Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

বে টার্মিনালের যেসব কাজ এগোবে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে  

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সমুদ্র উপকূলে বে টার্মিনালের প্রকল্প এলাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সমুদ্র উপকূলে বে টার্মিনালের প্রকল্প এলাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of আসিফ সিদ্দিকী

আসিফ সিদ্দিকী

চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে পতেঙ্গা এলাকায় বে টার্মিনাল নির্মাণ হবে, তা গতি পেতে যাচ্ছে এই প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অনুমোদিত ৬৫ কোটি ডলারের ঋণে।

পতেঙ্গায় সমুদ্র উপকূলে মোট ২৫০০ একর জমিতে বে টার্মিনালটি হবে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে চার গুণ বড়। আর এই বে টার্মিনালকে ‘আগামীর বন্দর’ হিসেবেই গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

এখানে হবে চারটি টার্মিনাল। আন্তর্জাতিক চার অপারেটর প্রতিষ্ঠান এসব টার্মিনালে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে আগেই।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি সংযোজন করে পরিচালনা করবে। তবে বে টার্মিনালে জাহাজের প্রবেশপথ, ব্রেকওয়াটার নির্মাণ কিংবা প্রবেশপথের নিয়মিত খননসহ অন্যান্য কাজের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবে কিছু উল্লেখ নেই। এসব কাজে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল।

ফলে বিদেশি বন্দর অপারেটররাও অপেক্ষায় ছিল বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের। এখন সেটি অনুমোদন পাওয়ায় টার্মিনাল নির্মাণের মূল অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বড় অগ্রগতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।  

‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপেন্ট’ নামের প্রকল্পের আওতায় ৬৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংকের সদর দপ্তরে ২৮ জুন সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদ বোর্ড সভায় এই ঋণ সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে। সংস্থাটির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে বে টার্মিনাল নির্মাণে বড় অঙ্কের ঋণ পেল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূলের ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত জায়গায় বে টার্মিনাল প্রকল্পের অবস্থান। চট্টগ্রাম-ঢাকা চার লেন মহাসড়কের সঙ্গে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট অংশে চার লেনের পতেঙ্গা মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে এটি সংযুক্ত। একইসঙ্গে দেশের একমাত্র বঙ্গবন্ধু টানেল সড়কের সঙ্গেও এটি সড়কপথে যুক্ত। ফলে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এটির অবস্থান।

কোন কাজে ব্যয় হবে এত টাকা

বিশ্ব ব্যাংক ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার যে ঋণ দিয়েছে, তার পুরোটাই ব্যয় হবে প্রধানত তিনটি কাজে। বঙ্গোপসাগর থেকে পতেঙ্গা এলাকার এই টার্মিনালে জাহাজ পৌঁছাতে নির্মিত হবে সোয়া ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রেকওয়াটার।

বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ উপকূলে এসে আঁচড়ে পড়ে; সেটি ঠেকাতে সাগরেই সিমেন্ট কংক্রিটের ব্লক ফেলে এই ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হবে। এতে পানির স্রোত প্রতিরোধ হবে। আর এই ব্রেকওয়াটার দিয়েই একটি জাহাজ সাগর থেকে প্রবেশপথ বা চ্যানেল দিয়েই বে টার্মিনালে ভিড়বে। এজন্য নির্মিত হবে বড় চ্যানেল। এর ফলে সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে পলি এসে জাহাজ চলাচলের প্রবেশপথে জমবে না। আবার পলি আসলেও যাতে নির্ধারিত গভীরতার জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন থাকে, সেজন্য চলবে ড্রেজিং কাজ। তবে ঋণের অর্থের মূল খরচটি হবে ব্রেকওয়াটার নির্মাণকাজে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে বাংলাদেশে প্রথম ব্রেক ওয়াটার নির্মিত হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে মহেশখালী গভীর সাগর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটি পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল বা জাহাজ চলাচলের নৌপথ তৈরি হয়েছে। এই চ্যানেল দিয়েই এখন বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নির্মিত জেটিতে জাহাজ ভিড়ছে। আর চ্যানেল ঘিরেই কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এলাকায় নির্মিত হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (এডমিন এন্ড প্ল্যানিং) জাফর আলম। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্রেক ওয়াটার নির্মাণকাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। এটি নির্মাণ করতে ২-৩ বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ীর অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি কাজকে বিভাজন করে যদি আগানো যায় তাহলে দেড় বছরের মধ্যেই সেটি নির্মাণ সম্ভব।

