষ্য করেছিল। পশ্চিমা দেশগুলি, বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও লন্ডন গত দশকে মধ্যপ্রাচ্যে মস্কোর বৃদ্ধি পাওয়া প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তুষ্ট ছিল।

আসাদ সরকারের বড় মিত্র হিসেবে কাজ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সফল সম্পর্ক স্থাপন করে, রাশিয়া এই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল। সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাফল্য, যেমন তুরস্ক, ইরান এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার সহযোগিতা এবং সংঘাত সমাধানে ভূমিকা পশ্চিমকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছিল।

তাই সিরীয় সরকারের দুর্বলতা সৃষ্টি করা হয়েছিল রাশিয়ার আঞ্চলিক প্রভাবকে দুর্বল করার, তার এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারানোর এবং সম্ভবত সিরিয়া থেকে তার সামরিক উপস্থিতি সরানোর উদ্দেশ্যে। এটি মস্কোর জন্য একটি আঘাত হতে পারে, তবে এটি বলা সঠিক হবে না যে এটি রাশিয়ার বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য কৌশল বা তার আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে।

এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি।

ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং তাদের মিত্ররা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখতে যুদ্ধ করছে না। তারা পৃথিবীজুড়ে তাদের আধিপত্য শক্তিশালী করতে চেষ্টা করছে। তারা যেকোনো উপায়ে, এমনকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনও ব্যবহার করতেও প্রস্তুত তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য। এই সংঘর্ষ হলো আরেকটি বৈশ্বিক সংঘর্ষের ক্ষেত্র, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব রাখার লড়াই পশ্চিমাদের বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টার সঙ্গে সম্পর্কিত।

তুরস্কও এই পরিস্থিতিতে একটি সম্ভাব্য লাভবান হিসেবে সামনে এসেছে। আসাদ সরকারের পতনকে তারা বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে উদযাপন করছে। তুরস্কের লক্ষ্য বর্তমানে সিরীয় বিরোধী গোষ্ঠীর লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মেলে। তবে এটি সম্ভব নয় যে এই ঘটনাগুলো সরাসরি তুরস্কের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছে। বরং তুরস্ক চলমান পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে নিজেকে বিরোধী গোষ্ঠীর সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এই ঘটনা রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যদি তুরস্ক সিরিয়াতে ঘটনাগুলি সমন্বয়ে সরাসরি ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটি হবে রাশিয়ার সঙ্গে পূর্ববর্তী চুক্তির লঙ্ঘন।

সিরিয়ার অশান্তির শেষ হলো, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ লিবিয়ার অভিজ্ঞতা দেখায় যে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন খুব কমই স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। মুয়াম্মার গাদ্দাফি পতনের পর লিবিয়া শান্তি পায়নি। বরং রক্তাক্ত যুদ্ধ, গোষ্ঠীসংঘাত এবং কোটি কোটি মানুষের আশাভঙ্গ নিয়ে তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দেশটি এখনও প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিভক্ত। প্রতিটি গোষ্ঠী তার নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। ফলে জনগণ বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবকাঠামোর ধ্বংসের মধ্যে আটকা পড়েছে।

সিরিয়াতেও এমন পরিণতি আসতে পারে। সেখানে বিরোধী গোষ্ঠী এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের অর্জিত সংবেদনশীল সাফল্য দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের হুমকির আড়ালে রয়েছে। এতে সিরিয়ার বিভাজন আরও বাড়তে পারে।

তথ্যসূত্র : আরটি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত