কী হচ্ছে অভিযানে
ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণ যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। রেস্টুরেন্টগুলোতে চলছে অভিযান। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও পুলিশের অভিযানের ভয়ে বন্ধ আছে অনেক রেস্টুরেন্ট।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গত বুধবারের তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন পর্যন্ত চার দিনে এক হাজার ১০০ রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে আটক হয়েছেন ৮৪৫ জন। অভিযানে মামলা হয়েছে ২০টি। ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা হয়েছে ৮৮৭ জনের।
এই অভিযানগুলোতে আসলে কী হচ্ছে? কী দেখছেন কর্তৃপক্ষ? সব অভিযান কি সমন্বিতভাবে হচ্ছে? না কি সমন্বয়হীনতার কারণে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে?
এ প্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। তার কাছ থেকে জানা গেছে, অভিযানে কয়েকটি বিষয়ে নজর দিচ্ছে সিটি করপোরেশন।
তারা দেখেছেন রেস্টুরেন্টের অগ্নি সনদ (ফায়ার লাইসেন্স) আছে কি না, রেস্টুরেন্টে যথেষ্ঠ পরিমাণ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র আছে কি না।
রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে যথেষ্ঠ বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে কি না তাও লক্ষ্য করছে করপোরেশন। জাহাঙ্গীর বলেন, “নিয়ম অনুসারে কিচেনে দুটি জানালা থাকতে হয়। একদিকে বাতাস ঢুকবে আর অন্য দিকে বের হবে।”
রান্নার কাঁচামাল সংরক্ষণের নিয়ম রেস্টুরেন্টগুলো মেনে চলছে কি না সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে বলে জানান জাহাঙ্গীর।
রেস্টুরেন্ট খুলতে কী কী সনদ
অভিযানে দেখা যাচ্ছে, অনেক রেস্টুরেন্টের কাছে নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সনদ। এর কারণেও জরিমানা, না হলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলো।
তবে রেস্টুরেন্ট মালিকরা বলছেন, নীতিমালা না থাকায় তাদের অধিকাংশই জানেন না কী কী ছাড়পত্র লাগবে। এর ফলে সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই অনেকে শুরু করে দিচ্ছেন রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট বন্ধ না করে একটি সঠিক নীতিমালা তৈরির দাবি তাদের।
রেস্টুরেন্ট তৈরিতে কী কী ছাড়পত্র প্রয়োজন তার নেই কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। তবে কয়েকজন রেস্টুরেন্ট মালিকের সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয় কী কী সনদ লাগে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০-১২টি ছাড়পত্র থাকলেই শুরু করা যায় রেস্টুরেন্টর ব্যবসা। এসব ছাড়পত্রের মধ্যে কয়েকটির সঙ্গে জড়িত থাকেন ভবন মালিকরা। ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সনদ, রাজউকের ভবনের নকশার অনুমোদনের সনদ, সিটি করপোরেশন থেকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সনদ ও পানির জন্য ওয়াসার সনদ এসব নির্ভর করে ভবন মালিকদের ওপর।
রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মিঠু মোহাম্মদ বলেন, “বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট করতে হলে তার অনুমতি ভবন মালিককে নিতে হয়। তার এসব সনদ নিতে হয়। সে নিলে আমি যেই ফ্লোরে যতটুকু জায়গায় আমার রেস্টুরেন্ট করব, ততটুকু জায়গার জন্য প্রয়োজনীয় এসব কাগজপত্র ভবন মালিকের কাছ থেকে আমরা নিই।
রেস্টুরেন্ট মালিকদের এরপর আরও বেশ কিছু কাগজ সংগ্রহ করতে হয় বলে জানান মিঠু। এর মধ্যে রয়েছে কল-কারখানা অধিদপ্তরের সনদ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদ,রেস্টুরেন্টের ঠিকানায় রেস্টুরেন্টের নামে ভ্যাট ও ট্যাক্সের জন্য পৃথক সনদ নিতে হয়।
তিনি বলেন, এসব সনদ পেলেই রেস্টুরেন্ট মালিকরা সিটি করপোরেশনে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুমতি পেলেই পাওয়া যায় ট্রেড লাইসেন্স। এরপরই তারা শুরু করতে পারেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা।
