আপনার ওয়ারড্রোবে কি ৪০ বছর পুরনো কোনো পোশাক খুঁজে পাওয়া যাবে? আর যদি থাকে, ওই পোশাক কি এখনও সযত্নেই তোলা আছে? পোশাকের ধরন ও মান কি এখনও পরার উপযোগী?
কিং চার্লস হলে অবশ্যই এই উত্তর হবে, ‘হ্যাঁ’।
এই ব্রিটিশ সম্রাট ১৯৮০ সাল থেকে এখনও সেই ডাবল-বেস্টেড কোট গায়ে দিচ্ছেন।
এতো যুগ পরেও এই কোট ভালো থাকে কী করে?
কারণ এই কোট মোটা পশমী কাপড়ে বানানো; যা ট্যুইড নামে পরিচিত।
ঘন করে বোনা উলের এই কাপড় প্লেইন টুইল বা সাধারণ নকশা, হেরিংবোন বা মাছের হাড়ের মতো বা ‘ভি’ আকার, হাউন্ডস্টুথ নকশা বা কোনাকুনি বর্গাকারে নকশা করা হয়।
ট্যুইড শীতকালে পরার জন্য সবার পছন্দের কাপড়। এই কাপড়ের পোশাকে শরীর উষ্ণ হয়। ফরাসি ব্র্যান্ড ক্লো, ব্রিটিশ ডিজাইনারের মার্গারেট হাওয়েল থেকে শুরু করে তুলনামূলক সাশ্রয়ী ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার থেকেও এই কাপড়ের পোশাক মিলবে।
কাপড়ের টেকসই মানের কারণে কিং চার্লস টুইড বেছে নিয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ‘দ্য ক্যাম্পেইন ফর উল’ সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রতিষ্ঠাতা। একাধিক শিল্পগোষ্ঠী পরিচালিত এই সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সিন্থেটিক ফাইবারের বিপরীতে উল শিল্পের সুরক্ষা ও প্রসার নিশ্চিত করা। এ কারণে ফ্যাশন ও সাজসজ্জার পণ্যে এ ধরনের উলের কাপড় ব্যবহার করে ভোক্তাদের আকর্ষণ করা হয়।
“ট্যুইড কিন্তু শতভাগ প্রাকৃতিক, নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব পচনশীল কাপড়। এই কাপড় উৎপাদন পরিবেশে শিল্পের বিরূপ প্রভাব কমিয়ে আনে,” জানালেন অ্যান্ডারসন অ্যান্ড শেপার্ড ব্র্যান্ডের পরামর্শক মার্টিন ক্রফোর্ড। লন্ডনের সেভিল রো সড়কের এই দর্জি ব্র্যান্ড থেকেই কিং চার্লসের ডাবল-ব্রেস্টেদ স্যুট আর ব্লেজার বানানো হয়।
“সব ট্যুইড বুননকারীরা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। এবং তাদের কাজ পরিবেশবান্ধব হয়।”
দুইশ বছর ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা ট্যুইড কাপড়কে ‘প্রথম কুটির শিল্প’ বলে আখ্যা দিলেন ক্রফোর্ড।
স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডে ট্যুইড কাপড় বোনা হতো শীতে আরাম পেতে নিত্য পোশাকের জন্য। এরপর ট্যুইড গ্রামীণ জীবন থেকে ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণিতেও জড়িয়ে যায়; বিশেষ করে ১৯ শতকে শ্যুটিং-হ্যাকিং অর্থাৎ শিকার-ঘোড়া চালানোর সময় পরা জ্যাকেট বা কোটের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও ট্যুইড জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে ১৯৫০ এর দশকে ফরাসি ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেল এই ভূমিকায় নেতৃত্ব দেয়। এই ব্র্যান্ডের ট্যুইড জ্যাকেট এখনও সেরা এবং এখন পর্যন্ত এর অগণিত নকল হয়েছে।
পরে ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউড প্রথমবারের মতো হ্যারিস ট্যুইড হেব্রাইডস ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেন। স্কটল্যান্ডের আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জের আইল অব লুইসে ‘ডাবল বন্ডেড’ ট্রাউজার বানানো হয় তখন। এর এক দশক পর তিনি ১৯৮৭ সালে স্কটিশ ব্র্যান্ড হ্যারিস ট্যুইড দিয়ে ‘অটাম-উইন্টার’ মৌসুমের পোশাক বানান। তারপর থেকেই এই দুই ব্র্যান্ড এক সঙ্গে কাজ করে আসছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে হ্যারিস ট্যুইড মিল ঘুরে দেখেন ডিওর ব্র্যান্ডের ক্রিয়েটিভ পরিচালক মারিয়া গ্রাজিয়া চিউরি। এখান থেকে ‘বিস্পোক’ মানে নিজস্ব চাহিদা অনুসারে কাপড় বানিয়ে নেন তিনি।
গেল জুনে ড্রামন্ড ক্যাসলে ‘ক্রুজ ২০২৫’ আয়োজনে এই কাপড় বিশেষ আকর্ষণ হয়ে ওঠে। এই আয়োজনের ফ্যাশন স্কটল্যান্ডের রানি মেরি কুইন অব স্কটস থেকে অনুপ্রাণিত ছিল। প্রদর্শনীতে স্কটিশ টেক্সটাইল শিল্পের স্থানীয় কারিগরদেরও আনা হয়, তারা সামনা-সামনি বুনন কাজ দেখান সবাইকে।
“গত ১৫ বছরে এই শিল্পে অনেকের আগ্রহ দেখা গেছে। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী নকশা ও বুননে,” বিবিসিকে এই তথ্য দিলেন হ্যারিস টুইড হেব্রাইডস ব্র্যান্ডের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজার রুথ ম্যাসন।
তিনি বলেন, “বিলাসবহুল দোকান থেকে ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করা ভোক্তারাও এই পণ্যের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কারিগরদের হাতে বোনা এই কাপড় এবং এর অনন্য উৎপাদন প্রক্রিয়া বিভিন্ন ব্র্যান্ডকে এক হতে সাহায্য করেছে। এ কারণে আমরা নানা শ্রেণির ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।”
গত এপ্রিলে লন্ডনে হয়ে গেল বার্ষিক সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা ‘ট্যুইড রান’। সাইকেল আরোহীরা রাজধানী জুড়ে সাড়ে তেরো মাইল পথ পাড়ি দেয়। এ সময় তাদের পরনে ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাঝে জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী ফেয়ার আইল নিটওয়্যার, ট্যুইড স্যুট এবং বো টাই।
‘হ্যারিস ট্যুইড’ নামটি প্যাটেন্ট করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালের হ্যারিস ট্যুইড অ্যাক্ট অনুসারে শুধুমাত্র আউটার হেব্রাইডিসে হাতে বোনা কাপড়ই ‘অর্ব লেবেল’ ধারণ করতে পারে; যা শতভাগ ব্রিটিশ ফার্মড উল অর্থাৎ খামারে পালিত প্রাণী বা ভেড়ার লোম থেকে সংগ্রহ করা উল দিয়ে হাতে বোনা হয়। এসব প্রক্রিয়া অবশ্যই যুক্তরাজ্যেই হয়ে থাকে।
ভোক্তাদের জন্য ম্যাসনের পরামর্শ হলো, ট্যুইড লেখা কোনো পোশাক কেনার সময় অবশ্য কাপড়ের গাঁথুনি দেখে নিতে হবে, কারণ সব ট্যুইড একরকম হয় না।
“মান, সুতার উৎস, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশাল পার্থক্য হয়েই থাকে। এভাবে কাপড়ের স্থায়ীত্বেও কমবেশি হয়। ব্র্যান্ডগুলো টেকসই পণ্য দিতে চায় বলে সনদ দিয়ে থাকে। এতে করে উৎপাদন প্রক্রিয়া, প্রাকৃতিক এবং নবায়নযোগ্য উপাদান নিয়ে সবাই অবগত হতে পারে। কিছু ট্যুইড সস্তা সিনথেটিক সুতা দিয়ে বোনা হতে পারে, যা কখনই পরিবেশবান্ধব নয়।”
ট্যুইড যত ঘন করে বোনা হয় তত বেশি টেকসই হয় বলে জানালেন রেবেকা আর্লি।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব দ্যা আর্টসের সার্কুলার ডিজাইন ফিউচারস বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “উল প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল। ট্যুইড পোশাক বাইরে ঝুলিয়ে রেখে দিলে বাতাসে শোধন হয়ে যায়। ড্রাই ক্লিন করা হলে টুইডের গঠন কিছুটা ক্ষয়ে যায়।”
অনেক ট্যুইড পোশাকের নিচে আরেকটি কাপড়ের স্তর থাকে। এতে মূল পোশাকের গঠন ঠিক থাকে এবং টেকসই হয়। আবার ট্যুইড কাপড়ের ভেতরের দিকের আবরণ থেকে ত্বককে সুরক্ষা দিতে এই বাড়তি স্তর কাজে দেয়।
২০ বছর ধরে প্রতি গ্রীষ্ম আয়ারল্যান্ডের কেরিতে কাটানো রেবেকা আর্লি বলেন, “ট্যুইড প্রাকৃতিক উপাদানে বোনা কাপড়। এই কাপড়ের রঙ এর উৎপাদন অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকেই এসেছে। আমি আইরিশ ট্যুইড সহজেই চিনে ফেলতে পারি।”
