বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। চা শিল্প খাতে নিয়োজিত প্রায় দেড় লাখ চা শ্রমিক নিয়ে গঠিত একমাত্র ট্রেড ইউনিয়নটি এশিয়ার বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত। যা যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি (সিবিএ) হিসেবে চা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মালিক ও সরকারের সাথে সম্পর্কের মধ্যস্থতা করে। ফলে ঔপনিবেশিক আমলে স্থাপন হওয়া চা শিল্পে নিপীড়িত-বঞ্চিত চা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা ও ভাগ্য নির্ধারণ অনেকাংশে নির্ভর করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপর। বছরের পর বছর কাঠামোগতভাবে এই ইউনিয়ণ ঔপনিবেশিক শোষণযন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মালিক ও বিভিন্ন শাসকদের সুবিধা দিয়েছে। ফলে চা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনও বেগবান হয়নি। বিগত সরকারগুলোর আমলেও চা শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের অবসান করতে চা শ্রমিক ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শোষণ কাঠামো যেভাবে এখনও টিকে আছে
বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইন-২০০৬ এর ২০২ ধারা অনুসারে যদি কোনও শিল্প খাতে একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন থাকে সেক্ষেত্রে সেটিই যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি (সিবিএ) হিসেবে বিবেচিত হবে। চা শিল্প খাতে চট্টগ্রাম চা শ্রমিক ইউনিয়ন নামে আরও একটি ট্রেড ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশন সম্পর্কে জানা যায়, তবে বাস্তবে তাদের কোনও কাজ দেখা যায়না। বাংলাদেশ চা শ্রমিক সংঘ নামে আরও একটি ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রার্ড ছিল আশির দশক পর্যন্ত। পরে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের আমলে তাদের রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করা হয়।
শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৮৩ ধারা অনুযায়ী চা শিল্প একটি ‘প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ’ হিসেবে বিবেচিত। এর (১) উপধারায় বলা আছে প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও স্বতন্ত্র ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে না। অর্থাৎ বাগানভিত্তিক বা কোম্পানিভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে না। (২) উপধারা অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে নিয়োজিত শ্রমিকদের ৩০ শতাংশ শ্রমিক প্রয়োজন। অথচ সকল চা শ্রমিকই চা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য। এসব শর্ত পূরণ করে চা শিল্পে বিকল্প ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা অবাস্তব।
আবার শ্রম আইনের ১৮৩(৭) ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানপুঞ্জে নিয়োজিত নয় এমন অ-শ্রমিকদেরও ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেওয়া হলেও চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে কিছুই নেই। অথচ চা শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় শিল্পে নিয়োজিত নয় এমন অ-শ্রমিকেরাই ভূমিকা রেখেছিল। চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নিয়ে শত বছর ধরে চা শিল্পে চলছে ঔপনিবেশিক শোষণ কাঠামো। এই কাঠামো টিকিয়ে রাখতে One Party State বা বাকশালের ন্যায় এখানে ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে ২৩-২৫ ধারায় শ্রমিকদেরকে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক শ্রমিককে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদান করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক শ্রমিকের স্বাধীনভাবে চাকরি বেছে নেওয়ার অধিকার, বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের সমান বেতন পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ৩৮ অনুচ্ছেদে যে কোনও ব্যক্তিকে সংগঠন করার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। বলা যায় চা শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে চা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তরান্বিত হবে না।
আমাদের দেশে চা শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের গোড়াপত্তন ১৯৪৮ সালের ৩রা জুন। তখন ‘শ্রীহট্ট জেলা চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিষ্ট্রেশন পায়, যার রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ইবি-৭৭। তৎকালীন সময়ে ইউনিয়নের অফিস ছিল কুলাউড়ায়, নাম ছিল কর্মীভবন। পরে এটি শ্রীমঙ্গলে স্থানান্তর হয় ‘ইউনিটি হাউস’ নামে। ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি— পূর্নেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত, এমএলএ, সহ সভাপতি— জীবন সাঁওতাল, এমএলএ (মাজদিহি চা বাগান) সাধারণ সম্পাদক— নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক দুর্গেশ চন্দ্র দেব। শিল্প স্থাপনের প্রায় শত বছর পরে ১৯৫৪ খ্রি. অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে চা শ্রমিকদের সরকারি আইন সভায় ভোট প্রদানের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে শ্রীহট্ট জেলা চা শ্রমিক ইউনিয়ন ইস্ট পাকিস্তান ফেডাশেন অব লেবার এর (আফতাব আলী গ্রুপ) সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরের বছর ১৯৭০ সালের ১৯ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলস্থ রেলওয়ে মাঠে অনুষ্ঠিত ইউনিয়নের ১৪তম দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে স্থানীয় একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিংগাজিয়া চা বাগানের ইসরাইল আলী ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জি নির্বাচিত হন।
রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জীর সাড়ে তিন দশকের দখলদারি
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়নের আহ্বানে ফুলছড়া চা বাগানে ১ম কেন্দ্রীয় পুনর্মিলনী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ মহাসম্মেলনে ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ নাম রাখা হয়। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন অফিসের নাম ‘ইউনিটি হাউস’ পরিবর্তন করে ‘লেবার হাউস’ রাখা হয়। ঐ তারিখে ইসরাইল আলীকে সভাপতি পদে ও রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জিকে সাধারণ সম্পাদক পদে দুই বছরের জন্য পুনঃনির্বাচিত করা হয়। এর পরই মূলত চা শ্রমিক ইউনিয়ন রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভায় টানা ১৬টি নির্বাচনে ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০২,২০০৪ ও ২০০৬ রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জী নির্বাচিত হন। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো সবচেয়ে বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়নে এই নির্বাচনগুলো কন্ঠভোটে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেই বোঝা যায় চা শ্রমিক ইউনিয়নে গণতান্ত্রিক মতামতের সুযোগ কতখানি ছিল।
নতুন ধারা এলেও গণতান্ত্রিক রূপান্তর হলো না
রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জী কর্তৃক অগণতান্ত্রিকভাবে চা শ্রমিক ইউনিয়ন কুক্ষিগত করে রাখায় শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে। ফলশ্রুতিতে ২০০৬ সালের ৮ মে আন্দোলনরত চা শ্রমিকেরা ইউনিয়ন অফিস দখলে নেয়। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক চা শ্রমিক ইউনিয়ন দখলে রাখায় রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির বিরুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক কেলেংকারী এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়। এসময় রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির ইউনিয়ন কমিটি অবাঞ্ছিত করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের এডহক কমিটির ঘোষণা করা হয়। এডহক কমিটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান সিধাউনি কুর্মী এবং সাধারণ সম্পাদক হন রাম ভজন কৈরী।
২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন প্রথমবারের মতো গোপন ব্যালটে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপে বাগান পঞ্চায়েত ও ভ্যালি কমিটি এবং দ্বিতীয় ধাপে প্রতিটি বাগান পঞ্চায়েত কমিটি ও ভ্যালি কমিটির নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। এই নির্বাচনে মাখন লাল কর্মকার সভাপতি এবং রাম ভজন কৈরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদিকে ২০০৯ সালের ১২ জুলাই রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির সমর্থনে বিজয় বুনার্জিকে আহবায়ক করে আরেকটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। পরে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে ২০১২ সালের ৩০শে অক্টোবর দুটি পক্ষ ঐক্য সম্মেলনে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে সভাপতি হন রাম ভজন কৈরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন বিজয় বুনার্জী। ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট প্রথমবার গোপন ব্যালটে নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত, ভ্যালি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি সরাসরি নির্বাচিত করার সুযোগ পায় চা শ্রমিকেরা। এই নির্বাচনে মাখন লাল কর্মকার সভাপতি এবং রাম ভজন কৈরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর ২০১৮ সালের ২৪ শে জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও মাখন লাল কর্মকার এবং রাম ভজন কৈরীর প্যানেল পুনঃনির্বাচিত হয়।
চা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির চর্চা করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা চা শ্রমিক ইউনিয়নে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০০৬ সালে সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক চা শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস দখলে তৎকালীন বিএনপির সাংসদ এম নাসের রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল। প্রথাভঙ্গ করে ইউনিয়ন অফিস দখলের পর ঘোষিত আহবায়ক কমিটি অনুমোদনের জন্য তিনি রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রম পরিচালককে চিঠি দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে নাসের রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং প্রকাশ্যে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বিএনপিতে যোগদান করেন। পরে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সাংসদ সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় চা শ্রমিক ইউনিয়ন। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ তাদের তোষামোদে মগ্ন ছিলেন। চা শ্রমিক ইউনিয়নের দালালি, তোষামোদী, চাটুকারি মনোভাব তথা লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির কারণে কেবল ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীন বিকাশের পথই বন্ধ হয়নি বরং চা শ্রমিকদের সাথে বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গঠনতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র যেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিগুলোর নিজস্ব সম্পত্তি। নিজেদের সুবিধামতো পরিবর্তন পরিবর্ধন করে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীন বিকাশের পথ বন্ধ করা হয়েছে। বিগত সময়ে ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের ২৩ অনুচ্ছেদে গঠনতন্ত্র সংশোধনীর বিষয়ে বলা হয়েছে— কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভায় দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতিতে গৃহীত প্রস্তাব বলে ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের যেকোনও অংশ সংশোধন, সংযোজন, রদ বদল ও বাতিল করা যাবে অর্থাৎ কোনও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়াই যখন যে কমিটি দায়িত্বে থাকবে তারা তাদের পছন্দ মতো পরিবর্তন আনতে পারবে।
সাধারণত অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নে দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভায় গঠনতন্ত্রে সংশোধন প্রস্তাব আনা যায়। চা শ্রমিক ইউনিয়নে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে প্রতি দুই বছর অন্তর নির্বাচনের ব্যাপারে উল্লেখ থাকলেও সংগ্রাম কমিটি ২০১৮ সালে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে তা তিন বছর করেছে। তা সত্ত্বেও বিগত প্রায় ৭ বছর যাবত চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোনও নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০১৮ এর নির্বাচিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে পদত্যাগ করলে নৃপেন পালকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং রাম ভজন কৈরীকে উপদেষ্টা করা হয়। কিন্তু গঠনতন্ত্রে এ ধরনের কোনও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বা উপদেষ্টার পদ নেই। পরে ২০২৩ সালে সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র সংশোধন এনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ যুক্ত করা হয়। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নজিরবিহীনভাবে গঠনতন্ত্রে নিজেদের লুটপাটের স্বার্থে পরিবর্তন এনে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ চা শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করেছেন। তাই স্বৈরাচারী কাঠামোর অংশ হয়ে যাওয়া চা শ্রমিক ইউনিয়নের সংস্কারে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্যান্য শিল্প খাতের ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হলেও চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের কমিশনার হিসেবে শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে এই বিধান না থাকলেও ২০১৪ সালে এ সংক্রান্ত সংশোধনী গঠনতন্ত্রেও যুক্ত করা হয়। ফলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী সরকারের হস্তক্ষেপে চা শিল্লে ট্রেড ইউনিয়ন ধ্বংস করে চা শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারি হস্তক্ষেপ রুখে দিতে হবে।
শ্রমিক ইউনিয়নের সংস্কার ছাড়া পথ নেই
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরও সবচেয়ে বৈষ্যমে থাকা নিপীড়িত ও বঞ্চিত চা জনগোষ্ঠীর সাথে ঔপনিবেশিক কাঠামোর মাধ্যম্যে সৃষ্ট বৈষম্যের অবসানে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্র থেকে আজ স্বৈরশাসক উৎখাত হয়েছে ঠিকই কিন্তু চা শিল্প থেকে এই ঔপনিবেশিক শোষণ কাঠামো বিলোপ করা আবশ্যক।
চা শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের তথা চা শ্রমিক ইউনিয়নের গণতান্ত্রিক রূপান্তর করতে হবে। চা শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের অবসান করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
কাজেই পতিত স্বৈরাচারের ঘনিষ্ঠ সহচর ও দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দিয়ে অবিলম্বে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বন্দোবস্ত শুরু করা হোক। অন্যথায় চা শিল্পে ঔপনিবেশিক শোষণ কাঠামোর বিলোপ করে চা জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
লেখক: চা শ্রমিকের সন্তান এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি।
ইমেইল: [email protected]