সনদে অনিয়ম, রেস্টুরেন্টে ভাড়া বেশি
রেস্টুরেন্ট মালিকরা বলছেন প্রয়োজনীয় সনদগুলো সহজে পাওয়া যায় না।
যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সনদ সংগ্রহে এক বছর সময় লেগে যাবে দাবি করেন এসকে হোসেন মোবারক জিসান নামে এক রেস্টুরেন্ট মালিক। দুর্নীতির আশ্রয় নেই দেড় মাসেই সেসব সনদ পাওয়া যায় বলেও দাবি তার।
তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে এসব একেকটি কাগজপত্র করতে তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগে। কিন্তু উপরি টাকা না দিলে একটাও কাগজ সময়মতো পাওয়া যাবে না।
বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট রেস্টুরেন্টের মালিকরা এভাবে উপরি টাকা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন বলে দাবি করেন জিসান।
ভবন মালিকরা যেসব কাগজপত্র দেন তা ঠিক আছে কি না যাচাই করেন? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল আরেক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মিঠু মোহাম্মদকে।
উত্তরে মিঠু বলেন, “আমাদের তো কাগজপত্র ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করার উপায় নেই।”
সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় পর্যবেক্ষণে এসে সব দেখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা যদি দেয় তখন আমি কীভাবে ভবন মালিককে প্রশ্ন করতে পারি?”
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিক নয়, ভবনের তত্ত্বাবধায়কের সাথেই রেস্টুরেন্ট মালিকদের যোগাযোগ থাকে বলেও জানা তিনি।
ভবন মালিকরা রেস্টুরেন্ট বানানোর অনুমতি না নিয়েই কেন রেস্টুরেন্টের জন্য জায়গা ভাড়া দেন- এ প্রশ্ন করা হয়েছিল হোসনে মোবারক জিসানকে। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাণিজ্যিক জায়গার অগ্রিম ও মাসিক ভাড়া তুলনায় রেস্টুরেন্টের অগ্রিম ও মাসিক ভাড়া অনেক বেশি।”
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক জায়গার অগ্রিম ৫ লাখ টাকা হলে, রেস্টুরেন্টের জন্য তা ১২-১৫ লাখ টাকা হবে।
প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা
জিসান বলছিলেন, “সবচেয়ে বড় সমস্যা এখানে কোনও নিয়ম নেই। একেকবার একেক লোক আসে, অভিযান চালাতে এসে বলবে আপনার এই কাগজ নেই। তাদের কাছ থেকে শুনে আমি নতুন করে সেই কাগজ করি।
“নিয়ম না থাকার কারণে উদ্যোক্তারা জানেন না তার কী করতে হবে, কী কী কাগজ লাগবে, কোথায় কোথায় যেতে হবে। এর ফলে দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে।”
একই সুর মিঠু মোহাম্মদের মুখে। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক জানেন না কীভাবে নিজের রেস্টুরেন্ট নিরাপদ রাখতে হবে। কারণ এগুলো দেখার বা শেখানোর কেউ নেই। এগুলো একটি নিয়মের মধ্যে না এনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা তো কোনও সমস্যার সমাধান না।”
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখানে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই কোটি মানুষ এ পেশার ওপর নির্ভরশীল।
এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি। সেই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব ইমরান হাসান একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানিয়েছেন ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খানও মত দিচ্ছেন সমন্বিত নীতিমলার পক্ষে।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “অভিযানগুলো তারা কীভাবে পরিচালনা করবেন, দোকানগুলো থেকে তারা কী কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা কাগজপত্র দেখবেন- এগুলো যদি সব সংস্থা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমন্বয় করে অভিযান চালায়,তাহলে এই অভিযান আরও ফলপ্রসূ হতো।”
“আমাদের সরকারি মহলও জানে না কোন কাগজ পেলে ব্যবসা করতে দেবেন বা সাট ডাউন করে দেবেন,” মন্তব্য আদিলের।
সমন্বিত নীতিমলা তৈরি না হলে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে বলেও আশঙ্কা তার।