হ্যারিস ট্যুইড মতো ডোনেগাল ট্যুইড আসে আয়ারল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমের ডোনেগাল কাউন্টি থেকে। এই কাপড় বুননের ইতিহাস শতাব্দী পুরনো। আইরিশ এবং স্কটিশ কাউন্টি কাপড়ের ওজন প্রায় কাছাকাছি হয়ে থাকে– ১৫ থেকে ১৬ আউন্স।
ক্রফোর্ড বলেন, এই দুই কাপড়ের মধ্যে একটি পার্থক্য আছে; ডোনেগাল হলো মেশিনো বোনা। এতে এলোমেলো রঙের দাগ দেখেই ডোনেগাল চিনে নেয়া যায়।
ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার এলিস টেম্পারলির ট্যুইড স্যুট পরতে পছন্দ করেন আর্লি।
“আমার কাছে একটি স্যুট বহু বছর ধরে আছে। আমার বলতে লজ্জা লাগছে, এই স্যুট এখন আমার গায়ে হয় না। এরপরও আমি পোশাকটি ফেলে দিচ্ছি না কারণ এই ট্যুইড বিক্রি করা যাবে। ট্যুইড আসলে সব যুগের কাপড় এবং যে কোনো ট্রেন্ডের চেয়েও বেশি কিছু।”
আর্লির কথা যে ঠিক তা বলে দিচ্ছে ফ্যাশন রেন্টাল প্ল্যাটফর্ম ‘হুর’। এখানে সেপ্টেম্বর থেকে ট্যুইড পোশাক ভাড়া নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে ১১০ শতাংশ।
“আমরা আজকাল ট্যুইড নিয়ে সার্চ সংখ্যা বাড়তে দেখেছি”, বললেন হুরের ফ্যাশন ডিরেক্টর সোফি ডেভলিন।
“লাল রঙের ট্যুইডের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। ভালো চলছে ক্লাসিক সাদা-কালো। ন্যাডিন মেরাবি এবং মন্টস্যান্ড ব্র্যান্ডের ট্যুইড পোশাক পার্টির জন্য চাহিদার শীর্ষে আছে।”
ব্রিটিশ বাউকেন ব্র্যা্ন্ড পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদিত কাপড় থেকে পোশাক বানায়। বি কর্প সনদপ্রাপ্ত এই ব্র্যান্ড বলছে, গত বছরের শীত-শরতের প্রদর্শনীর চেয়ে এবার তাদের ট্যুইড পোশাক সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। একটি নির্দিষ্ট ধরণের বাদামি চেকের ট্যুইড কোট এই মৌসুমে বিক্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
বাউকেনের ডিজাইন ডিরেক্টর নাতালি গ্রান্ট বলেন, “টেকসই এবং যে কোনো যুগের সঙ্গে মানানসই আবেদনের কারণে ভোক্তাদের কাছে ট্যুইড আলাদা মাত্রা পায়।”
“বাউকেনের কোট পুরনো উল আবার ব্যবহার করে বানানো; সঙ্গে আছে সুতি এবং পলিয়েস্টার সুতার মিশ্রণ আছে। যারা আদি ট্যুইড চেনেন-জানেন তাদের কাছে বাউকেনের কোটের আবেদন কিছু কম মনে হতে পারে। এরপরও বলতে হবে, ট্যুইড পুনঃনির্মাণ এখনো শক্তিশালীভাবে চলমান, এমনকি ২০০ বছর পরও।”
অ্যান্ডারসন অ্যান্ড শেপার্ড এখনো শিকারের জন্য শুটিং স্যুট বানায় ভারী ট্যুইড দিয়ে। যদিও আজকাল হালকা ট্যুইডের চাহিদা বেশি। যেমন শেটল্যান্ড ট্যুইড যা ১২ থেকে ১৩ আউন্স ওজনের হয়। যুক্তরাজ্যে গ্রীষ্মকাল প্রায় সারা বছরই এই কাপড় পরা যায়।
“এই ওজনের কাপড় বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ এ ধরনের জ্যাকেট সাধারণ ফ্ল্যানেল ট্রাউজার্সের সঙ্গেও পরা যায়”, বলেন ক্রফোর্ড।
“বেশিরভাগ ছুটির দিনে চিনোস বা জিনসের সঙ্গেও পরে থাকে অনেকেই।”
ট্যুইড ভবিষ্যত বোঝা যাবে সেলিব্রিটিদের ফ্যাশন অনুসরণ করে।
রাজপরিবারে শুধু রাজা চার্লসই ট্যুইড ভক্ত নন; প্রিন্সেস অব ওয়েলস নিজেও হ্যারিস ট্যুইড পরতে পছন্দ করেন। তাকে প্রায়ই শ্যানেল ব্র্যান্ডের ৯০ এর দশকের কোবাল্ট ব্লু রঙের একটি ট্যুইড জ্যাকেট গায়ে দেখা যায়।
ওদিকে অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রো এবং পপ সম্রাজ্ঞী ম্যাডোনাও ট্যুইড ভক্ত। হালে আমেরিকার মডেল জিজি হাদিদও মেতেছেন স্কটিশ ট্যুইডে।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, ট্যুইড এখন জাতীয় সীমানা ও প্রজন্ম ছাড়িয়ে গেছে।