“তিনটি ধাপে ব্রেক ওয়াটার তৈরি হয়। মাটির নিচে একটি বেইজ তৈরি। মাটির বেইজ থেকে পানির উপরিভাগ পর্যন্ত সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধাই। তৃতীয়ত হচ্ছে, পানির উপরিভাগে ব্লক ফেলা। সেখানে সময় কমাতে আমরা ইন্দোনেশিয়া-মিয়ানমার থেকে তৈরি সিসি ব্লক বার্জে করে এনে সাগরে ফেলেছি। আর সবচেয়ে আধুনিক খননযন্ত্র দিয়ে ড্রেজিং করেছি। ফলে কাজটি দ্রুত এবং সহজ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর চাইলে বে টার্মিনালে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে।”

বিদেশি অপারেটরদের বিনিয়োগে বড় অগ্রগতি হবে

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের পাশ ঘেঁষেই বে টার্মিনাল কে ‘আগামীর বন্দর’ হিসেবেই গড়ে তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বে টার্মিনালের চারটি টার্মিনাল, ইয়ার্ডসহ মোট ২৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে ৬৬ একর জমি আগে থেকেই বন্দরের অধীনে ছিল। গত মে মাসে ৫০১ একর জমি নামমাত্র মূল্যে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে বুঝে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাকি জমিগুলো ধাপে ধাপে অধিগ্রহণ করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী, বে টার্মিনালে চারটি পৃথক টার্মিনাল তৈরি করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এরমধ্যে একটি মাল্টিপারপাস বা বহুমুখী টার্মিনাল, যার পুরোটাই বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকেই বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ছিল। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে এখন মাল্টিপারপাস টার্মিনালে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের (এডি পোর্ট গ্রুপ) সঙ্গে গত ১৬ মে চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক সমঝোতা চুক্তি হয়। এর মধ্য দিয়ে টার্মিনালে প্রথম বিনিয়োগকারী হিসেবে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের নাম তালিকায় যুক্ত হয়।

দ্বিতীয় টার্মিনাল পিএসএ সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণ-পরিচালনার সিদ্ধান্ত আছে। এটি হবে কন্টেইনার টার্মিনাল। পাশে থাকা তৃতীয় টার্মিনালটি হবে কন্টেইনার টার্মিনাল। সেটি আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড নির্মাণ-পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত আছে। চতুর্থ টার্মিনালটি হবে তেলভিত্তিক বা ট্যাংক টার্মিনাল। সেটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে দেশি প্রতিষ্ঠান ইস্টকোস্ট গ্রুপ, তাদের সঙ্গে থাকছে বিদেশি বিনিয়োগ।

অর্থাৎ চারটি টার্মিনালই বিদেশি বিনিয়োগে পরিচালনার সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্রেকওয়াটার ও সংশ্লিষ্ট কাজের নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার বিনিয়োগ বড় অগ্রগতি হিসেবে ধরা হচ্ছে।

আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছে দেশের একমাত্র টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক বিনিয়োগ নিশ্চিত করায় বিদেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানের বে টার্মিনালে বিনিয়োগ আরও ত্বরান্বিত হলো। আর কোনও জটিলতা রইল না। এর মধ্য দিয়ে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ মাল্টিপারপাস টার্মিনালে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবকে চূড়ান্ত চুক্তি করতে কাজ শুরু করব। দালিলিক প্রক্রিয়া শেষে মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু করতে পারব।”

কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে

২০১৮ সালে বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তখন মাস্টারপ্ল্যান, ভূমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত হয়নি। ফলে নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। দীর্ঘ আইনি জটিলতা পেরিয়ে ২০২৩ সালে বে টার্মিনালের ভূমি অধিগ্রহণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখন ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ। ব্রেকওয়াটার নির্মাণে দরপত্র ডাকা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের এই ঋণ অনুমোদন বে টার্মিনাল নির্মাণে বড় মাইলফলক। কারণ, এখানে বড় গভীরতার জাহাজ প্রবেশের জন্য ব্রেকওয়াটার এবং প্রবেশপথ নির্মাণের অর্থায়ন জরুরি ছিল।

“প্রবেশপথ বা চ্যানেলের নকশা এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণের ডিজাইন চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটি অনুমোদন পেলে এই কাজের জন্য দরপত্র ডাকা হবে। সব ঠিক থাকলে আশা করছি, ২০২৪ সালের অক্টোবরেই ড্রেজিং শুরু করতে পারব।”

চলতি বছর কাজগুলো শুরু হলেই বিদেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাজগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বে টার্মিনালের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ব ব্যাংকের ৬৫ কোটি ডলার ঋণ পেতে কত সময় লাগবে— এ বিষয়টি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “আমাদের পাঠানোর ডিপিপির ভিত্তিতে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাথে বিশ্ব ব্যাংকের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি হবে। আসলে তখনই আমরা জানতে পারব টাকাটা আমরা কত দিনে কীভাবে পাব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত