যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার এখনও বাকি দুদিন। কিন্তু তার আগেই গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের সহকারীরা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিন অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে পদত্যাগ করতে বলেছেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তা রয়টার্সকে এই তথ্য জানান।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ট্রাম্প যে কূটনৈতিক দপ্তরে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন, তারই প্রারম্ভিক ইঙ্গিত মিলছে ওই তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের আহ্বানে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রশাসনে রূপান্তরের বিষয়টি দেখছে এজেন্সি রিভিউ টিম। এই টিমই ওই তিন কূটনীতিককে তাদের পদ ছাড়তে অনুরোধ করেছে। ওই কূটনীতিকরা হলেন- ডেরেক হোগান, মার্শা বার্নিকাট ও আলেইনা তেপলিৎজ।
মার্শা বার্নিকাট ২০১৫ সাল থেকে তিন বছর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনকালে তখন তার গাড়িতে হামলার একটি ঘটনা ছিল আলোচিত।
সাধারণত রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার সময় পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে অধিকাংশ পেশাদার কূটনীতিক এক প্রশাসন থেকে অন্য প্রশাসনে দায়িত্ব চালিয়ে যান।
পদত্যাগের অনুরোধ জানানো তিন কর্মকর্তা ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করেছেন।
ট্রাম্প শপথ নেবেন ২০ জানুয়ারি। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারে ডিপ স্টেট (সরকারের ভেতর থেকে কাজ করে যাওয়া ক্ষমতাবান চক্র) পরিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সেই কর্মকর্তাদেরই বরখাস্ত করার কথা বলছেন, যাদের তিনি অবিশ্বস্ত মনে করেন।
এজেন্সি রিভিউ টিম সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “এটি ভবিষ্যতে আরও খারাপ কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিতে পারে বলে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে।”
মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করা হলে, ট্রাম্পের ট্রানজিশন দলের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমাদের জাতি এবং আমেরিকার কর্মজীবী মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নেওয়া কর্মকর্তাদের খোঁজা হচ্ছে। আমাদের অনেক ব্যর্থতা সংশোধন করতে হবে। একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দলের প্রয়োজন।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানান, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কর্মী সংক্রান্ত কোনও ঘোষণা নেই।
হোগান, বার্নিকাট ও তেপলিৎজকে এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তারা কোনও মন্তব্য করেননি।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি আরও আক্রমণাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন এবং ইসরায়েলের প্রতি আরও সমর্থন দেওয়ার কথা বলেছেন।
এছাড়া তিনি গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ করার প্রচেষ্টা এবং ন্যাটো মিত্রদের প্রতিরক্ষা খরচ বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়ার মতো অপ্রচলিত নীতির পক্ষে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য অর্জনে এমন একটি কূটনৈতিক কর্মী দল দরকার, যারা প্রশ্ন না তুলে তার গৃহীত নীতি বাস্তবায়ন করবে।
তিন কর্মকর্তাকে পদ ছাড়ার অনুরোধ করার সিদ্ধান্তটি ট্রাম্পের প্রথম আমলের সময় পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মী পরিবর্তনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় নেতৃত্বস্থানীয় বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্র দপ্তর সম্পর্কিত পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত দুটি আলাদা সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসন সহকারী সচিবের মতো পদে আরও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সাধারণত এসব পদে পেশাদার ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের মিশ্রণ দেখা যায়।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, ট্রাম্পের দল চায় আরও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের গভীরে জায়গা দিতে। কারণ তার সহকর্মীদের মধ্যে একটি সাধারণ অনুভূতি ছিল যে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের তার শেষ মেয়াদে পেশাদার কূটনীতিকদের কারণে তার এজেন্ডা ‘বাধাগ্রস্ত’ হয়েছিল।
এজেন্সি রিভিউ টিম এরই মধ্যে পররাষ্ট্র দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, হোগান পররাষ্ট্র দপ্তরের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি। তিনি দপ্তরের বিভিন্ন ব্যুরো ও হোয়াইট হাউসের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান পরিচালনা করেন।
বার্নিকাট এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস ও বৈশ্বিক প্রতিভার পরিচালক। তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মী নিয়োগ, যাচাই-বাছাই ও উন্নয়নের তদারকি করেন।
সহকারী সচিব তেপলিৎজ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে আছেন। দেশে ও বিদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। এই বিভাগ দপ্তরের বাজেট, নিয়োগ, ক্রয় এবং মানবসম্পদ বিষয়ক একাধিক ব্যুরো তদারকি করে।
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডেনিস জেট বলেন, “এগুলো আসলে নীতিবিষয়ক পদক্ষেপ নয়। কিন্তু আপনাকে বুরোক্রেসি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, এগুলো করতে হবে।”
তার মতে, ওই তিনটি পদে কারা নিয়োগ পাবেন তা নির্বাচন করতে গিয়ে ট্রাম্পের দলের জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন অংশে সম্পদ স্থানান্তর, তথ্য সংগ্রহের নিয়ন্ত্রণ ও কর্মী সিদ্ধান্ত পরিচালনার সুযোগ তৈরি করবে।
‘ডিপ স্টেটকে’ আঘাত
ট্রাম্পের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বুধবার সেনেটে ফরেন রিলেশনস কমিটির সামনে তার অনুমোদন শুনানিতে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ওই তিন কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী ওয়েবসাইটে ১০ ধাপে ‘ডিপ স্টেট’ ভেঙে ফেলা ও ‘অবাধ্য বুরোক্র্যাট ও পেশাদার রাজনীতিকদের বরখাস্ত’ করার বিষয়গুলো বর্ণনা করেছেন।
এসব পদক্ষেপগুলোর প্রথমটি হলো ২০২০ সালের এক নির্বাহী আদেশ ফের জারি করা। এই আদেশে কিছু সরকারি কর্মচারীর চাকরি সুরক্ষা তুলে নেওয়া হয়, ফলে তাদের চাকরিচ্যুত করা সহজ হয়।
এই পরিকল্পনার বিরোধীরা বলেন, এই আদেশটি ‘স্কেজিউল এফ’ নামে পরিচিত। এতে নতুন ধরনের সরকারি কর্মচারী তৈরি হবে। তারা দাবি করেন, সরকারি কর্মচারীদের চাকরি সুরক্ষা তুলে নেওয়া ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হবে ফেডারেল অফিসগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তিনি তার নীতি সহজে বাস্তবায়ন করতে পারেন।
সাধারণত প্রেসিডেন্টরা তাদের রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েক হাজার ব্যক্তিকে ফেডারেল বুরোক্রেসিতে নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু পেশাদার সরকারি কর্মচারীরা (প্রায় ২০ লাখ) তাদের কাজ চালিয়ে যান। ‘স্কেজিউল এফ’ ট্রাম্পকে ক্ষমতা দেবে ৫০ হাজার কর্মীকে বরখাস্ত করার এবং তাদের স্থলে সমমনা রক্ষণশীলদের নিয়োগ দেওয়ার।
অধ্যাপক জেট বলেন, পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ নিলে বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।
ইউনিয়ন এবং সরকারি পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘স্কেজিউল এফ’ ফের চালু করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।