Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ইউক্রেন কেন এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়

ukraina-NATO-900x596
[publishpress_authors_box]

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমনটাই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এরই মধ্যে দীর্ঘ ফোনালাপ হয়েছে ট্রাম্পের। আলোচনায় উভয় পক্ষই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ প্রসঙ্গে কথা বলেন। পরবর্তীতে ট্রাম্প জানান, যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় বসার পর একদিনের মধ্যেই এই যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার ২৪ দিনের মাথায় তিনি যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ইউক্রেনের জন্য সামরিক তহবিলের বড় অংশই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে, এমনটাও বলেন তিনি।

ন্যাটো কী, প্রতিষ্ঠার কারণ

ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গঠিত হয়। এটি ১২টি দেশ একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে। দেশগুলো হলো— বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

জোটটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তার রোধ করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একাধিক কমিউনিস্ট প্রজাতন্ত্রের একটি জোট, যার মধ্যে রাশিয়াও ছিল।

ন্যাটো সদস্যরা একমত যে, যদি কোনও সদস্য দেশ আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে অন্য দেশগুলো তাকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেবে।

ন্যাটোর নিজস্ব কোনও সেনাবাহিনী নেই। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সংকট মোকাবিলায় একসঙ্গে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে, ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধ চলাকালে ন্যাটো জাতিসংঘকে সহায়তা করেছিল।

ন্যাটোর সদস্যরা

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মোট ৩২টি দেশ সদস্য রয়েছে ন্যাটোতে। এর মধ্যে ১২টি ছিল প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আর বাকি ২০টি দেশ ১৯৪৯ সালের পর যুক্ত হয়েছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর, পূর্ব ইউরোপীয় কিছু দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়। এর মধ্যে আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া রয়েছে।

ফিনল্যান্ড ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোর সদস্য হয়। দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে। আর সুইডেন ২০২৪ সালের মার্চে ন্যাটোতে যোগ দেয়।

দেশ দুইটি ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে দীর্ঘদিন নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর কিছুদিন পরই তারা ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আবেদন করে। ২০২২ সালের মে মাসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জমা দেয়।

ইউক্রেন, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ও জর্জিয়াও ন্যাটোতে যোগ দিতে আবেদন করেছে।

ইউক্রেন কেন ন্যাটোর সদস্য নয়

ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার প্রয়াস প্রতিনিয়ত বিরোধিতা করেছে রাশিয়া। কারণ মস্কোর দাবি, ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে পশ্চিমা এই সামরিক জোটটি রুশ সীমান্তের কাছে চলে আসবে। আর এতে রাশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে।

২০০৮ সালে ন্যাটো জানিয়েছিল, ভবিষ্যতে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারে।

রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানো শুরুর করার পর থেকেই ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া যেন দ্রুত করা হয়, এমন অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

ন্যাটোর সাবেক প্রধান জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেন, ইউক্রেন ভবিষ্যতে ন্যাটোতে যোগ দিতে পারে, তবে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা সম্ভব নয়।

তবে ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেলসে এক প্রতিরক্ষা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না যে, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়া একটি বাস্তবসম্মত সমঝোতা হবে।”

ন্যাটোর কিছু প্রতিরক্ষা প্রধান অবশ্য এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন।

ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে বিস্তর আলোচনার আগেই এনিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বোরিস পিস্তোরিয়াস।

সুইডেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পল জনসন বলেন, “ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি এখনও আলোচনার টেবিল থেকে বাদ পড়েনি।”

ন্যাটো সদস্যদের প্রতিরক্ষা ব্যয়

ন্যাটো সদস্য দেশগুলো তাদের মোট অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। সদস্যরা গড়ে তাদের জিডিপির ২ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে কিছু দেশ এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে না।

ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই গত জানুয়ারিতে ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের তাদের জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার জন্য আহ্বান জানান। ইউরোপীয় দেশগুলো চাইলে এই ব্যয় করতে পারে বলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেন।

প্ররিতক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথও এই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে জানান, যুক্তরাষ্ট্র আর ‘তার মিত্রদের সঙ্গে অসম সম্পর্ক সহ্য করবে না’।

ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটেও সদস্য দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা খরচ বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন।

২০২৪ সালে জোটটির ২৩টি দেশ ২ শতাংশ ব্যয়ের এই লক্ষ্য পূরণ করেছে। ২০১৪ সালে এই লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৩টি দেশ পূরণ করেছিল।

প্রতিরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ জিডিপি ব্যয়ের দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কাছাকাছি দেশগুলো, যেমন পোল্যান্ড এবং বল্টিক দেশগুলো।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যুক্তরাজ্য তার প্রতিরক্ষা খরচ জিডিপির আড়াই শতাংশ বাড়াবে।

ইউক্রেনকে ন্যাটো দেশগুলোর সহায়তা

ন্যাটো রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে মিত্রদের নিরাপত্তার জন্য ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সরাসরি হুমকি’ হিসেবে দেখছে।

জোটটি ইউক্রেনে সেনা পাঠায়নি বা দেশটির ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেনি। কারণ তারা রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে চায় না।

তবে কিছু সদস্য দেশ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।

জার্মানির কিয়েল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তায় ৫৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যরা একই সময়ে ৫২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো সহায়তা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, তুরস্ক ও অন্য দেশগুলো অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আর্টিলারি গান, ট্যাঙ্ক ও ড্রোন পাঠিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যেমন অ্যাটাকমাস ও স্টর্ম শ্যাডো দিয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্টে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত দুইটি এফ১৬ যুদ্ধবিমান পেয়েছে। এটি ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া ৬০টিরও বেশি যন্ত্রাংশের প্রথম পর্যায়।

একই বছরের নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যবহৃত হয়।

পিট হেগসেথ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য তার সহায়তা কমাবে এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকে সামরিক সহায়তার বড় অংশ দিতে হবে।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জন হিলি বলেন, যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘একটি পরিষ্কার বার্তা পেয়েছে’ যে সহায়তা বাড়াতে হবে, এবং তারা তা করছে। তিনি একটি নতুন ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্যাকেজের কথা উল্লেখ করেন, যাতে ড্রোন, ট্যাঙ্ক ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত